বাংলাদেশ কি অলিম্পিক পদক চায়
মার্টিন ফ্রেডেরিক খুব করেই চান আর্চারি নিয়ে কিছু লিখলে যেন সংবাদকর্মীরা সশরীর আর্চারদের অনুশীলনে আসেন। ফোনে কথা সারতে চাইলে খুব মোলায়েম স্বরেই ‘না’ করে দেন। কী কারণে এমন করেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি চাই, আপনারা অনুশীলনে এসে নিজের চোখে দেখে যান আর্চাররা কত পরিশ্রম করছে। এই খেলায় ভালো পারফরম্যান্সের জন্য কেমন কষ্ট করতে হয়।’
টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে সারা বছর চলে আর্চারদের আবাসিক ক্যাম্প। সেখানে চাইলেই চলে যাওয়া যায় না। একে তো শহরের কেন্দ্র থেকে টঙ্গী যাওয়াটা কষ্টকর এক যাত্রা, তার ওপর প্রচণ্ড গরমের ব্যাপার। গরমের মধ্যে মাঠে দাঁড়িয়ে আর্চারদের অনুশীলন দেখাটাও কষ্টকরই। সেসবে ভ্রুক্ষেপ না করেই ইউরোপের দেশ জার্মানি থেকে আসা আর্চারি জাতীয় দলের কোচ মার্টিন ফ্রেডেরিক গভীর মনোযোগে আর্চারদের অনুশীলন করাচ্ছেন। গরমে হাঁসফাঁস করছেন। কিন্তু নিজের কাজে এতটুকু আপস করতে রাজি নন।
টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রেডেরিক অলিম্পিকে সঙ্গী হচ্ছেন বাংলাদেশ দলের। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আর্চারি দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে ২০২১ সালে হওয়া টোকিও অলিম্পিকে গিয়েছিলেন রোমান সানা, দিয়া সিদ্দিকীদের নিয়ে। এবার প্যারিসে যাচ্ছেন সাগর ইসলামকে সঙ্গী করে। তাঁর দুই ছাত্র পরপর দুই অলিম্পিকে সরাসরি কোয়ালিফাই করেছেন। বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের জন্য অলিম্পিকে যাওয়ার বাহন ওয়াইল্ড কার্ডের ধার ধারেননি। কথাটা মনে করিয়ে দিতেই ফ্রেডেরিক হেসে বললেন, ‘এই কাজটা করতেই তো এখানে এসেছি।’
বাংলাদেশের হয়ে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার, তবে এই জার্মান কোচের অলিম্পিক অভিজ্ঞতা আরও আগের। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে প্রথমবার গিয়েছিলেন, নিজ দেশ জার্মানির প্রতিযোগীর কোচ হিসেবে। এরপর ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ছিলেন চিলির কোচ। সেই দুবার তাঁর শিষ্যদের কেউ পদক জিততে পারেননি।
ফ্রেডেরিক ২০১৬ রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকেও চিলি আর্চারি দলের কোচ ছিলেন। সেবার চিলির কেউ পদক জিততে না পারলেও ফ্রেডেরিকের পুরোনো এক জার্মান শিষ্য লিসা উনরাহ রিকার্ভ ইভেন্টে জিতেছিলেন ব্যক্তিগত রুপা। টোকিও অলিম্পিকে সেই লিসা উনরাহ রিকার্ভের দলগত ব্রোঞ্জ জেতেন। ফ্রেডেরিকই তা জানিয়ে গর্বভরে বললেন, ‘আমার সাবেক এক ছাত্রী লিসা উনরাহর অলিম্পিক পদক আছে, এটা আমার কোচিং ক্যারিয়ারের গর্বের অর্জন।’
একটি সাক্ষাৎকারেও ২০১৮ সালে লিসা কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করেছিলেন ফ্রেডেরিকের কোচিংয়ের কথা, ‘মার্টিন ফ্রেডেরিকের অধীনে ১৫ বছর বয়সে আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে কাজ করে আমার কৌশলগত অনেক উন্নতি হয়।’
বাংলাদেশ আর্চারি দলের কোচ হিসেবে অবশ্য অলিম্পিক পদক নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। রূঢ় সত্যটা খুব ভালো করেই জানেন ফ্রেডেরিক, ‘অলিম্পিক অনেক বড় মঞ্চ। খেলার সর্বোচ্চ পর্যায়। সেখান থেকে বাংলাদেশের কারও পদক আনার সম্ভাবনা আপাতত নেই, এটা মেনে নিতে হবে। অলিম্পিক, এমনকি এশিয়ান গেমস থেকেও পদক আনতে হলে যে প্রস্তুতি, যে বিনিয়োগ দরকার, সেটি করতে হবে। সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদ এ দেশেরও আছে। বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অলিম্পিক পদকটা এই দেশ চায় কি না।’
টোকিও অলিম্পিকে রোমান সানা সরাসরি সুযোগ করে নিয়েছিলেন। এবার সুযোগ পেয়েছেন সাগর ইসলাম। কিন্তু অলিম্পিকে সরাসরি কোয়ালিফাই করাটাকেই বড় অর্জন বলে মানা থেকেই পরিষ্কার, শুধু অলিম্পিয়ান হওয়ার গর্বের চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটা বাড়াবাড়ি। তারপরও সাগর সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোচও তাঁর নিবেদনে মুগ্ধ, ‘সাগর খুব ভালো আর্চার। ওর অনেক সম্ভাবনা। সে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সীমাবদ্ধতা প্রচুর। তার মধ্যেও ওর আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের কোনো কমতি নেই। দেখা যাক কী হয়!’
সাগরের একটা গুণের কথাও বললেন ফ্রেডেরিক, যেটি তাঁর খুব পছন্দের, ‘ছেলেটা অসম্ভব মনোযোগী। মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতাও অনেক বেশি। ও যদি এভাবে চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ ওর কাছ থেকে ভালো কিছুই পাবে।’
রোমান–দিয়া–হাকিম–কৃষ্ণ–সাগরদের তৈরি করেছেন। সঙ্গে নতুন প্রজন্ম নিয়েও কাজ করে চলেছেন। ছয় বছর বাংলাদেশে থেকে এ দেশের আর্চারিকে এগিয়ে দিয়েছেন বেশ খানিকটাই। এই দেশে একজন লিসা উনরাহকে কি কখনো পাবেন ফ্রেডেরিক?
জার্মান কোচের উত্তর, ‘আমি শুধু চেষ্টাই করে যেতে পারি।’
তাঁর একার চেষ্টা যে যথেষ্ট নয়, এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ, এটা আর নতুন করে বললেন না। আগেই তো বলেছেন, বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে অলিম্পিক পদক চায় কি না।