২৮ মে প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। ভালোবাসার শহর কাকে বরমাল্য দেয়, সেটা জানতে এখন সবার অধীর অপেক্ষা। এই ফাইনাল উপলক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ আয়োজন। প্রথম দুই পর্বে স্মরণীয় পাঁচ ফাইনালের পর এবার থাকছে চ্যাম্পিয়নস লিগে এই মৌসুমের দুই ফাইনালিস্ট রিয়াল মাদ্রিদ আর লিভারপুলের গৌরবগাথা। এই পর্বে লিভারপুল...
আগামী মৌসুমে নটিংহ্যাম ফরেস্ট প্রিমিয়ার লিগে উঠবে কি না, এখনো নিশ্চিত নয়। আগামী রোববার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টায় চ্যাম্পিয়নশিপের প্লে-অফে হাডার্সফিল্ডকে হারালেই প্রিমিয়ার লিগে উঠে যাবে ফরেস্ট। তাতে লিভারপুলের একটা গর্ব চূর্ণ হবে!
কী গর্ব, সেটি না বলে দিলে অবশ্য লিভারপুলের সমর্থকেরও হুট করে মাথায় চলে আসবে বলে মনে হয় না। গর্বটা এই, সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমেও প্রিমিয়ার লিগের বাকি সব মিলিয়ে যত চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে, লিভারপুলের একাই তত চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার রেকর্ড ছিল। নটিংহ্যাম ফরেস্ট প্রিমিয়ার লিগে উঠে গেলে আগামী মৌসুমে রেকর্ডটা আর লিভারপুলের থাকবে না, তা আগামী শনিবার প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে নিজেদের সপ্তম চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেও নয়।
একদিক থেকে ভাবলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে লিভারপুলের পার্থক্যটা হয়তো পরিষ্কার হবে এই তথ্যে যে, রিয়াল মাদ্রিদ যেখানে এবার ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্নে ঝাঁপাবে, ইংল্যান্ডের সব দল মিলিয়েই এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে ১৪ বার। তবে ইউরোপে রিয়াল মাদ্রিদ তো রিয়াল মাদ্রিদ, ব্যাপ্তিটা ইউরোপ থেকে কমিয়ে শুধু ইংল্যান্ডে আবদ্ধ রাখলে লিভারপুলকেই হয়তো বলতে হয় ‘ইংল্যান্ডের রিয়াল মাদ্রিদ’।
কেন? কারণটা লুকিয়ে নটিংহ্যাম ফরেস্টের প্রিমিয়ার লিগে ওঠা না–ওঠার সঙ্গে লিভারপুলের ‘গর্ব’ চূর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গে। ইউরোপিয়ান কাপ বলুন বা নাম আর ছক বদলের পর চ্যাম্পিয়নস লিগ, লিভারপুল এ পর্যন্ত শিরোপা জিতেছে ৬টি—রিয়াল মাদ্রিদ ও এসি মিলানের (৭টি) পর টুর্নামেন্টের ইতিহাসে যৌথভাবে বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে যে ২০টি দল ছিল, তার মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের রেকর্ড আছে শুধু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (৩টি), চেলসি (২টি) আর অ্যাস্টন ভিলার (১টি)। বাকি তিন ক্লাব মিলে জেতা চ্যাম্পিয়নস লিগের সংখ্যা এক লিভারপুলের সমান।
আগামী মৌসুমে নটিংহ্যাম ফরেস্ট প্রিমিয়ার লিগে উঠে গেলে লিভারপুল ছাড়া অন্য দলগুলোর সম্মিলিত চ্যাম্পিয়নস লিগের সংখ্যা হয়ে যাবে ৮টি। ‘কখনো ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ না হওয়া সর্বকালের সেরা ইংলিশ কোচ’ ব্রায়ান ক্লফের অধীনে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে টানা দুবার ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) জিতেছিল কিনা!
ক্লফ যখন নটিংহ্যাম ফরেস্টকে নিজের ছাঁচে গুছিয়ে নিচ্ছেন, সে সময়েই লিভারপুলের প্রথম ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পাওয়া। রোমের স্তাদিও অলিম্পিকোর ফাইনালে বব পেইসলির লিভারপুল ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয় বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখকে।
প্রথমটি পেতে দেরি, দ্বিতীয় শিরোপার জন্য মোটেও অপেক্ষায় থাকতে হয়নি লিভারপুলকে। পরের বছরই আবার ইউরোপিয়ান কাপ অ্যানফিল্ডে নিয়ে এলেন ডালগ্লিশ-সাউনেসরা।
মাঝে ক্লফের নটিংহ্যামের দুই বছরের ইউরোপ শাসনের পর আবার লিভারপুলের দাপট। ১৯৮১ সালের সেই শিরোপার পথে ফাইনালে লিভারপুল কাকে হারিয়েছিল? রিয়াল মাদ্রিদ! ফাইনালটা কোথায় হয়েছিল জানেন? প্যারিস! দুই বছর বিরতি দিয়ে আবার ইউরোপিয়ান কাপ লিভারপুলের ঘরে। এবার রোমে গিয়ে রোমাকেই হারিয়ে আট বছরে চতুর্থ ইউরোপিয়ান কাপ লিভারপুলের!
