ছবি আঁকা সহজ কাজ নয়। প্রখর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। ক্যানভাসে তুলির আঁচড় কোত্থেকে ঠিক কতটুকু দিলে ছবিটা ফুটবে, তা বুঝতে হয় শিল্পীকে।
মিডফিল্ডারদেরও বুঝতে হয়। মাঠটা যদি হয় সবুজ ক্যানভাস, মিডফিল্ডাররা তো একেকজন চিত্রকরই। পাস এতটুকু এদিক–সেদিক হওয়ার উপায় নেই, নইলে ‘ছবি’টা ফুটবে না। আবার সেই পাসের মধ্যেও কত রকম বৈচিত্র্য—চিত্রকরেরা যত উপায়ে তুলি ধরেন আরকি।
কখনো বুট আড়াআড়ি করে, কখনো–বা ডগা দিয়ে, আবার কখনো বুটের ভেতর কিংবা বাইরের পাশ দিয়ে—একেকটি টানে একেকটি ছবি, কোনোটা নিখুঁত, কোনোটা হয় না।
তাই বলে পছন্দের ‘ছবি’ আঁকা তো থেমে নেই। আজ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও নিশ্চয়ই দেখা যাবে তেমন সব ছবি। আর সেসব চিত্রকলার মাঝে দর্শকেরা নিশ্চয়ই একটি ‘ছবি’ খুঁজবেন—বুটের বাইরের অংশের আঁচড়ে আঁকানো বাঁকানো পাসের ছবি।
দুই দলেই এমন চিত্রকরসংখ্যা একাধিক। তবু লুকা মদরিচ ও থিয়াগো আলকানতারার দিকেই চোখটা একটু বেশি থাকবে। খুব স্বাভাবিক। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সময় ফ্লোরেন্সে চিত্রকর কিংবা ভাস্কর কম ছিল না। তবু সমসাময়িকদের মধ্যে ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো ও রাফায়েলকে কেন একটু অন্য চোখে দেখেন সবাই?
বুটের বাইরের অংশ ব্যবহার করে লিভারপুলের ট্রেন্ট–আলেক্সান্দার আর্নল্ড, মোহাম্মদ সালাহ থেকে রিয়াল মাদ্রিদের টনি ক্রুস কিংবা কাসেমিরোও পাস দিতে জানেন। তবু মদরিচ ও আলকানতারার পাসে যেন আলাদা কোনো সৌরভ থাকে—কে জানে, দুই দলের মধ্যে আসল ‘ট্রিভেলা’ হয়তো শুধু তাঁরাই আঁকতে জানেন।
ট্রিভেলা? পর্তুগিজ শব্দ। বুটের বাইরের অংশের ব্যবহারে দেওয়া পাসের ফুটবলীয় পরিভাষা। এ কাজে মোটামুটি কিংবদন্তি তকমা পাওয়া রিকার্ডো কারেসমার ব্যাখ্যা, বলের বাঁ পাশের কোনায় বুটের বাইরের অংশ দিয়ে শুধু আঘাত করলেই হবে না, ঘাসের ওপর কিংবা বাতাসে কতটুকু বাঁক (স্পিন) চাচ্ছেন সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। মদরিচ ও আলকানতারা বোধ হয় বাকিদের চেয়ে এখানেই এগিয়ে। ‘ছবি’ তো শুধু আঁকলেই হবে না, নিখুঁতও হতে হয়।
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের আগে শুধু এই পাস কচলানোর কারণ আছে। এবারের মৌসুমে এই পাসটা বেশ কয়েকবার মদরিচ ও আলকানতারার পায়ে ফুটেছে। চেলসির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগ নিশ্চয়ই মনে আছে?
