ক্রীড়া ফেডারেশনের নতুন নেতার খোঁজে অন্তবর্তীকালীন সরকার

আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাননামলে ক্রীড়াঙ্গনে চলেছে দেদার দলীয়করণ। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের রূপরেখা পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার আগে বিগত দিনে ক্রীড়াঙ্গনের হালচাল নিয়ে এই ধারাবাহিক। আজ থাকছে প্রথম পর্ব

মাঠে খেলা নেই। স্থবির হয়ে আছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পাড়ার ক্রীড়া ফেডারেশন কার্যালয়গুলোশামসুল হক

ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট বিদায় নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। এর তিন দিন পর দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাত দিয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কারকাজেও। সেই সংস্কারে ব্যক্তিকে সরালেই শুধু হবে না, গোটা সিস্টেমই বদলাতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২১ আগস্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের সব জেলা–উপজেলার বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং জেলা ও বিভাগীয় স্তরের সব মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। ২৭ আগস্ট জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থায় সাত সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের।

জেলা ক্রীড়া সংস্থা গঠন করবেন জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার। সেই শুরু থেকেই জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হয়ে আসছেন, বিভাগীয় কমিশনার বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার প্রধান। পরিবর্তিত অবস্থায় দ্রুতই জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারকে নিজ নিজ কমিটি করে অনুমোদনের জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।

সব জেলায় জেলা প্রশাসকেরা এখনো থিতু হতে পারেননি, ফলে কমিটি গঠন হতে একটু সময় লাগছে। জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোর অ্যাডহক কমিটিতে এই প্রথম স্থানীয় একজন ক্রীড়া সাংবাদিক ও একজন ছাত্র প্রতিনিধি রাখার নির্দেশনা দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, জেলা ও বিভাগীয় স্তরে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সেই সূত্রে চলছে কমিটিতে থাকার তদবিরও।

জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সব জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। নির্বাচন হলেও সরকারদলীয় লোকজনই থাকত কমিটিতে। জেলা, উপজেলা, বিভাগের রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টরা হতেন এসব সংস্থার নেতা। দেশে সরকার বদলের পর কমিটিগুলো ভেঙে দেওয়ায় সারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন নেতৃত্ব আসছে।

 সভাপতিদের অব্যাহতি

দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ৫৫। ১ সেপ্টেম্বর প্রথমে তিন ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে সরিয়ে দেয় সরকার। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন ২০১৮–এর ২২ ধারায় দাবা, কাবাডির সভাপতিকে অপসারণ ও ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে দাবার সভাপতি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই গোপনে দেশ ছাড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে এখন।

সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর ৪২টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ২৬টি ফেডারেশন হলো ব্যাডমিন্টন, শুটিং, হ্যান্ডবল, জুডো, কারাতে, তায়কোয়ান্দো, টেবিল টেনিস, জিমন্যাস্টিকস, বাস্কেটবল, আর্চারি, বক্সিং, রাগবি, ফেন্সিং, ভারোত্তোলন, উশু, ক্যারম, সাইক্লিং, টেনিস, কুস্তি, ভলিবল, স্কোয়াশ অ্যান্ড র‍্যাকেটস, রোইং, অ্যাথলেটিকস, খো খো, রোলার স্কেটিং ও বধির ফেডারেশন।

সরানো হয়েছে ফেডারেশনের নিচের স্তর ১৩টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকেও। এগুলো হলো বেসবল-সফটবল, বাশআপ, সার্ফিং, মাউন্টেনিয়ারিং, চুকবল, সেপাট-টাকরো, জুজুৎসু, প্যারা আর্চারি, কান্ট্রি গেমস, থ্রো বল, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো, ঘুড়ি ও খিউকুশিন। এ ছাড়া ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক কমিটি, বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশন ও বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতিকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সভাপতিদের অব্যাহতির তালিকায় অবশ্য নেই হকি, সাঁতার, গলফসহ কয়েকটির সভাপতি। অলিখিত রীতি অনুযায়ী অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে আসছেন বিমানবাহিনীর প্রধান, সাঁতার ফেডারেশনের সভাপতি নৌবাহিনীর প্রধান। গলফ ফেডারেশনের সভাপতি পদে আছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে এলেও ফুটবল ও ক্রিকেট বাদে বাকিগুলোয় সভাপতি নিয়োগ দেয় সরকার। অন্তবর্তীকালীন সরকার সেই নিয়োগ বাতিল করায় বর্তমানে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোয় সভাপতির পদগুলো শূন্য। শরীর গঠন ফেডারেশন এবং ব্যুত্থান ও ইয়োগা অ্যাসোসিয়েশনে আগে থেকেই সভাপতি ছিল না। ৪৫ জন সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়ার পর এখন তাই মোট ৪৮টি ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি নেই।