এরপর এল ১৯৮৫। লিভারপুলের পতনের শুরু! সেবারও ফাইনালে উঠেছিল লিভারপুল, ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়ামে শিরোপার পথে ডালগ্লিশ-রাশদের শিরোপার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে জুভেন্টাস। কিন্তু ফাইনাল হবে কি, ম্যাচের আগে স্টেডিয়ামে লিভারপুল সমর্থকদের একটি অংশ শুরু করে দাঙ্গা। জুভেন্টাস সমর্থকদের দিকে তেড়ে যায়।
পরে জানা যায়, ওই লিভারপুল সমর্থকদের বেশির ভাগই মাতাল ছিলেন! তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে গ্যালারির দেয়ালের দিকে পেছাতে থাকেন জুভেন্টাস সমর্থকেরা, কিন্তু কতটুকু আর পেছাবেন? ভারে এক সময় দেয়ালটা ভেঙে যায়। প্রায় ৩৯ জন প্রাণ হারান—বেশির ভাগই জুভেন্টাস আর ইতালিয়ান সমর্থক, আহত ৬০০ জন।
ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে এমন ঘটনার পরও সেদিন ম্যাচটা হয়েছিল, ফাইনালে ১-০ গোলে হেরে যায় লিভারপুল। তার চেয়েও বড় শাস্তি অপেক্ষায় ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে ইংলিশ ক্লাবগুলোকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্ট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়, অন্য ক্লাবের চেয়ে লিভারপুলকে আরও দুই বছর বেশি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
পরে যদিও অন্য ইংলিশ ক্লাবের জন্য নিষেধাজ্ঞাটা ১৯৯০-৯১ মৌসুমে তুলে নেওয়া হয়, লিভারপুলের বাড়তি শাস্তিও দুই বছর কমিয়ে আনা হয় এক বছরে।
কিন্তু ইউরোপিয়ান ফুটবলে ফিরলেও লিভারপুলের ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ফিরতে ফিরতে লেগে গেছে অনেক বছর। ২০০৫ সালে স্টিভেন জেরার্ডে অনুপ্রাণিত এক অবিশ্বাস্য ফাইনাল লেগেছে লিভারপুলের পঞ্চম চ্যাম্পিয়নস লিগের অপেক্ষা ফুরাতে। ধারে-ভারে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা এসি মিলান প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল, ইস্তাম্বুলে সেই ফাইনালে সেখান থেকেই অবিশ্বাস্যভাবে ৩-৩ সমতা ফিরিয়ে টাইব্রেকারে শিরোপা জেতে লিভারপুল!
এরপর আবার ঘুম! ১৪ বছরের লম্বা ঘুম। মাঝে অবশ্য ২০০৭ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে, সেখানে এসি মিলান প্রতিশোধ নিয়েছে। এরপর ইয়ুর্গেন ক্লপ ক্লাবে যাওয়ার পর প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগে গিয়েই ২০১৮ সালে ফাইনালে ওঠে লিভারপুল। কিন্তু শিরোপা জেতা হয়নি। ফাইনালে হেরেছে কোন দলের কাছে? রিয়াল মাদ্রিদ!
সের্হিও রামোসের কড়া ট্যাকলে মো সালাহর চোটে পড়া, গোলকিপার লরিস কারিয়াসের অবিশ্বাস্য দুই ভুলের মূল্য দিয়ে লিভারপুল হেরেছে ৩-১ গোলে।
পরের বছর মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ফাইনালেই আবার শিরোপা জিতেছে লিভারপুল। কিন্তু মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ফাইনাল জেতা আর ফাইনালে মাদ্রিদকে হারানোর তৃপ্তি তো এক নয়!
এবার সে তৃপ্তি পেলে ‘ইংলিশ রিয়াল মাদ্রিদ’ ইউরোপে শিরোপার বিচারেও সত্যিকারের রিয়াল মাদ্রিদের পরেই জায়গা করে নেবে!
লিভারপুলের ৬ শিরোপা
১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮১, ১৯৮৪, ২০০৫ ও ২০১৯।
দশকে দশকে পথচলা
১৯৫০: অংশ নেয়নি
১৯৬০: খেলেছে – ২ আসরে, শিরোপা – ০
৬৪/৬৫ সেমিফাইনাল
৬৬/৬৭ দ্বিতীয় রাউন্ড
১৯৭০: খেলেছে – ৫ আসরে, শিরোপা – ২
৭৩/৭৪ দ্বিতীয় রাউন্ড
৭৬/৭৭ বিজয়ী
৭৭/৭৮ বিজয়ী
৭৮/৭৯ প্রথম রাউন্ড
৭৯/৮০ প্রথম রাউন্ড
২০০০: খেলেছে – ৭ আসরে, চ্যাম্পিয়ন – ১
০১/০২ কোয়ার্টার ফাইনাল
০২/০৩ প্রথম গ্রুপ পর্ব
০৪/০৫ বিজয়ী
০৫/ ০৬ শেষ ষোলো
০৬/০৭ ফাইনাল
০৭/০৮ সেমিফাইনাল
০৮/০৯ কোয়ার্টার ফাইনাল
২০১০: খেলেছে – ৫ আসরে, শিরোপা – ১
০৯/১০ গ্রুপ পর্ব
১৪/১৫ গ্রুপ পর্ব
১৭/১৮ ফাইনাল
১৮/১৯ বিজয়ী
২০২০: খেলেছে – ২ আসরে, শিরোপা ০
১৯/২০ শেষ ষোলো
২০/২১ কোয়ার্টার ফাইনাল
২১/২২ ?