৭০০ মিলিয়ন ইউরোর ইসকোর সমস্যা কোথায়?
>২০১৯ সালে তার থেকে বেশি সময় বেঞ্চে কাটাতে হয়নি অন্য কোনো লা লিগার খেলোয়াড়ের। তার পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে যেমন রয়েছে বর্তমান ট্যাকটিকসে না মেলা, তেমনি সোলারির সঙ্গে শীতল সম্পর্ক।
কোচ সান্তিয়াগো সোলারির সঙ্গে ইসকোর সম্পর্ককে কি দা-কুমড়ো সম্পর্ক বলা যায়? দুজনের সম্পর্ক দিনে দিনে সেদিকেই এগোচ্ছে। হুলেন লোপেতেগির অধীনে স্পেন আর রিয়াল মাদ্রিদ দলকে ইসকো ছাড়া কল্পনা করাও ছিল দুরূহ, সেই ইসকোকে এখন মাঠে দেখা যায় কালে-ভদ্রে। একেকটি ম্যাচ যায়, আর একটু করে সম্পর্কের নতুন মোড় ঘোরে তাদের। কোচ-খেলোয়াড়ের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক থাকার কথা তেমন তো নেইই, বরং দিনদিন শীতল হচ্ছে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে তো রেকর্ড বইয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন ইসকো। এ বছরে তাঁর থেকে বেশি সময় বেঞ্চে বসে থাকেননি লা লিগার কোনো খেলোয়াড়।
এ মৌসুমে উড়ন্ত শুরু হয়েছিল ইসকোর। বল পায়ে যেমন ক্ষিপ্রতা, তেমনি মাঠে জয়ের আকুলতা। সব মিলে এক অদ্ভুত সুন্দর ইসকোর দেখা মিলেছিল এ বছর। কিন্তু যত দিন অতিবাহিত হয়েছে, তত পড়তে শুরু করেছে তাঁর ফর্ম। শেষপর্যন্ত বরখাস্ত হন হুলেন লোপেতেগি। নতুন কোচের অধীনে পুরো ট্যাকটিকসে পরিবর্তন আসে, সেই সঙ্গে তাঁর দিনও শেষ হয়ে আসে। এই বছরে চার ম্যাচে তাঁকে মাঠেই নামাননি সোলারি। ২০১৯ সালে মোট ৭৬৭ মিনিট বেঞ্চে বসে কাটাতে হয়েছে ইসকোকে। লা লিগায় এত সময় বেঞ্চে বসে থাকতে হয়নি কাউকে। তাঁর নিকটে আছেন সেভিয়ার ব্রায়ান গিল, যিনি বেঞ্চে বসে ছিলেন ৬৮৭ মিনিট। অথচ এই ইসকোর নতুন চুক্তিতেই রিলিজ ক্লজ বাড়িয়ে ৭০০ মিলিয়ন করেছিল রিয়াল, যেন অন্য কোনো লাভ তাঁকে প্রলোভন দেখিয়ে না নিতে পারে!
সোলারিকে দোষ দিয়েও বা লাভ কী? লোপেতেগির অধীনে তাঁর জন্য আলাদা করে জায়গা ছিল শুরুর একাদশে। ‘নম্বর টেন’ পজিশনে খেলা ইসকো ছিলেন মূল হাতিয়ার। আক্রমণে বল তৈরির ক্ষেত্রে তার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু লোপেতেগির চলে যাওয়ার পর সময় বদলাতে থাকে। ইসকোকে কেন্দ্র করে খেলায় সৌন্দর্য থাকলেও, খেলার গতি কমিয়ে দিত। স্লো বিল্ড-আপ করে খেলা ইসকো কাউন্টার-অ্যাটাকে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। নতুন কোচ সোলারি কাস্তিয়ার কোচ থাকার সময় নিজে চোখে দেখেছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের খেলা। তাই ইসকোর বদলে সুযোগ দেন ব্রাজিলিয়ান তরুণকে। ডান প্রান্তেও তথাকথিত কম স্কিলের লুকাস ভাসকেজকে সুযোগ দিয়েছেন সোলারি। কোচকে আশাহত করেননি ভিনিসিয়ুস বা ভাসকেজ। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে বেনজেমাকে নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদকে আবারও জয়ের পথ দেখাচ্ছেন এ দুজন।
