হ্যারি ম্যাগুয়ার: এভাবেও ফিরে আসা যায়

মাসসেরার পুরস্কার হাতে ম্যাগুয়ারটুইটার

ইতালিয়ান কবি দান্তে তাঁর বিশ্বখ্যাত বই ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’তে একজন মানুষকে ধাপে ধাপে নরক থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বর্গলোকের দিকে ভ্রমণে। সেটা ছিল নিছক কাব্যগাথা। কিন্তু কখনো কখনো একজন মানুষের জীবনটাই হয়ে উঠতে পারে এমন স্বর্গ–নরকে ভরপুর মহাকাব্যিক এক যাত্রা। ফুটবল–দুনিয়ায় হ্যারি ম্যাগুয়ারের যাত্রা অনেকটা তেমনই। গত কয়েক বছরে স্বর্গ–নরকের পূর্ণাঙ্গ একটি যাত্রাই যেন সম্পন্ন করলেন ৩০ বছর বয়সী এই ইংলিশ সেন্টারব্যাক। উত্থান–পতনের এমন চিত্রনাট্য খুব কম ফুটবলারের বেলাতেই দেখা যায়।

শেফিল্ড ইউনাইটেডের বয়সভিত্তিক দলে নিজেকে তৈরি করে ক্লাবেরই হয়ে সিনিয়র ফুটবলের পথে যাত্রা শুরু করেন ম্যাগুয়ার। নিজের প্রতিভা ও সামর্থ্য শেফিল্ড থেকে তাঁকে নিয়ে আসে লেস্টার সিটিতে। সেখানেও দারুণ দৃঢ়তা দেখান এই সেন্টারব্যাক। ২০১৮ বিশ্বকাপে জাতীয় দল ইংল্যান্ডের হয়ে পারফরম্যান্স তাঁকে বৈশ্বিকভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।

শুধু রক্ষণ সামলোতেই নয়, দলের প্রয়োজনে গোল করেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন ম্যাগুয়ার। রাশিয়া বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে হেডে করা গোলটি যেন তারই প্রমাণ ছিল। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলার পথেও ম্যাগুয়ারের ছিল দারুণ অবদান। এ সময় তাঁকে নিজের প্রজন্মের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারের মর্যাদাও এনে দেয়।

আরও পড়ুন

এমন পারফরম্যান্সে স্বাভাবিকভাবেই দলবদলের বাজার চড়া হয় তাঁর। ২০১৯ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডার হিসেবে ৮০ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ম্যাগুয়ার তখন রীতিমতো ইংল্যান্ডের ‘কাল্ট হিরো’। মাঠ ও মাঠের বাইরে নায়ক হিসেবেই উচ্চারিত হচ্ছিল তাঁর নাম। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়েও শুরুতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণও রাখেন ম্যাগুয়ার। বিশেষ করে ট্যাকেলিং এবং এরিয়ালে (বাতাসে) হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। এ ছাড়া ডুয়েলেও (দ্বৈরথ) তাঁকে ফাঁকি দেওয়া ছিল প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের জন্য বেশ কঠিনই

প্রিমিয়ার লিগে চেলসির বিপক্ষে ২০১৯–২০ মৌসুমে ৪–০ গোলের জয়ে রক্ষণে ম্যাগুয়ার ছিলেন অবিশ্বাস্য। সেই মৌসুমেই লিগে তৃতীয় স্থান অর্জন করা ছিল অ্যালেক্স ফার্গুসন যুগের পর ইউনাইটেডের দ্বিতীয় সেরা অর্জন। এই অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ম্যাগুয়ারের। মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ৩৮ ম্যাচের সব কটিতেই পুরো সময় ধরে মাঠে ছিলেন ম্যাগুয়ার। যেটি ১৯৯৫ সালের পর ইউনাইটেডের জার্সিতে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য প্রথম। এর মধ্যে তাঁর কাঁধে ওঠে নেতৃত্বের ভারও। কে জানে, এমন নজরকাড়া পারফরম্যান্সের দিকে কারও ‘নজর লেগেছিল’ কি না! এসব সাফল্যই এক সময় প্রত্যাশার চাপ হয়ে চেপে বসে ম্যাগুয়ারের ওপর। সঙ্গে ভাগ্যদেবীও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে ম্যাগুয়ারের কাছ থেকে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ডিফেন্ডার হ্যারি ম্যাগুয়ার
রয়টার্স

