সেই গোল এখনো চোখে ভাসছে রাকিবের
ভুটানের বক্সের একটু সামনে বলটা পেলেন। শরীরের সঙ্গে লেগে থাকা ডিফেন্ডারকে ছিটকে ঢুকে পড়েন ভেতরে। কাছের পোস্ট ছেড়ে গোলকিপার একটু এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরও গোলকিপারের শরীর আর পোস্টের মাঝখানে তৈরি হওয়া শূন্য জায়গাটা ব্যবহার করে দারুণ এক গোল করলেন রাকিব হোসেন। তাঁর শট দূরের পোস্টে লেগে জড়ায় জালে।
দুরূহ কোণ থেকে রাকিবের করা এই গোল বেঙ্গালুরু সাফে বাংলাদেশের সেরা মুহূর্তগুলোর একটি। আর এই গোল তাঁকে চিনিয়েছে আলাদাভাবে। দেশে ফিরে অনেকের কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছেন। গোলটা তিনি নিজেও ভুলতে পারছেন না। চোখের সামনে ভাসছে তাঁর, ‘যখন আমি বল নিয়ে ভেতরে চলে যাই, শেষ মুহূর্তে শট নেওয়া ছাড়া আর পথ ছিল না। ভুটানের গোলকিপার প্রথমবার ছেড়ে দিয়েছে। সেটা দেখে আমি শটটা নিয়েছি। প্রায় শূন্য ডিগ্রি থেকে গোল হয়ে গেছে। গোলকিপার ভেবেছিল, হয়তো আমি কাটব্যাক করব বা ক্রস করব। আমার পেছনে একটা খেলোয়াড় ছিল। সত্যি বলতে, এ রকম গোল আমি আগে করিনি। এমন গোল পরিকল্পনা করে করা যায় না। ভাগ্যক্রমে হয়ে যায়।’
তবে সুখস্মৃতির পাশে আছে দুঃখের স্মৃতিও। কুয়েতের বিপক্ষে সেমিফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধে মোটামুটি সহজ জায়গা থেকেও গোল পাননি রাকিব। ভুটানের বিপক্ষে যেমন সৌভাগ্য হাত ধরে ছিল তাঁর। কুয়েতের বিপক্ষে ঠিক তেমনি দুর্ভাগ্য। নয়তো অমন জায়গা থেকে পোস্টে নেওয়া শট বারে লেগে ফিরে আসে! দৃশ্যটা শেল হয়ে বিঁধছে ফুটবলপ্রেমীদের মনে। রাকিবকেও পোড়াচ্ছে যন্ত্রণায়, ‘কুয়েতের গোলকিপারকে আমার বেশ চতুর মনে হয়েছিল। সে পোস্ট ছাড়েনি। এগিয়ে এলে হয়তো মাথার ওপর দিয়ে চেষ্টা করতাম। যা–ই হোক, আমার শটটা দুর্ভাগ্যক্রমে পোস্টে লাগে। ওটা আসলে আমার ভাগ্যে ছিল না।’
গোলটি হলে হয়তো ১৮ বছর পর সাফের ফাইনালে খেলতে পারত বাংলাদেশ। তবে ফাইনাল খেলতে না পারলেও ১৪ বছর পর সেমিফাইনাল তো খেলতে পেরেছে, এটাও–বা কম কী! তাতে রাকিব রেখেছেন বড় অবদানই।
এবারের সাফে বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় তরুণ শেখ মোরছালিনের নামটাই আগে বলেন অনেকে। মোরছালিনকে বাংলাদেশের সেরা আবিষ্কার বলা যায়। কিন্তু জাতীয় দলে পাঁচ বছর ধরে খেলা রাকিবকে আলাদা মূল্যায়ন করতেই হবে। রাকিব ছিলেন বাংলাদেশের আক্রমণের মূল অস্ত্র। বড় গুণ তাঁর গতি। সেই গতি দিয়ে ছত্রখান করেছেন প্রতিপক্ষকে।
অথচ বেঙ্গালুরু সাফে রাকিবের খেলাই ছিল অনিশ্চিত, ‘চোটে পড়ায় সাফে খেলতে পারব কি না নিশ্চিত ছিলাম না। খেলার চেয়ে চোট নিয়েই বেশি ভাবতে হয়েছে আমাকে। ফিজিও আমাকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। কোচ সাহস দিয়েছেন। চোট কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত খেলতে পেরেছি—এটাই বড় কথা। সব মিলিয়ে নিজের পারফরম্যান্স আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। গোল পেয়েছি, আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে।’ বলেছেন এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা ফরোয়ার্ড।
