‘শুধু প্রার্থনাই করতে পারি যেন আমাদের ওপর বোমা না পড়ে’
কেউ প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন পাশের দেশে, কেউবা এখনো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আর কেউ হয়তো উপায় না পেয়ে ঘরেই স্বেচ্ছাবন্দী, প্রার্থনায় দিন গুনছেন। কিন্তু যে অবস্থায়ই থাকুন, গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সৈন্যরা আক্রমণ করার পর থেকেই ইউক্রেনে বসবাস করা মানুষের প্রতিমুহূর্ত কাটছে আশঙ্কায়।
ইউক্রেনের ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের সাবেক পর্তুগিজ কোচ পাওলো ফনসেকার জন্যও তো পরিস্থিতি একই! রুশ সৈন্যরা কিয়েভের বিমানবন্দর অচল করে দেওয়ায় শহর ছেড়ে যেতে পারেননি তিনি। পর্তুগালের দৈনিক জোর্নাল দে নোতিসিয়াসের সঙ্গে আলাপে তাঁর শঙ্কা, ভয় আর প্রার্থনায় দিনাতিপাতের চিত্র তুলে ধরেছেন ৪৮ বছর বয়সী পর্তুগিজ।
১৯৯১ সালে শুরু ১৪ বছরের খেলোয়াড়ি জীবন তো বটেই, ২০০৫ সালেই শুরু কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম ১১ বছরও ফনসেকা কাটিয়েছেন পর্তুগালেই। ২০১৩-১৪ মৌসুমে পোর্তোর কোচ ছিলেন, তবে পর্তুগালে কোচ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়েছে ২০১৫-১৬ মৌসুমে ব্রাগার দায়িত্ব নিয়েই তাদের পর্তুগিজ কাপ জেতানোয়।
তাঁর ওপর নজর পড়ে শাখতারের। নিজেদের কিংবদন্তি কোচ মিরতিয়া লুসেস্কু ক্লাবে ১২ মৌসুম কাটিয়ে রাশিয়ার জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গে যাচ্ছিলেন, সে জায়গায় ফনসেকাকে নেয় শাখতার।
যে তিন মৌসুম কোচিং করিয়েছেন শাখতারকে, লুসেস্কুর অভাব দারুণভাবেই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন ফনসেকা। তিন মৌসুমের প্রতিটিতেই লিগ ও কাপ জিতিয়েছেন, ২০১৭-১৮ চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোতে নিয়ে গেছেন শাখতারকে, সেবার গ্রুপ পর্বে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটিকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল ফনসেকার শাখতার!
শাখতার ছেড়ে এরপর রোমাতেও দুই মৌসুম কোচিং করিয়েছেন, তবে ২০২১ সালের জুনের পর থেকে বেকারই আছেন ফনসেকা। তবু কিয়েভেই বসবাস ছিল তাঁর। শুধুই শাখতারের টানে? না, সেখানে যে মনের টানও আছে তাঁর।
ফনসেকার স্ত্রী ইউক্রেনিয়ান। এক সন্তানও আছে এই দম্পতির। বৃহস্পতিবার রুশ সৈন্যরা যখন কিয়েভে হামলা চালাচ্ছে, ফনসেকা, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে তখন কিয়েভেই ছিলেন। আর বের হতে পারেননি কিয়েভ থেকে।
‘আজকের জন্য ফ্লাইট বুক করা ছিল আমার, কিন্তু এখন এখান থেকে বেরোনো আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বিমানবন্দরগুলো অচল করে দেওয়া হয়েছে, আকাশপথে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে’—গতকাল কিয়েভের এক হোটেল থেকে পর্তুগিজ পত্রিকাটিকে বলেছেন ফনসেকা। শুধু ফনসেকাই নন, শাখতারের প্রত্যেক ফুটবলারই ওই হোটেলে আছেন!
আকাশপথে সম্ভব না হলে সড়কপথেও তো চেষ্টা করা যায়, কিন্তু যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় সেটিও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। বিশদ জানিয়েছেন ফনসেকা, ‘এই মুহূর্তে কিয়েভ ছাড়তে হলে সেটি শুধু সড়কপথেই সম্ভব, সবাই সেই চেষ্টাই করছে। পোল্যান্ডের সীমান্তের কাছের শহর লাভিভে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু (সবাই-ই গাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করায়) রাস্তা পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে। কারণ, একসঙ্গে এত গাড়ি তো রাস্তায় কুলানো সম্ভব নয়। রাস্তায় আটকে থাকা গাড়ির সারি অনেক লম্বা হয়ে গেছে। তার ওপর গাড়ি যে চলবে, গ্যাসেরই তো জোগান নেই!’
সব মিলিয়ে তাই এখন একটাই পথ খোলা ফনসেকাদের সামনে—প্রার্থনা। অসহায় ফনসেকা বলছিলেন, ‘আমরা এখন শুধু যা করতে পারি তা হলো প্রার্থনা করা, যেন আমাদের ওপর বোমা না পড়ে। সত্যি বলছি, আমি জানি না, এখান থেকে কীভাবে বেরোতে পারব!’
বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তের অভিজ্ঞতাও এখনো ভুলতে পারেন না ফনসেকা, ‘পাঁচবার বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙে আমার। জীবনের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের দিন এটা!’ দুঃস্বপ্নটা আরও লম্বাই হচ্ছে। কখন শেষ হবে তার ঠিক নেই।
ফনসেকা তাই প্রার্থনায়, ‘আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই। শুধু আশাই করতে পারি, যাতে আমরা ভাগ্যবান হতে পারি—ইউক্রেন থেকে বের হওয়ার মতো, এই যুদ্ধ পেছনে ফেলার মতো ভাগ্যবান।’