ভুটানের বর্তমান রাজা জিগমে খিসার ওয়াংচুকের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে। এটা বছর তিনেক আগের কথা। ভুটানিদের কাছে দিনটি ছিল উৎসব-আনন্দে ভরপুর এক উপলক্ষ। এই স্টেডিয়ামে ভুটানের জাতীয় খেলা আর্চারিও হয় নিয়মিত। নিখুঁত নিশানায় এখানে লক্ষ্যভেদ করেন তিরন্দাজরা।
চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে এবার লক্ষ্যভেদ করল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। ভারতের পুনে এফসিকে হারিয়ে কিংস কাপের শিরোপা জিতল তারা প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির নিখুঁত সমন্বয় ঘটিয়ে। সেটিও টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে। চোখ যখন চূড়ায়, তখন আর আটকায় কে! শেখ জামাল সতি৵ই দেশের বাইরে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপনই হয়ে উঠেছে এখন।
থিম্পুর তীব্র ঠান্ডা আর উচ্চতাজনিত সমস্যা জয় করার গল্পও এটি। পাহাড়ের কোলে স্টেডিয়াম, বাতাসের বেগ অনেক বেশি। তাপমাত্রা কাল নেমে গিয়েছিল তিন ডিগ্রিতে। হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও ভুটানের ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টটির চতুর্থ ট্রফিটা যখন হাতে নিচ্ছিলেন শেখ জামালের খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা, শীত নয়; উষ্ণ হাওয়াই যেন বইছিল।
থিম্পুর দর্শকদেরও তা ছুঁয়ে গেছে। গ্যালারিতে ভুটানিদের লাফঝাঁপ দেখে কে বলবে, শেখ জামাল ভিন দেশের একটা ক্লাব! ম্যাচের পর ঢাকার টিভি রিপোর্টার গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে যখন পিটিসি দিচ্ছিলেন, আশপাশে হাজারো ভুটানি নাচতে নাচতে ভি চিহ্ন দেখাচ্ছেন!
এই দর্শকদের আসলে মন জয় করেছে প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়নরা। নইলে অন্য দেশের একটা ক্লাবের জন্য কেন এভাবে গলা ফাটানো! ‘দ্য চ্যাম্পিয়ন’, ‘দ্য চ্যাম্পিয়ন’ বলেও স্লোগান তুলেছে কুয়াশাভেজা সন্ধ্যায়। ফাইনালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড ঠান্ডাকে কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি ভুটানের ফুটবল আমুদে এই জনতা।
বিধাতাও মনে হয় চাননি এমন সন্ধ্যায় তাদের হতাশ করতে। নইলে যে ইয়াছিন গোল আটকানোর কাজেই ব্যস্ত থাকেন, সেই তিনিই কিনা এদিন জয়সূচক গোলদাতা! ঘরোয়া ফুটবলে গত দু-তিন বছরে এই ডিফেন্ডার গোলটোল করেছেন কিনা মনে করা কঠিন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তো গোল তাঁর কাছে আকাশের চাঁদের মতোই একটা বস্তু। সবাইকে চমকে সেটিই এদিন তাঁর হাতের মুঠোয়।
২৫ মিনিটে ওয়েডসনের কর্নারে হেডটা করেই ছুট কর্নার পতাকার দিকে। পোস্ট থেকে বল কুড়িয়ে আনলেন পুনের গোলরক্ষক (১-০)। ফাইনালের মতো স্নায়ুযুদ্ধে ওয়েডসন সুযোগ পেয়েও গোল নষ্ট করলেন, স্বার্থপরের মতো নিজেই গোল করতে চাওয়ায় ২-০ করা যায়নি।
তাতে কি! অতিরিক্ত সময়ে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জামাল ভূঁইয়ার লাল কার্ডও জয় কেড়ে নিতে পারেনি। চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি পুনে, দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরেও রানার্সআপ হয়েই খুশি থাকতে হয়েছে আই লিগে গতবার সপ্তম হওয়া দলটিকে।
বলা হচ্ছে, গত ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার আইএফএ শিল্ড জিততে না পারার দুঃখ ভুলেছে শেখ জামাল। প্রতিটি টুর্নামেন্টই কিন্তু আলাদা। তার পরও শিল্ড হতাশার পর দেশের বাইরে আনন্দময় একটা টুর্নামেন্ট কাটাতে পারাও তো শুধু শেখ জামালের জন্য নয়, গোটা দেশের ফুটবলকেই আন্দোলিত করার জন্য যথেষ্ট।
মনজুর কাদেরের কথা বলতেই হচ্ছে। শেখ জামাল সভাপতি টাকা বিলান দেদার। এই টুর্নামেন্টে গ্রুপপর্বে মোহনবাগানকে ৫-৩ গোলে হারানোর পর ১০ হাজার ডলার পুরস্কার আগেই দিয়েছেন। সেমিফাইনালে থাইল্যান্ডের রাতচাসিমার সঙ্গে জেতার পুরস্কার ১০ হাজার ডলার দিয়েছেন কাল সকালে। খেলোয়াড়দের এ সময় বলেছেন, ফাইনাল জিতলে আরও বড় বোনাস এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নাকি পুরস্কার দেবেন। ফাইনাল জয়ের পর ফোনে বলছিলেন, ‘এই ট্রফি বলছে এখন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে ছড়ি ঘোরাচ্ছি আমরাই।’
কথাটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে শেখ জামাল দেশের বাইরে বেশ ভালোই করছে। মানের দিক থেকে ভুটানের কিংস কাপ একেবারে হেলাফেলার নয়। আশির দশকে ভুটানের ফেডারেশন কাপ আস্তে আস্তে রূপ নিয়েছে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক গোল্ডকাপে, যেটি ২০০১ সালে এসে হয়েছে কিংস কাপ।
২০০৪ সালে দ্বিতীয়বার হয়ে দীর্ঘ বিরতি পড়ে এই টুর্নামেন্টের যাত্রাপথে। গতবার তা ফিরিয়ে এনে টানা দুটি টুর্নামেন্ট করতে পারল ভুটান ফুটবল ফেডারেশন। ভুটান পারলে বাংলাদেশ পারে না কেন এমন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে? শেখ জামালের সাফল্য তুলে দিচ্ছে এমন প্রশ্নও।