স্বাধীনতাযুদ্ধে ফুটবল আর চুনী গোস্বামীর ‘শেষ ঝলক’

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কীর্তি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ইতিহাস গড়া সে দলের দুটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব পড়ুন আজ—
চুনী গোস্বামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা ম্যাচে খেলেছিলেন অবসর ভেঙে।
ছবি: সংগৃহীত

এক.

‘ওয়ান লাস্ট ডান্স...’

ঘরের উল্টো দিকের সোফায় বসে থাকা চশমা পরা ছেলেটা এতক্ষণ ধরে কী বলছিল, মাথায় ঢোকেনি তাঁর। তিন থেকে চার মিনিট ধরে যা যা বলল, তার মধ্যে শুধু এই তিনটি শব্দই তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকে গেল ভালোভাবে।

ছেলেটাকে আরেকটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। চশমার আড়ালে চোখজোড়ায় অদ্ভুত এক দীপ্তি। চালু ছেলে, বুদ্ধিদীপ্ত—বোঝাই যাচ্ছে। নাহ, মোহনবাগানের কর্মকর্তারা তাঁকে পটানোর জন্য বোকাসোকা কাউকে পাঠাননি, মনে মনে তারিফই করলেন ক্লাবকর্তাদের। ছেলেটা এসে মোটামুটি তিন থেকে চার মিনিটের একটা ভাষণ দিয়ে দিয়েছে। ভালোই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে।

বাইরে বাইরে ছেলেটা নিজেকে যতই চটপটে প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন, তাঁর অভিজ্ঞ চোখজোড়া ঠিকই ধরে নিয়েছে, ভেতরে-ভেতরে ঠিকই ছেলেটার বুক ধড়ফড় করছে। কানের পেছন দিয়ে তিরতির করে ঘাম বেয়ে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে সাদা শার্টটাকে।

‘কইরে পাঁচু! কোথায় গেলি? বাবুকে এক গেলাস ঠান্ডা জল দিয়ে যা!’

চাকরের প্রতি তাঁর হাঁকডাক শুনে ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সেটাও তাঁর চোখ এড়াল না। মনে মনে খুশিই হলেন। খেলা ছাড়ার পর এই একটা জিনিস করতে তাঁর খুব ভালো লাগে। মানুষের মনের হাবভাব বোঝা। নিজেকে অন্তর্যামী গোছের মনে হয়। মনে হয় শক্তিশালী কেউ। সবাই নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে পছন্দ করে। তিনিই–বা ব্যতিক্রম হবেন কেন?

এত কিছুর মধ্যেও ছেলের মুখ থেকে বের হওয়া ওই তিনটি শব্দ মাথা থেকে বেরই হচ্ছে না তাঁর।

‘ওয়ান লাস্ট ডান্স!’ আর একটিবার! আর একটিবার ঝলক দেখানোর সুযোগ, সুযোগ নিজের জাত চেনানোর। তাও আবার সেই দলের বিপক্ষে, যে দলটা তাঁর জন্মস্থানের—বাংলাদেশের। আর একটিবার তাঁর পায়ের ঝলকে দর্শক মুগ্ধ হলে সেই বাংলাদেশেরই উপকার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য যে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ লড়ে যাচ্ছে প্রাণপণ।

প্রাণপণ লড়ে যাওয়া সেই ছেলেদের কয়েকজনই এসেছে ভারতবর্ষে। তারাও যুদ্ধ করছে। তবে তাদের যুদ্ধটা একটু ব্যতিক্রম। দেশের সত্যিকার অবস্থা যাতে বাকি বিশ্ব জানে, দেশের প্রতি বহির্বিশ্ব যেন সহানুভূতিশীল হয়—এ উদ্দেশ্যে তারা গঠন করেছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। যে ফুটবল দলের কাজ হচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ম্যাচ খেলা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। জয়-পরাজয় এখানে মুখ্য নয়।

সে উপলক্ষেই বিখ্যাত ক্লাব মোহনবাগানের বিপক্ষে একটা ম্যাচ আয়োজিত হতে যাচ্ছে। সে ম্যাচেই মোহনবাগানের সাবেক কিংবদন্তি হিসেবে তাঁকে খেলানোর জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। কারণ অনুমান করা সহজ, তাঁর মতো এককালের মাঠ–কাঁপানো ফুটবলার এই ম্যাচে খেললে, ম্যাচের জৌলুশ বেড়ে যাবে বহু-বহুগুণ। উপচেপড়া দর্শক হবে গড়ের মাঠে। আর যত বেশি দর্শক, তত বেশি টাকা। আর টাকা যত বেশি আসবে, তাঁর মাতৃভূমির ভান্ডার তত বেশি সমৃদ্ধ হবে।

‘স্যার, এই অফিশিয়াল চিঠিটা আপনাকে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে আমাকে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব আপনার জবাব শোনার জন্য। চিঠিটা পড়ে অবশ্যই আমাদের বড়বাবুকে ফোন করে আপনার সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন, আপনার মুখে একটিবার “হ্যাঁ” শোনার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছেন...স্যার, আবারও বলছি। আপনি ওপার বাংলার কিশোরগঞ্জের ছেলে, আর একটিবার যদি আপনি আপনার জন্মভূমির জন্য বুটজোড়া বের করে মাঠে নেমে যান, আপনার জন্মস্থানের মানুষেরই অনেক অনেক উপকার হয়! আরেকটিবার স্যার, ওয়ান লাস্ট ডান্স!’