গোটা ম্যাচে অনেকবারই এই পাস দিয়েছেন মদরিচ। কিন্তু সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সবুজ ক্যানভাসে আসল ‘ছবি’টা এঁকেছেন ম্যাচের ৮০ মিনিটে। মদরিচ ডান পায়ের খেলোয়াড়। বাঁ প্রান্ত থেকে বক্সে বলটা ঠিক জায়গায় ফেলতে হলে তুলনামূলক দুর্বল পায়ের পাসে হয়তো পারতেন না। তাই বেকায়দা পজিশন থেকেও ডান পা ব্যবহার করতে হচ্ছিল।
বুটের বাইরের অংশের ব্যবহারে বল সুইং করিয়ে রদ্রিগোর পায়ের ওপর যে পাসটা তিনি দিয়েছিলেন, দেখে মনে হয়েছে চামচে করে রসগোল্লা তুলে দিলেন! রদ্রিগোর শুধু গেলার অপেক্ষা এবং সেটি হওয়ার পর দুই লেগ মিলিয়ে সমতায় ফিরেছিল রিয়াল।
মদরিচের সেই পাস দেখে বিটি স্পোর্টসের ফুটবল–পণ্ডিত ও সাবেক ডিফেন্ডার রিও ফার্ডিনান্ড ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন, ‘লুকা মদরিচের পাস দেখে আমি বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেছি! এটা অবৈধ! লুকা, মুকা যে নামই হোক—কিছু একটা বলে চেঁচাচ্ছিলাম, কী অসাধারণ পাস!’ টকস্পোর্ট ব্রেকফাস্টের উপস্থাপক অ্যালি ম্যাকোয়েস্ট বলেছিলেন, ‘আমরা সম্ভবত এই দশকের সেরা পাসটা দেখে ফেললাম।’
আজ রাতের ম্যাচটা যেহেতু ফাইনাল, ৯০ মিনিটের ভগ্নাংশ সেকেন্ড সময়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন ম্যাচে এমন সব পাস পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, যা ঠেকানোর পূর্বপরিকল্পনা থাকে না ডিফেন্ডারদের।
এফএ কাপ সেমিফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্ডারদেরও এমন পাস ঠেকানোর পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। থিয়াগো আলকানতরা মাঝমাঠ থেকে সালাহকে যে অবিশ্বাস্য ‘ট্রিভেলা’ পাস দিয়েছিলেন, তার জবাব ছিল না সিটি ডিফেন্ডারদের কাছে।
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে দুই লেগেও ‘ট্রিভেলা’ ফুটেছে আলকানতার পায়ে। লিভারপুল মাঝমাঠের সেরা এই বল–প্লেয়ার আজ নিশ্চয়ই বিদ্যাটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইবেন।
লিগের শেষ ম্যাচে পাওয়া চোট থিয়াগোর মাঠে নামা নিয়ে যদিও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছিল। মদরিচের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তাই বেশি। রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি তাঁর মাঝমাঠের প্রাণভোমরাকে বাইরে রেখে একাদশ গড়বেন না।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, দুই মিডফিল্ডারের ‘ট্রিভেলা’ পাস দেওয়ার ধরনে কিছুটা পার্থক্য আছে। আলকানতারা ভার্সেটাইল খেলোয়াড়—‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ সব পারেন। রক্ষণ, বল কাড়া, লম্বা থ্রু পাস থেকে খেলা তৈরি করা তাঁর জানা।
সে ক্ষেত্রে আলকানতারাকে হয়তো থ্রু ‘ট্রিভেলা’ পাস দিতে দেখা যাবে বেশি—ডান পায়ের নিচু বাঁকানো পাস, যার ঠিকানা হবেন ডান উইংয়ে থাকা সালাহ। বাতাসে খেলাতে হলে আরেকটু ওপরে উঠতে হবে। কারণ, সেটা হবে রিয়ালের গোলমুখ খোলার পাস—গায়ে ব্রাজিলিয়ান রক্ত থাকায় কৌশলটা সহজাত।
ক্রোয়াট মিডফিল্ডার মদরিচ খানিকটা ব্যতিক্রম। পুরো মাঠে খেললেও রিয়ালের আক্রমণ তৈরির সময় মদরিচকে বক্সের আশপাশে বেশি দেখা যায়। সেখান থেকে বুটের বাইরের অংশ দিয়ে পাস দিলে ডান উইংয়ে থাকা মার্কো আসেনসিও কিংবা রদ্রিগো যে–ই থাকুক, তাঁকে আটকানো চ্যালেঞ্জ হবে লিভারপুলের জন্য। কিংবা আরেকটি কৌশলও দেখা যেতে পারে।
ডান প্রান্ত থেকে ‘ট্রিভেলা’ পাসে বাঁ উইংয়ে থাকা ভিনিসিয়ুসকে বক্সে নিয়ে আসা—বল যেহেতু বাঁক খেয়ে ভেতরে ঢুকবে ভিনির ডান পা ব্যবহারে জন্য সুবিধাই হবে। তবে অসুবিধাটা তখনই, যদি বাতাসে ভালো পারফর্ম করতে পারেন লিভারপুল ডিফেন্ডাররা। একই কথা খাটে রিয়ালের ডিফেন্ডারদের জন্যও। তবু একটা ‘কিন্তু’ থাকে, আর সেটাই গড়তে পারে পার্থক্য।
বক্সে ডিফেন্ডারদের জটলার মধ্যেও ঈপ্সিত খেলোয়াড়কে খুঁজে নেন মদরিচ ও আলকানতারা। চেলসি কিংবা সিটির বিপক্ষে এটাই দেখা গেছে। সতীর্থ খেলোয়াড় দৌড়ে এসে ঠিক কোথায় বল পাবেন, সেটা পাসটা দেওয়ার আগেই চোখের মাপে ঠিক হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো কোচের কাছেই এই দক্ষতার প্রতিষেধক নেই।
মদরিচ ও আলকানতারা ঠিক এই কাজটায় বাকিদের চেয়ে দক্ষ হওয়ায় (অন্তত এই মৌসুমে) আজ ফাইনালে তাঁদের বুটের ডগার ওপাশের ‘তুলি’ আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে—সে ক্ষেত্রে দুই দলের সমর্থকদেরই লাভ।
একটা নিখুঁত পাস দেখার আনন্দ তো কখনো–সখনো গোলকেও ছাপিয়ে যায়। আর সেই পাসটা যদি হয় চোখজুড়ানো ‘ট্রিভেলা’ এবং সেখান থেকে গোল—তাহলে তো পয়সা উশুল!