একসময়ের পরাশক্তি পাকিস্তান অলিম্পিক হকিতে নেই

পাকিস্তান হকি দলের সেই গৌরব এখন আর নেই বললেই চলেটুইটার

অলিম্পিক হকিতে পাকিস্তান সর্বশেষ পদক জিতেছিল ১৯৯২ সালে। সময়ের হিসাবে ৩২ বছর। হকি খেলাতে একসময়ের পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত দেশটি এর পর থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত। নিচে নামতে নামতে হকি থেকেই পাকিস্তানের হারিয়ে যাওয়ার দশা। ভাবা যায় অলিম্পিক হকির তিনবারের সোনাজয়ী, তিনবারের রুপাজয়ী আর দুবারের ব্রোঞ্জজয়ী দেশটি গত তিনটি অলিম্পিকের হকিতে বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি! শুধু অলিম্পিক কেন, বিশ্বকাপ হকির চারটি শিরোপা যে দেশের, তাদেরই এখন হকিতে নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে হচ্ছে।

১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকের হকিতে শেষবার সোনা জিতেছিল পাকিস্তান। সে সময় এশিয়ার ১ নম্বর দল ছিল তারা। বিশ্ব হকির অন্যতম পরাশক্তি। কিন্তু তখন কী পাকিস্তান কখনো ভাবতে পেরেছিল, সেটিই হবে তাদের শেষ অলিম্পিক হকির শ্রেষ্ঠত্ব। এরপর ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে পদকহীন পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিকে জিতেছিল ব্রোঞ্জ। পদকের পোডিয়ামে সেটিই পাকিস্তানের শেষ জায়গা করে নেওয়া। ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে পাকিস্তান শেষবার পদকের ধারেকাছে ঘেঁষতে পেরেছিল। ব্রোঞ্জ জয়ের লড়াইয়ে হেরে চতুর্থ হয়ে সন্তুষ্ট থাকার পর হকি খেলাটিই এখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম দেশটি থেকে।

আরও পড়ুন
ঢাকার মাঠে আজ ছিল ভারত–পাকিস্তান হকি লড়াই
ছবি: শামসুল হক

ব্রিটিশরাজের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে হকির আগমন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানও হকির উত্তরাধিকার অর্জন করে। শুধু উত্তরাধিকারই নয়, হকির শ্রেষ্ঠত্বও ভাগ হয়ে যায় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে। শুরু হয় দারুণ এক দ্বৈরথ। হকির সব কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটতে থাকে ভারত, পাকিস্তান—দুই দেশেই। এর মধ্যে পাকিস্তানে উঁচু মানের হকি খেলোয়াড়ের জোগান ছিল বেশি, যাঁদের কেউ কেউ পরে খেলাটির কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। নিয়াজ খান, মুনীর দার, হাবিবুর রেহমান, আজিজ মালিক, লতিফুর রেহমান, নাসির বুন্দা, হাবিব আলী কিড্ডি, জাকির হুসেন, আনোয়ার আহমেদ খানদের হাত ধরেই পাকিস্তান হকির উত্থান। অলিম্পিকে পাকিস্তানের প্রথম সাফল্য ১৯৫৬ সালে মেলবোর্নে ভারতের কাছে ১-০ গোলে হেরে রুপা জয়। চার বছর পর ১৯৬০ সালে রোমে আসে প্রথম সোনা। এরপর ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো সিটিতে আর ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে পরের দুটি সোনা। মাঝে ১৯৬৪ সালে টোকিও আর ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে দুটি রুপা। ১৯৭১ সালে হকির বিশ্বকাপ শুরুর পর প্রথম চারটি শিরোপাই জেতে পাকিস্তান।

বৈশ্বিক সাফল্য পাওয়া পাকিস্তানের এশিয়ান হকির শ্রেষ্ঠত্ব ছিল একচ্ছত্রই। ১৯৫৮ সালে টোকিওতে এশিয়ান গেমসের প্রথম আসরেই হকিতে সোনা জিতেছিল পাকিস্তান। এরপর ১৯৬২ সালে জাকার্তায়। ১৯৬৬ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে রুপা জেতার পর ১৯৭০ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত টানা চারটি এশিয়াড (ব্যাংকক, তেহরান, ব্যাংকক, দিল্লি) হকির বিজয়ী তারা। সেখানেই শেষ নয়, এরপর বিরতি দিয়ে আরও দুটি সোনার পদক আছে পাকিস্তানের—বেইজিং ১৯৯০ ও গুয়াংজু ২০১০। হকিতে পাকিস্তানের সর্বশেষ বড় শিরোপা ২০১০ সালে, গুয়াংজুতে। এশিয়া কাপ হকিতে প্রথম তিনটি শিরোপা পাকিস্তানের। তবে ১৯৮৯ সালের পর তারা এশিয়া কাপে আর শিরোপা জিততে পারেনি। হকির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও তিনটি শিরোপা পাকিস্তানের। ১৯৭৮ ও ১৯৮০ সালে লাহোর ও করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি টানা জয়ের পর তাদের তৃতীয় শিরোপাটি আসে ১৯৯৪ সালে লাহোরে।

