২০,৫৪১ কোটি টাকায় এল গার্দিওলাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল
সময়টা ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিন। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের শেষ দিন। বাতাসে জোর গুঞ্জন, রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ‘নতুন পেলে’ নামে খ্যাত রবিনিও নাম লেখাবেন চেলসিতে। রিয়াল মাদ্রিদ কাকা, করিম বেনজেমা ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকাকে দলে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা ভালো লাগেনি রবিনিওর। ভেবেছিলেন, তাঁরা রিয়ালে এলে দাম কমে যাবে নিজের। ফুটবলপ্রেমীরাও অপেক্ষা করছিলেন চেলসির আক্রমণভাগে দিদিয়ের দ্রগবা, নিকোলাস আনেলকার সঙ্গে রবিনিওর দুর্দান্ত রসায়ন দেখার।
কিন্তু সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটল ওই সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনেই। ফুটবলপ্রেমীরা চোখ কচলে দেখলেন ৩২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় ৩৮৩ কোটি টাকার বিনিময়ে রিয়াল থেকে ছোঁ মেরে রবিনিওকে কিনে নিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। হ্যাঁ, ম্যানচেস্টার সিটিই। ফুটবলের তথাকথিত কুলীন সমাজের বাইরেই ছিল দলটি। ইংলিশ লিগের মাঝারি মানের একটা দল এত টাকা কীভাবে পেল, রিয়ালের মতো দলকে বোকা বানিয়ে কীভাবে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা প্রতিভাকে দলে পেল, সে বিষয়টিই সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। রবিনিওই–বা কেন এই ক্লাবে চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের মতো শীর্ষস্থানীয় কোনো ক্লাব বেছে না নিয়ে সিটিকে বেছে নিল—সে প্রশ্নও উঠেছিল সব জায়গায়। নানামুখী জল্পনাকল্পনার মধ্যেই জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের এক ধনাঢ্য বিনিয়োগ কোম্পানি আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ ম্যানচেস্টার সিটিকে কিনে নিয়েছে। কিনেই হাত বাড়িয়েছে রবিনিওর দিকে।
সেই থেকে শুরু। ইংলিশ ফুটবলের আকাশে এভাবে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হওয়া সিটি পরের ১৩ বছর এভাবে মাঠের ভেতর ও বাইরের ছড়ি ঘুরিয়েছে। ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোয় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে। লিগ, কাপ, শিল্ড—জিতেছে একের পর এক। কিন্তু কোনোভাবেই চ্যাম্পিয়নস লিগটা ধরতে পারছিল না। ধরা তো দূর, ফাইনালেই উঠতে পারেনি। সে গেরো এবার কাটিয়েছেন পেপ গার্দিওলা। স্প্যানিশ এই ম্যানেজারের ছোঁয়ায় মালিকানা বদলের ১৩ বছরে মাথায় অবশেষে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের স্বাদ পেয়েছে ম্যানচেস্টারের নীল দলটা। আর এক ম্যাচ জিতলেই ইউরোপ–সেরা হিসেবে নিজেদের জাহির করতে পারবে গার্দিওলার দল।
একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আশায় কি কম টাকা ঢেলেছে তারা! দলবদল–সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ট্রান্সফারমার্কেট ডটকম জানিয়েছে, এই ১৩ বছরে নতুন খেলোয়াড়ের পেছনে প্রায় দুই বিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে তারা। বাংলাদেশি হিসেবে প্রায় ২০ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। সেমিতে সিটির প্রতিপক্ষ যারা ছিল, সেই পিএসজিও মালিকের টাকার পরিপুষ্ট একটা দল। তাও ২০১১ সালে মালিকানা বদল হওয়া দলটার খরচ সিটির তুলনায় বলতে গেলে কিছুই না। এমবাপ্পে-নেইমারদের কেনা দলটা গত এক দশকে খরচ করেছে ১২৫ কোটি ৪০ লাখ ইউরোর মতো। বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় ১২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকার সমান। সিটির চেয়ে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা কম।
রবিনিওর দেখানো পথ ধরে একে একে দলে এসেছেন আরও কত মানুষ! সের্হিও আগুয়েরো, কার্লোস তেভেজ, ইয়ায়া তুরে, ডেভিড সিলভা, কেভিন ডি ব্রুইনা, রিয়াদ মাহরেজ, জন স্টোনস, রুবেন দিয়াস, ফার্নান্দিনিও, কাইল ওয়াকার, এদিন জেকো। এদেরসন, বেঞ্জামিন মেন্দি, এমেরিক লাপোর্ত, রহিম স্টার্লিংদের মতো প্রতিভাদের পেছনে টাকা ঢেলে সিটি যেমন সুফল পেয়েছে, উইলফ্রায়েড বোনি, এলিয়াকুইম মাঙ্গালা, দানিলো, স্তেভান ইয়োভেটিচ, মারিও বালোতেল্লি, ফের্নান্দো, ক্লদিও ব্রাভো, ইমানুয়েল আদেবায়োর, নলিতো আর জেসুস নাভাসরা বুঝিয়েছেন, এলোমেলো টাকা ঢাললেই লাভ হয় না।
শেষমেশ গার্দিওলার হাতে দায়িত্ব দেওয়ার পরই এল কাঙ্ক্ষিত সেই ফাইনাল। দুই লেগ মিলিয়ে পিএসজিকে ৪-১ গোলে হারিয়েই ফাইনালে উঠেছে তারা। ইউরোপ–সেরা হওয়ার পথে সিটির পথের বাধা এখন হয় চেলসি, নয় রিয়াল মাদ্রিদ।
তিন সপ্তাহ পর দেখা যাবে, শেষ রেসের বাধাটা পার হয়ে সিটির এই দল নিজেদের নাম অবিনশ্বর করে তুলতে পারে কি না। তবেই না ২০ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা ঢালার চূড়ান্ত সফলতা আসবে!