ছেলেটার কথায় সংবিৎ ফিরল তাঁর। আবারও শুনলেন ছেলেটার কথা মন দিয়ে। আচ্ছা, ছেলেটা কি বুঝতে পেরেছে, ওর ওই ‘ওয়ান লাস্ট ডান্স’—তিনটে শব্দ যে তাঁর মাথায় ঘুরঘুর করছে বেশ ভালোভাবে? না হয় এতবার বলবে কেন?

ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ধীরপায়ে টেলিফোনের দিকে এগোলেন মোহনাবাগানের এককালের মাঠ–কাঁপানো মিডফিল্ডার চুনী গোস্বামী। ঠিক করে ফেলেছেন, কী করবেন।

সে ম্যাচটিতে তূর্য হাজরা নাম নিয়ে খেলেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন।
ছবি: সংগৃহীত

দুই.

গড়ের মাঠে প্রায় হাঁটুসমান পানি। থই থই করছে চারপাশ। ছোটবেলায় এই পানি দেখলে উৎফুল্ল হতেন। খালি গায়ে বন্ধুদের সঙ্গে নেমে যেতেন দাপাদাপি করতে। আহ, সে কী আনন্দ!

সে আনন্দের জায়গায় আজ এসেছে সংশয়, দ্বিধা। প্রায় ২২ বছর পর এই পানি দেখে আজ উৎফুল্ল হতে পারছেন না তিনি। গড়ের মাঠের ওই আকাশের কোনায় জমে থাকা মেঘের মতো তাঁর মনের কোনায়ও জমাট বেঁধেছে সংশয়ের মেঘ। খেলা হবে তো?

গুরুত্ব বিচারে নদীয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের চেয়েও এই ম্যাচটার দাম বেশি। খোদ মোহনবাগান খেলছে যে তাঁদের বিপক্ষে! সেই স্বপ্নের মোহনবাগান, যে মোহনবাগানের চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্না, গোষ্ঠ পাল, শিবদাস ভাদুড়ীদের কীর্তি শুনে শুনে বড় হয়েছেন। আজ ছোটবেলার সেই নায়কদের মধ্যে একজন—চুনী গোস্বামীর সঙ্গে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁদের।

আর বজ্জাত বৃষ্টিটাও এখনই এসে যেন সবকিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে,গড়ের মাঠে এভাবে পানি জমতে থাকলে কীভাবে শৈশবের স্বপ্নপূরণ হবে তাঁর? তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, খেলা না হলে কীভাবে তহবিল জোগাড় হবে দেশের জন্য?

এক মাঠকর্মীর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়ল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুর। ‘দাদা, জল নিয়ে চিন্তা করছেন তো? চিন্তার কিছু নেই। ঘাবড়াবেন না। এ গঙ্গার জল। গঙ্গায় জোয়ার এসেছে তাই এত জল। একটু পরেই নেমে যাবেখন।’

কিছুক্ষণ পর আসলেই পানি নেমে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন পিন্টু। রওনা দিলেন নিজেদের তাঁবুর দিকে। বড় একটা দিন অপেক্ষা করছে তাঁদের সামনে।

ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তি গোষ্ঠপাল সে ম্যাচে হাজির ছিলেন। তাঁর আদি বাড়ি বাংলাদেশে।
ছবি: সংগৃহীত

তিন.

মারদেকা কাপ খেলতে জাতীয় দলের সবাই তখন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। মোহনবাগানের যেসব খেলোয়াড় ভারতের হয়ে খেলেন, তাঁরাও নেই। তাঁদের ছাড়াই দল করেছে মোহনবাগান। তাতে কী? চুনী গোস্বামী তো আছেন! একাই এক শ। তবে নদীয়ার অনুমোদন বাতিল হওয়ার খবর কানে কানে এখানেও পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই ‘মোহনবাগান’ নামে ম্যাচটা খেলতে পারছে না দলটা। খেলবে দলের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় গোষ্ঠ পালের নামে—‘গোষ্ঠ পাল একাদশ’ হিসেবে।

নিজের সময়ে তুখোড় ডিফেন্ডার ছিলেন এই গোষ্ঠ পাল। সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মোহনবাগানে। দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার জাদুকর সামাদ একবার বলেছিলেন, বল নিয়ে সবাইকে কাটাতে তাঁর কষ্ট না হলেও এই গোষ্ঠ পালকে কাটাতে তাঁরও ‘খবর’ হয়ে যায়!