লেবানন ম্যাচের রাকিবকে বদলি হিসেবে শেষ ১৫ মিনিটে মাঠে রাখেন কোচ হাভিয়ের কাবরেরা। মালদ্বীপ ম্যাচে ৬৫ মিনিট। ভুটান ম্যাচের প্রথমার্ধেই বাংলাদেশ ৩ গোল করে জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে। রাকিবের একটি হলুদ কার্ড থাকায় তাঁকে আর দ্বিতীয়ার্ধে খেলানোর ঝুঁকি নেননি কোচ। তবে কুয়েতের সঙ্গে সেমিফাইনালে ১২০ মিনিটই খেলেছেন রাকিব।
লেবাননে বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে স্ট্রাইকার সুমন রেজাকে একাদশে রেখেছিলেন কোচ। পরে তুলে নেন। বাকি ম্যাচগুলোয় নাম্বার নাইন হিসেবে কাউকে না রেখে ছক পাল্টান কোচ। রাবিককে কখনো কখনো খেলানো হয়েছে ফলস নাম্বার নাইন হিসেবেও। তাতে মানিয়ে নেওয়া রাকিব বলছেন, ‘কোচের ম্যাচ–পরিকল্পনা ভালো ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছি কার কী দায়িত্ব।’
গতকাল বিকেলে ফোনে যখন ধরা হলো রাকিবকে, ওপ্রান্ত থেকে বললেন, এক দিনের ছুটিতে বরিশাল গেছেন। রাতেই আবার ফিরবেন, ‘বাড়ি এলে বেশি সময় থাকার সুযোগ নেই। রাতে চলে যাব। কারণ ৭ জুলাই লিগ ম্যাচ আছে আমাদের,’ বলছিলেন বাংলাদেশ দলের নাম্বার টেন। বাড়িতে বন্ধুরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাতে আপ্লুত রাকিব বলছিলেন, ‘আমি চেয়েছি দেশের জন্য কিছু করতে। চেষ্টা করেছি গোল করতে। পরিশ্রম করে ফল পেলে ভালো লাগে। লোকজন এখন আগের চেয়ে বেশি চিনতে পারছে। এটাও ভালো লাগছে।’
পাঁচ বছরে গোটা বিশেক ম্যাচ খেলে জাতীয় দলে এখন অপরিহার্য মুখ রাকিব। গত বছর কম্বোডিয়ার বিপক্ষ করেছেন নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। এবারের সাফে পেয়েছেন ২টি গোল। প্রথমটি মালদ্বীপের সঙ্গে সমতাসূচক।
বরিশাল শহরে আমানতগঞ্জে রাকিবের বাসা। মা–বাবা, দুই ভাই ও এক বোন। সবার বড় তিনি। ছোট ভাই সাকিবও ঢাকায় খেলছেন। বাবা আবুল কাশেম পল্লী বিদ্যুতে কাজ করতেন। এখন কিছু করেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রাকিব প্রথম দিকে পরিবারের সমর্থন পাননি। মা–বাবা ভাবতেন, হাত–পা ভাঙলে কে দেখবে। তবু লুকিয়ে খেলে এত দূর উঠে এসেছেন।
‘আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। নানা সংকটে এগোতে হয়েছে। একজোড়া বুট দিয়ে দুই বছরও খেলা লাগত। মা–বাবা বুট কিনে দিত না। পরিবার সে রকম সচ্ছলও ছিল না। বাইরে খেপ খেলতাম। এভাবেই উঠে এসেছি। পরে বাবা মাঠে যেতেন আমার আর ছোট ভাইয়ের খেলা দেখতে। ছেলেদের খেলা দেখতে তিনি ঢাকাও এসেছেন।’ বলতে বলতে তৃপ্ত রাকিব।
রাকিবের প্রিয় ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ছোটবেলায় ভালো লাগত দেশীয় ফুটবলার জাহিদ হোসেনের খেলা। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন জাতীয় দলে খেলবেন। সেই স্বপ্ন জেগেছিল বরিশাল থেকে উঠে এসে জাতীয় দলে খেলা ইয়াছিন, আরিফের খেলা দেখে, ‘ওনাদের খেলা দেখে ভাবতাম, আমিও খেলব জাতীয় দলে। সেটা পূরণ হওয়ায় আমি খুশি।’
এই যাত্রাপথে অনেককেই পাশে পেয়েছেন। ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ, তারপর ভিক্টোরিয়ায় খেলার সময় কোচ গোলাম জিলানীর কাছ থেকে পাওয়া সহায়তার কথা ভোলেন না, ‘স্যার আমার পাশে ছিলেন। আমার টেকনিক্যাল দিক যতটা উন্নতি হয়েছে, এতে জিলানি স্যারের অনেক কৃতিত্ব। বলতেন, তোকে দিয়ে হবে।’
কোচের পূর্বানুমান সত্যি প্রমাণ করেছেন রাকিব।