বলা হয়, ফুটবলে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতার দূরত্ব সব সময় এক কদমের। অর্থাৎ সামান্যতম অমনোযোগ ও অসাবধানতা আপনাকে স্বর্গলোকের চূড়া থেকে নামিয়ে দিতে পারে নরকের তলানিতে। ম্যাগুয়ারের ক্যারিয়ারেও সেই যাত্রার শুরুটা হয় ২০২০ সালে। গ্রিসে মাইকোনোসে এক পানশালার বাইরে গ্রিক পুলিশের সঙ্গে মারামারিতে জড়ান ম্যাগুয়ার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অধিনায়ককে সে ঘটনায় হাজতে নিয়ে যায় পুলিশ। এমনকি মামলা থেকে বাঁচতে ইংলিশ ডিফেন্ডার ও তাঁর সঙ্গীরা নাকি ঘুষও সেঁধেছিলেন পুলিশকে। এ ঘটনার আইনি জটিলতা বেশি দূর না এগোলেও এটি মানসিকভাবে বেশ বড় ধাক্কা দেয় ম্যাগুয়ারকে।

যার প্রভাব পড়ে তাঁর মাঠের পারফরম্যান্সেও। ২০২০–২১ মৌসুমই মুদ্রার অন্য পিঠ দেখাতে শুরু করে ম্যাগুয়ারকে। হঠাৎই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে মাপা শুরু হয় ম্যাগুয়ারকে। বড় ম্যাচগুলোতেও ম্যাগুয়ারও শুরু করেন একের পর এক বড় ভুল করা। টটেনহামের বিপক্ষে সে মৌসুমে দলের হারের সঙ্গে ম্যাগুয়ারের কপালে জোটে লাল কার্ডও। এরপরই ম্যাগুয়ার ঢুকে পড়েন ব্যর্থতা, হাস্যকর ভুল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলিং এবং হুমকির দুনিয়ায়।

আরও পড়ুন

পরের দুই–আড়াই বছরে ম্যাগুয়ারের ক্যারিয়ারকে কিছু সংবাদ শিরোনামের আলোকেই দেখা যেতে পারে। সেই শিরোনামগুলো ছিল এমন—‘ম্যাগুয়ারকে ঘানার সংসদ সদস্যদের বিদ্রূপ’, ‘ম্যাগুয়ার যেন ডিফেন্ডারের ছদ্মবেশে প্রতিপক্ষের প্লে-মেকার’, ‘ম্যাগুয়ার বিদায় বললে ইউনাইটেডকে ১ কোটি পাউন্ড দিতে হবে’, ‘ম্যাগুয়ারের নেতৃত্ব কেড়ে নিলেন টেন হাগ’, ‘বোমার হুমকির পর একাদশ থেকে ছুটি ম্যাগুয়ারের’, ‘ইউনাইটেডে থাকতে চাইলে নিজেকে প্রমাণ করো: ম্যাগুয়ারকে টেন হাগ’, ‘ভিতু ও শ্লথ’ ম্যাগুয়ারকে নেতৃত্বে দেখতে চান না ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার,’ ‘এই ম্যাগুয়ারকে দিয়ে কী করবে ইংল্যান্ড’।

এসব শিরোনামও অবশ্য পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। তবে এক কথায় ম্যাগুয়ার পরিণত হন ‘ট্রল’ চরিত্রে। হাসি–তামাশার বিষয়ে। ২০২০–২১ মৌসুমে রক্ষণে হ্যারি ম্যাগুয়ারের  ভুল নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করা হয়। দেখলে মনে হবে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দর্শক হাসানোর জন্য এটি বানিয়েছেন। এই ভিডিওতে দেখা যায়, ম্যাগুয়ার কখনো প্রতিপক্ষের পায়ে বল তুলে দিচ্ছেন, আবার কখনো নিজের সতীর্থকেই ট্যাকল করছেন, বল ‘ক্লিয়ার’ করতে গিয়ে সতীর্থকেই আবার আঘাত করে বসছেন, প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড অনায়াসে তাঁকে ‘নাটমেগ’ও করছেন, আর ড্রিবলিং করতে গিয়ে হাস্যকরভাবে বল হারাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ম্যাগুয়ার যেন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান—তাঁর মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে বানানো সব ‘মিম’ দুই বছর ধরে প্রচুর হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে। ফুটবল মাঠের বদলে ম্যাগুয়ারের রাজত্ব শুরু হয় মিমের দুনিয়ায়। এমনকি তাঁকে ঠাট্টা করে তৈরি করা হয় অসংখ্য পেজও। ২০২০–২১ মৌসুমে রক্ষণে ম্যাগুয়ার ১৬টি বড় ধরনের ভুল করেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে লিভারপুলের বিপক্ষে ৫–০ গোলের হারা ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্স। এই ম্যাচে দুটি গোলের জন্য সরাসরি তাঁকেই দায়ী করা হয়। একটিতে সতীর্থ লুক শর সঙ্গে ঠ্যালাঠেলি করে গোল উপহার দেন প্রতিপক্ষকে।