সেই দাপুটে ডিফেন্ডার এখন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। ধুতি মালকোঁচা মেরে চলে এসেছেন এই বৃষ্টির মধ্যে, খেলা দেখতে। প্রধান অতিথি করে আনা হয়েছে তাঁকে। তাঁর আরও একটা পরিচয়, চুনী গোস্বামীর মতো তিনিও বাংলাদেশের সন্তান। দেশের টানে ছুটে এসেছেন তিনিও। তাঁর উপস্থিতিতে যদি টিকিটের বিক্রিবাট্টা একটু হলেও বাড়ে আরকি!

গোষ্ঠ পাল একাদশের আরেক চমক, মোহনবাগানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের কিংবদন্তি তারকা পরিমল দে খেলবেন এই ম্যাচে। চুনী-পরিমলকে একই দলে দেখার আজন্ম সাধ পূরণ হবে অনেকের।

চুনীর অধিনায়কত্বে মাঠে নামল গোষ্ঠ পাল একাদশ। মূল একাদশে আরও ছিলেন বলাই দে, ভবানী রায়, কল্যাণ সাহা, নিমাই গোস্বামী, কাজল ঢালী, প্রবীর মজুমদার, সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার, পরিমল দে, প্রিয়লাল বিশ্বাস ও প্রণব গাঙ্গুলী।

ওদিকে আগের ম্যাচের একাদশ থেকে দুটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে স্বাধীন বাংলা একাদশ। গোলকিপার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির সামনে এস এম আইনুল হক, জাকারিয়া পিন্টু, আলী ইমাম, ফজলে সাদাইন খোকন, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, শাহজাহান আলম, এনায়েতুর রহমান খান, কাজী সালাউদ্দিন ও মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন শেখ। শাহজাহান ও সালাউদ্দিন যথারীতি ছদ্মনামে খেলেছিলেন। সালাউদ্দিনের ডাকনাম তূর্য, সঙ্গে দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরার উপনাম মিলিয়ে এই স্ট্রাইকার তূর্য হাজরা রেখেছিলেন নিজের নাম। ওদিকে শাহজাহান খেলেছিলেন সাগর নামে।

চুনী গোস্বামীর ঝলক আর কাদামাটিতে দেশীয় তারকাদের অনভ্যস্ততার মাশুল হিসেবে সেদিন ৪-২ গোলে হেরে যায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অবশ্য, ম্যাচের ফলাফল এখানে মুখ্য ছিলই না!

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফুটবলের ছিল দারুণ এক অবদান।
ছবি: সংগৃহীত

চার.

ম্যাচ শেষে আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। দূর থেকে ছোট ভাইয়ের মতো ছেলেটাকে দেখছেন চুনী গোস্বামী। একটু আগে তিনিও সাক্ষাৎকার দিয়ে এসেছেন। পিন্টুর চোখেমুখে প্রাপ্তির ঝলক। দেখে বড্ড ভালো লাগছে চুনীর।

আজ তাঁর ভালো লাগারই দিন। সারা জীবন ফুটবল খেলে নাম কামিয়েছেন। আজ সেই ফুটবল খেলেই নিজের জন্মস্থানের স্বাধীনতার লড়াইয়ে একটু হলেও অবদান রাখলেন। জন্মস্থানের জন্য বাড়তি কিছু করার প্রেরণা থেকেই কি না, সেই দুর্দান্ত চুনীর ঝলক দেখেছে আজ গড়ের মাঠের প্রত্যেক দর্শক। সেই আগের মতো বলের কন্ট্রোল, চোখজুড়ানো ড্রিবলিং, মাপা পাসের কারিশমা, ছোট্ট জায়গাতেও দু-তিনজনকে কাটিয়ে থ্রু দেওয়া—চুনী নিশ্চিত করেছেন, প্রত্যেক দর্শকের যেন পয়সা উশুল হয়।

‘দাদা, এবার লিগে আবার নেমে যেতে হবে কিন্তু! শিল্ডে খেলতে হবে। অবসর থেকে ফিরে আসুন, আবার আমরা মাঠে আপনার জাদু দেখতে চাই...’

পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক দর্শকের উৎসুক বার্তার জবাবে মুচকি হাসলেন চুনী। নাহ, লিগ-শিল্ড আর খেলবেন না তিনি। মোহনবাগানের জার্সি গায়ে আর দেখা যাবে না তাঁকে। সেই যে অবসর নিয়েছিলেন, সে সিদ্ধান্তেই থাকবেন অটল।

শুধু একটা লক্ষ্যেই ধুলো পড়া বুটজোড়া জুতার তাক থেকে নামিয়েছিলেন। সে লক্ষ্য পূরণ হয়েছে তাঁর। আজ তিনি পরিতৃপ্ত।

এই ম্যাচটা তাঁর ‘ওয়ান লাস্ট ডান্স’ হয়েই থাকুক না হয়!