ভিনির অসাধারণ খেলা কপাল পুড়িয়েছে ইসকোর। রোনালদো চলে যাওয়ার পর প্রেসিং ও পজিশনিং মিলিয়ে অন্য ধরণের ফুটবলে মনোনিবেশ করেছিল রিয়াল। তার মূল কান্ডারি ছিলেন ইসকো। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়ে জিদানের পুরোনো ট্যাকটিকসেই ফিরে এসেছেন সোলারি। মাঝমাঠকে কেন্দ্র করে খেলা বাদ দিয়ে উইং কেন্দ্রিক খেলায় মনোনিবেশ করেন সোলারি। সেখানে ইসকোর চেয়ে ভিনিসিয়ুস বা ভাসকেজই বেশি পছন্দের। দলে তাই ব্রাত্য হয়ে পড়েন ইসকো।
তবে ইসকোকে না খেলানোর পেছনে দায়ী করা হয় সোলারির সঙ্গে তার সম্পর্ক। ট্রেনিংয়ে বেশি সময় দেওয়া কখনোই পছন্দ না ইসকোর। বরং অল্প পরিশ্রমে নিজের প্রতিভায় ভর করে ভালো করার ইচ্ছে তার। যা পছন্দ না সোলারির। বরং তাঁর পছন্দ পরিশ্রম; যে পরিশ্রম করবে, তাঁকেই সুযোগ দেবেন সোলারি। যে কারণে কোচের গুডবুক থেকে শুরুতেই নাম কাটা যায় ইসকোর। তাঁর সঙ্গে রয়েছে ঠোঁটকাটা কথাবার্তা।
যদিও ইসকোর ব্যাপারে সব সময়ই আশাবাদী সোলারি, ‘দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে সবাইকেই ব্যবহার করা হবে।’ কিন্তু ইসকোর উত্তরটাও ঠিক আগের মতোই। গতকাল টুইটারে লিখেছেন, ‘আমি আমার সতীর্থদের মতো তেমন সুযোগ পাই না। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, ভালো কিছু করার।’ সোলারি ছাড়েননি বরং তার জবাব দিয়েছেন হাতে নাতে। ‘একজন ভালো খেলোয়াড়ের দায়িত্ব দলের ট্রেনিংয়ে শতভাগ দেওয়া।’ দুজনের কথাই সত্যি। কিন্তু ইসকোর মতো খেলোয়াড়দের ফুটবলের অলস সৌন্দর্য বললেও ভুল হবে না। খুব একটা পরিশ্রম না করেও মাঠে পুষিয়ে দিয়ে থাকে এসব খেলোয়াড়রা।
ঠোঁটকাটা শোনালেও ইসকোর কথাটা একটু বেশি সত্য। এ বছরে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সবচেয়ে কম সুযোগ পেয়েছেন ইসকো। এমনকি প্রয়োজনের সময়েও তাঁর দিকে ফিরেও তাকাননি সোলারি। জিদানের অধীনেও বেঞ্চে থাকতে হয়েছে তাঁকে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় ঠিকই খুঁজে নিয়েছেন জিদান। কিন্তু সোলারির অধীনে তা হচ্ছে না। এল ক্লাসিকোর মতো ম্যাচে যেখানে শেষদিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন ইসকো, সেখানে নামানো হয়েছে গ্যারেথ বেলকে। অথচ এই মৌসুমে মাঠে বাজে খেলার কারণ সবচেয়ে বেশি সমালোচনার স্বীকার হতে হয়েছে বেলকে। ফর্মে থাকা বেনজেমার সঙ্গেও ইসকোর সম্পর্ক অনেক ভালো। তাদের দুজনের জুটিতে ন্যু ক্যাম্পে এল ক্লাসিকো জেতার সুযোগ ছিল রিয়াল মাদ্রিদের।
সামনে ব্যস্ত সূচি রিয়াল মাদ্রিদের, এর মধ্যেই চোটের কারণে আবারও ছিটকে গিয়েছেন ইসকো। চাইলেও এ সময়ে তাঁকে ব্যবহার করতে পারছেন না সোলারি। এর মাঝেই দলে সেবায়োসের মতো প্রতিভারা মধ্যমাঠেও ভিড় বারিয়ে দিচ্ছেন। তবে ফিরেও ব্যস্ত সূচি পাবেন ইসকো। তাই মদরিচ, ক্রুসদের দরকারি বিশ্রাম দেওয়ার প্রয়োজন হবে কোচের। তখনো সোলারির বিমাতাসুলভ আচরণ চলতে থাকলে সাদা জার্সিতে আর বেশি দিন দেখা যাবে না ইসকোকে। যদিও তাঁকে দলে জায়গা করে দেওয়ার মতো কোচ ফুটবলে এখন বেশ কমই আছেন, তবু ইসকোর মতো খেলোয়াড়কে প্রতিপক্ষ নয় নিজ স্কোয়াডেই পেতে চাইবেন সবাই।