আরও পড়ুন

সাফল্যের আলোয় রাঙা পাকিস্তানের হকি। কিন্তু গত ১৫ বছরে হকিতে পাকিস্তানের অর্জন কী? যে বিশ্বকাপের চারটি শিরোপা আছে দেশটির, তারাই ২০১৪ ও ২০২৩ সালে বাছাইপর্বই পার হতে পারেনি। ২০১৮ বিশ্বকাপে ১৬ দলের মধ্যে ১২তম হয়েছিল পাকিস্তান। এর আগে ২০১০ সালে বিশ্বকাপে সবচেয়ে নিচে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছিল তারা। সেদিক দিয়ে ২০১২ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তৃতীয় ও ২০১৪ সালে রানার্সআপ হওয়াই তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। ২০১৩ সালে ইপোহ ও ২০১৭ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপে তৃতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পাকিস্তানকে।

পাকিস্তান হকির কেন এই অধঃপতন

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা পাকিস্তান হকির অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে। সেখানে পাকিস্তান হকি দলের বর্তমান নেদারল্যান্ডসের কোচ রোলেন্ত অলতমানস হতাশার সঙ্গেই বলেছেন, ‘পাকিস্তান হকি বর্তমানে যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে পরাশক্তির পর্যায়ে যাওয়া আপাতত সম্ভব নয়। এটা সময়সাপেক্ষ। নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে, পরিকল্পনা করে এগোলেই শুধু পাকিস্তানের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেছেন, একটি দেশের হকির এগিয়ে যাওয়ার যে কর্মপদ্ধতি, সেটিই নষ্ট হয়ে গেছে পাকিস্তানে। নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে সবকিছু।

অলতমানসের মতে, আশির দশকে যখন হকি খেলাটা অ্যাস্ট্রোটার্ফে আয়োজিত হওয়া শুরু হলো, পাকিস্তানের মতো দেশ আসলে পিছিয়ে গেছে তখনই। একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে সারা দেশে কৃত্রিম মাঠ স্থাপন করা ছিল খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা—সবকিছুই হকির অধঃপতনের কারণ হিসেবে বলেছেন এই অভিজ্ঞ ডাচ কোচ।

আরও পড়ুন

অর্থনৈতিক সমস্যা বড় কারণ

হকি মোটামুটি একটি ব্যয়বহুল খেলা। অ্যাস্ট্রোটার্ফের কথা আগেই বলা হয়েছে। প্রতি ৫–৬ বছর পরপরই এর মাঠ বদলাতে হয়। লাহোর, করাচির মতো কেন্দ্রগুলোতে অ্যাস্ট্রোটার্ফ স্থাপন করা গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অ্যাস্ট্রোটার্ফ স্থাপন করা খুবই কঠিন। হকি স্টিক, টার্ফ শু বা অন্যান্য সরঞ্জামও দিনে দিনে ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। দেশটির আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও এই ব্যয়বহুল খেলার পক্ষে নয়। পাকিস্তান হকি ফেডারেশন অর্থের অভাবে নিজেদের অনেক পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করতে পারে না। এটা পাকিস্তানের অধঃপতনের বড় কারণ।

অতীতের সাফল্য যখন সমস্যা

২০১০ সাল গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান সর্বশেষ বড় কোনো সাফল্য পেয়েছিল। সে দলের অধিনায়ক সালমান আকবর মনে করেন, পাকিস্তান হকির বড় শত্রু অতীতের চর্বিতচর্বণ। পাকিস্তানে কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড়ের অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা সবাই ব্যস্ত অতীতের স্মৃতি নিয়ে। ‘অতীতে এই করেছি, সেই করেছি’—এই আলোচনা তাঁরা যতটা করেন, বর্তমান নিয়ে তাঁদের উদ্যোগ কম। সালমান আকবরের মতে, পেশাদারত্বের অভাব পাকিস্তান হকিকে দিনে দিনে পিছিয়ে দিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের সাবেক হকি কিংবদন্তিরা দু-একজন বাদে কেউই হকির উন্নয়নে এগিয়ে আসেন না। তাঁরা বুঝতে চান না, সত্তর কিংবা আশির দশক থেকে বর্তমানের হকি অনেকটাই পরিবর্তিত।

আশি ও নব্বই দশকের আরেক হকি তারকা খাজা জুনাইদ আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘একটা দেশের হকি যে নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়, যে পদ্ধতিতে তৃণমূল পর্যায়ে নতুন তারকা খেলোয়াড় তৈরি হয়, সেটি এ মুহূর্তে পাকিস্তানে নেই বললেই চলে। আর্থিক সংকট অবশ্য এর মূলে।’

আরও পড়ুন