কোনো কোনো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকও নেই। এমন অন্তত চারটি ফেডারেশনের কথা তো বলাই যায়। অ্যাথলেটিকস, কাবাডি, কারাতে ও শরীর গঠন ফেডারেশন চারটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেউই নেই এখন। পুলিশের মহাপরিদর্শককে অনেক দিন থেকেই কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি মনোনীত করে আসছে সরকার।

এরই জের হিসেবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন পরিণত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ পুলিশ ফেডারেশনে’। এর শীর্ষ তিনটি পদেই বসে ছিলেন পুলিশের তিন কর্মকর্তা। সভাপতি পদে ছিলেন সর্বশেষ আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাধারণ সম্পাদক পদে ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক পদে অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক। এর মধ্যে সভাপতির সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে কাবাডিতে শীর্ষ দুই পদই এখন শূন্য।

অ্যাথলেটিকসের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াকেও সরিয়ে দিয়েছে সরকার। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বৃহত্তর সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুর রকিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২১ আগস্ট পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ক্য শৈ হ্লা পদত্যাগ করেছেন। সাবেক কারাতেকা ক্য শৈ হ্লা বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বিভিন্ন ফেডারেশনের কমিটিতে থাকা ক্রীড়া পরিষদের ১৬ জন কর্মকর্তাকে কমিটি থেকে সরিয়ে দেয়। এতেই বাদ পড়েন শরীর গঠন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ শামীম হাসান।

ক্রীড়া ফেডারেশন পরিচালনা করেন মূলত সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কয়েকটি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গা ঢাকা দিয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যাসিনো–কাণ্ডে জড়িত মমিনুল হক সাঈদ, যিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাবেক জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ। এ ছাড়া অনেক ফেডারেশন সম্পাদকই হয়ে পড়েছেন নিষ্ক্রিয়। পরিবর্তিত অবস্থায় তাঁরা ফেডারেশনে আর নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখছেন না। যার ফলে ৯০ শতাংশ ফেডারেশনেরই এখন কোনো কার্যক্রম নেই।

জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু সব জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। নির্বাচন হলেও সরকারদলীয় লোকজনই থাকত কমিটিতে।

সার্চ কমিটি গঠন

আগামী দিনে ক্রীড়াঙ্গন কীভাবে চলবে, তার রূপরেখা ঠিক করতে ৩০ আগস্ট একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সাবেক জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন জোবায়েদুর রহমানকে, যিনি এই দায়িত্ব পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সহসভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন। সার্চ কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি প্রায় প্রতিটি ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশন ধরে ধরে আলোচনা করছে। এতে সার্চ কমিটি দুই মাসের বেশি সময় নিতে পারে। এরই মধ্যে কমিটি সাত–আটটি সভা করেছে।

কমিটির সভায় ফেডারেশনগুলোর সংস্কার নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম গঠনতন্ত্র যুগোপযোগী করা। একটা মডেল গঠনতন্ত্র তৈরি করতে চায় এই কমিটি। কারা সভাপতি হতে পারেন, কাদের নিয়ে গঠিত হতে পারে অ্যাডহক কমিটি, সেসব নাম জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে প্রস্তাব করবে কমিটি। এত দিন যেভাবে সরকারের মন্ত্রী, সচিব, দলীয় নেতারা ঢালাওভাবে ফেডারেশনের নেতৃত্বে এসেছেন, আর যেন তা না হয়, এ ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। মন্ত্রীর পদপর্যাদার উপদেষ্টাদের কেউও কোনো ফেডারেশনের সভাপতি হবেন না।

সার্চ কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, এমন কাউকে সভাপতি করা হবে, যিনি পৃষ্ঠপোষক আনতে পারবেন। তিনি ব্যবসায়ীও হতে পারেন। রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একেবারে খেলাধুলার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো রাজনৈতিক নেতাকে ফেডারেশন সভাপতি করা হবে না। তবে খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে তাঁকে তো বাদ দেওয়া যাবে না।’ সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের ফেডারেশন সভাপতি রাখার পক্ষে অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাহিনীপ্রধানদের কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁদের বাদ দেওয়ার চিন্তা নেই।’

ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যেই ২১ আগস্ট বিসিবিপ্রধানের পদ ছেড়েছেন নাজমুল হাসান। নতুন সভাপতি হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বাফুফের নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো সভাপতি প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কাজী সালাহউদ্দিন। ফলে ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বড় দুটি ফেডারেশনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন পর পরিবর্তন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে।

ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সহসভাপতি ও পাঁচ দশকেরও বেশি ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, দ্রুতই ফেডারেশনগুলোয় সভাপতি নিয়োগ দিয়ে এগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। সেই সভাপতিদের ক্রীড়াঙ্গনে গ্রহণযোগ্য লোক হতে হবে। তিনি বলেন, ‘সভাপতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট খেলার কোনো সাবেক খেলোয়াড় এলে ভালো হয়। তবে তাঁর সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। হুট করে অচেনা কাউকে চাপিয়ে দিলে কোনো ফল আসবে না। অতীতে এমন সভাপতি ফেডারেশনের অফিসেই আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে বলে মনে হয় না।’