এ সময় ইউনাইটেডের সাবেক অধিনায়ক নেমানিয়া ভিদিচও আত্মবিশ্বাস ফেরানোর জন্য ম্যাগুয়ারকে দল থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে আফ্রিকার দেশ ঘানার সংসদে ম্যাগুয়ারকে নিয়ে বিদ্রূপ পর্যন্ত করা হয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহামুদু বায়ুমিয়ার কর্মকাণ্ডের তুলনা করতে গিয়ে সংসদ সদস্য আইজাক আদোঙ্গো ম্যাগুয়ারকে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেছিলেন। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সে (ম্যাগুয়ার) সতীর্থদের ফাউল করত আর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের পায়ে বল তুলে দিত। মাননীয় স্পিকার, শুধু তা–ই নয়, আপনি হয়তো দেখে থাকবেন, প্রতিপক্ষ গোল করতে গেলে ম্যাগুয়ার নিজেই তাদের হয়ে গোল করত।’

এভাবেই বারবার হতাশায় ডুবেছিলেন হ্যারি ম্যাগুয়ার।
রয়টার্স

২০২৩–২৪ মৌসুমের শুরুটাও ম্যাগুয়ারের জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। মৌসুম শুরুর আগে ব্রুনো ফার্নান্দেজের কাছে নেতৃত্ব হারান। অবশ্য নেতৃত্ব তো পরের বিষয়, তাঁকে ক্লাব থেকে বের করে দেওয়ার দাবিও উঠতে থাকে। নেহাতই ম্যাগুয়ারকে ছেড়ে দিলে বড় ধরনের দণ্ডি দিতে হবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে, তাই তাঁকে রেখেই দেওয়া হয়। যদিও কোচ এরিক টেন হাগ স্পষ্ট বার্তা দিয়ে জানান পারফর্ম করতে না পারলে ক্লাবে থাকতে পারবেন না ম্যাগুয়ার। এভাবেই চলতি মৌসুমের অধ্যায় শুরু হয় তাঁর। মাঠে দুরবস্থার সঙ্গে মাঠের বাইরের আক্রমণও তখন তুঙ্গে। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে মুখ খুলতে হয় তাঁর মাকেও।

কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল যে মাঠের পারফরম্যান্স ছাড়া আর কোনো কিছু ম্যাগুয়ার সম্মান ফেরাতে পারত না। দেরিতে হলেও সে পথেই হাঁটতে শুরু করেন ম্যাগুয়ার। এবার ভাগ্যদেবীও যেন কিছু মুখ ফেরাতে শুরু করেন ম্যাগুয়ারের দিকে। একাধিক ডিফেন্ডারের চোটের কারণে একাদশে সুযোগ মেলে তাঁর। এরপর ম্যাগুয়ার যেন সেই তিন বছরের পুরোনো ম্যাগুয়ার হয়ে ফিরে আসতে শুরু করেন। ফুলহামের বিপক্ষে নভেম্বর শুরুতে ইউনাইটেডের ১–০ গোলের জয়ে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল ইস্পাতদৃঢ়। নভেম্বরের শুরুতে ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের গোলে পাওয়া জয়েও তাঁর অ্যাসিস্ট ছিল দুর্দান্ত। এরপর লুটন, শেফিল্ড ও এভারটনের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল মনে রাখার মতো। এর মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে ঘরের মাঠে কোপেনহেগেনের বিপক্ষে জয়ে একমাত্র গোলটি আসে তাঁর কাছ থেকে।

আরও পড়ুন

এমন পারফরম্যান্সের পর এবার প্রিমিয়ার লিগের মাসসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছেন ম্যাগুয়ার। এ যেন দেয়াল পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের বিপুল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ানো। অথচ এ ঘোষণা আসার পর অনেকে খবরটিকেও ট্রল মনে করেছিল। যদিও ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। যেমন ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে ভুল করেননি ঘানার সেই সংসদ সদস্য। এটি যেন ম্যাগুয়ারের কাছে গোটা ফুটবল–দুনিয়ার প্রতীকী ক্ষমা প্রার্থনা। আর কিছু নয়, শুধু নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই হারানো সম্মান ফিরে পেয়েছেন ম্যাগুয়ার।

ম্যাগুয়ারের ঘুরে দাঁড়ানো যেন চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ গানটির মতোই।