স্বপ্নদুয়ার খুলল, ফিফা রেফারি জয়া-সালমা
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেও অনুশীলন থেমে নেই রেফারি সালমা আক্তারের। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কাল বিকেলে যখন সালমা অনুশীলনে ব্যস্ত, বিকেএসপিতে ব্যস্ত ছিলেন জয়া চাকমা। এক দিন আগেই বাংলাদেশের নারী রেফারিদের ইতিহাসে মাইলফলক গড়েছেন দুজন। ২০১০ সাল থেকে ফুটবল মাঠে বাঁশি বাজাচ্ছেন জয়া, সালমার শুরু ২০১৩ সালে। প্রত্যেক রেফারিরই স্বপ্ন থাকে ফিফার তালিকায় নাম লেখানোর। অবশেষে সেই স্বপ্নদুয়ার খুলতে যাচ্ছে জয়া–সালমার। দুজনই হতে যাচ্ছেন ফিফা রেফারি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে ফিফা রেফারি হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণের সর্বশেষ হার্ডলটা পার হতে পেরেছেন দুজনই। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ফিফার তালিকাভুক্ত রেফারি হয়ে যাবেন জয়া ও সালমা। ২০২০ সাল থেকে পরিচালনা করতে পারবেন দেশ-বিদেশে ফিফার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
সবুজে ঘেরা পাহাড়, শুভলং ঝরনা, ঝুলন্ত ব্রিজ কিছুই জয়াকে টানত না। রাঙামাটির মেয়ে জয়ার মন পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা সব সময়ই ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বন্ধুরা যখন ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএস পরীক্ষা দিতে বসছেন, জয়া তখন মগ্ন ফুটবলের নিয়মকানুন শিখতে।
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার জয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনাকারী রেফারি। ২০১০ সালে ফিফার রেফারিংয়ের ‘ক্লাস থ্রি কোর্স’ করেন, ২০১৩ সালে করেন ‘ক্লাস টু কোর্স’। ২০১৬ সালে হন জাতীয় রেফারি। এরপর পরপর দুই বছর ফিফা রেফারির পরীক্ষা দিলেও পাস করতে পারেননি। সালমা জয়ার সঙ্গেই জাতীয় রেফারি হয়েছেন। তিনিও গত বছর ফিফার পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। এবার জয়ার সঙ্গে সাফল্যের হাসি হেসেছেন সালমাও।
আনন্দে পরশু রাতটা সালমার নির্ঘুম কেটেছে। কাল বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বসে বলছিলেন, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে খবরটা শুনে কী যে আনন্দ পেয়েছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। জীবনের একটা বড় লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। রাতে তো ঘুমই হয়নি।’
একই অবস্থা জয়ারও। ঘোরলাগা কণ্ঠে বলছিলেন, ‘শারীরিক যুদ্ধের সঙ্গে অবশেষে একটা মানসিক লড়াইয়েরও অবসান হলো। এখন লড়তে শিখেছি নিজের সঙ্গে। অনেক দিনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে বলে ভীষণ আনন্দিত।’
২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নিয়মিত রেফারিং শুরু জয়ার। এরপর একে একে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পরিচালনা করেছেন শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও তাজিকিস্তানে। ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। জয়া বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে পরিচালনা করেছেন মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের ম্যাচ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ৩৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন।
জয়ার পরিচয় আছে আরও একটি। বর্তমানে বিকেএসপির নারী ফুটবল দলের কোচ তিনি। তবে স্বপ্নটা আপাতত রেফারিংকে ঘিরেই, ‘আমার প্রথম লক্ষ্যই থাকবে যেন ফিফার এলিট প্যানেলে ঢুকতে পারি।’ এর বাইরে মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন নিয়েও কাজ করতে চাই। সেটা কোচিং বা রেফারিং যেটাই হোক না কেন।’ মেয়েদের ফুটবল অঙ্গনে নিজেকে আইকন হিসেবে দেখতে চান জয়া, ‘বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলার সংস্কৃতিটা বদলে দিতে চাই আমি। মেয়েরা এখন পেশা হিসেবে রেফারির কাজ করতে পারবে, কোচও হতে পারবে। এখন দরজাটা উন্মুক্ত হয়ে গেল মেয়েদের জন্য। আগে মেয়েরা ফুটবল খেলত না, এখন খেলে। আগে মহিলা রেফারি ছিল না, এখন হয়েছে। আগে নারী কোচ ছিল না, এখন হয়েছে। তার মানে এখন মেয়েদের মধ্যে একটা আস্থা চলে আসবে যে খেলাধুলা শেষ করলেই ক্যারিয়ার শেষ নয়। আরেকটা ক্যারিয়ার তাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে।’
জয়ার মতো জাতীয় দলের ফুটবলার ছিলেন না নেত্রকোনার সালমা। শুরুতে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। জেলা পর্যায়ে কিছুদিন খেলেছেন। প্রতিবেশী বড় ভাই ফেরদৌস হাসানের অনুপ্রেরণায় যোগ দেন রেফারিং কোর্সে, ‘ফেরদৌস ভাই বলতেন মেয়েদের রেফারি খুব কম। চেষ্টা করে দেখো। আমি রেফারিং কোর্সের প্রথম পরীক্ষায় পাস করি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।’
ইডেন কলেজের ছাত্রী সালমা ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপ, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্ট ও বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে ১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে সহকারী রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা যে রকম দাপিয়ে খেলছে, সেটাই সালমার বড় অনুপ্রেরণা, ‘মেয়েদের ফুটবলের চিত্রটা আগে ভিন্ন ছিল। এখন মেয়েরা ভালো করছে। এ জন্য আমরাও ভালো ভালো টুর্নামেন্টে বাঁশি বাজানোর সুযোগ পাচ্ছি।’
একসময় প্রতিবেশীরা সালমার বাবাকে ডেকে বলতেন, ‘আপনার মেয়ে ঢাকায় গিয়ে কী করে! কেন সে এভাবে ছেলেদের মতো ট্রাউজার–শর্টস পরে মাঠে নামে?’ দিন বদলেছে। সালমা এখন নেত্রকোনার গর্ব। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বসেই স্বপ্ন দেখেন বিশ্বকাপে বাঁশি বাজানোর, ‘অনেক লড়াই আর কঠোর পরিশ্রম করে নিজের একটা স্বপ্ন সত্যি করেছি। এখন স্বপ্ন বাংলাদেশের হয়ে একদিন বিশ্বকাপে ম্যাচে বাঁশি বাজাব।’