লি টাক, মাসিহ, সনি নর্দেরা কেন বাংলাদেশে থাকে না
সাম্প্রতিক কালে ঘরোয়া ফুটবলে বিদেশিদের মধ্যে আলোচিত ছিলেন লি টাক, মাসিগ সাইগানি ও সনি নর্দে। কিন্তু আলো ছড়ানোর পরেই বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশের ক্লাবে গিয়ে নাম লিখিয়েছেন তাঁরা।
‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’—২০১৬-১৭ মৌসুমে আবাহনীর হয়ে বাংলাদেশের ফুটবল মাতিয়ে যাওয়া ইংলিশ ফুটবলার অ্যান্ড্রু লি টাকের ব্যাপারে কথাগুলো খুব যায়। সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করা যায়, ‘আবার চলেও গেলেন!’ মাত্র এক মৌসুম খেলেই মন জয় করেছিলেন ফুটবলপ্রেমীদের এবং সে বছরই চলে গেছেন। যাঁরা নিয়মিত বাংলাদেশের ফুটবল অনুসরণ করেন, এ মিডফিল্ডারের পায়ের জাদু তাঁদের মনে থাকার কথা। সেই লি টাক চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ খেলতে এসে আবার বাংলাদেশ মাতিয়ে দিয়ে চলে গেলেন আজ। এবার তাঁর গায়ে ছিল মালয়েশিয়ার ক্লাব তেরেঙ্গানু এফসির জার্সি।
পুরো টুর্নামেন্টটাই ছিল ইংলিশ লি টাকময়। তাঁর নেতৃত্বে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তেরেঙ্গানা। ব্যক্তিগতভাবে টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পুরস্কারও উঠেছে তাঁর হাতে। এতে যেন দেশের ফুটবলপ্রেমীদের কষ্টটা গিয়েছে আরও বেড়ে। ইশ্, তিন বছর আগে আবাহনী লিমিটেডের জার্সিতে খেলে যাওয়া এই ফরোয়ার্ড যদি বাংলাদেশের ক্লাবের হয়ে এখনো খেলতেন!
সাম্প্রতিক সময়ে লি ছাড়া বিদেশিদের মধ্যে আলো ছড়িয়েছেন আফগানিস্তানের ডিফেন্ডার মাসিহ সাইগানি, হাইতিয়ান ফরোয়ার্ড সনি নর্দে। কিন্তু আলো ছড়ানোর পরই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন তাঁরা। লি, মাসিহ, সনিরা কেন বাংলাদেশে থাকে না? পেশাদার ফুটবলে খেলোয়াড়েরা দল বদল করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধুই কি অর্থ, নাকি এর সঙ্গে জড়িত আছে আরও কিছু। আবাহনী কেন ছেড়েছিলেন লি? আগে সে কারণটাই শোনা যাক তাঁর মুখ থেকে, ‘সত্যি বলতে কি, আবাহনী ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। প্রস্তাবটা ছিল অনেক ভালো।’
শুধু যে ভালো সম্মানীর জন্যই তাঁরা অন্যত্র চলে যান, তা নয়। আফগান ডিফেন্ডার মাসিহর কথায় ধরুন। তিনি ভালো পরিবেশে খেলতে চান বলেই আবাহনীতে শেষ মৌসুম খেলে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্লাব চেন্নাইয়িন এফসিতে। আবাহনীর এএফসি কাপের বড় নায়ক ছিলেন মাসিহ। ডিফেন্ডার হয়েও খেলেছেন ফরোয়ার্ডের মতো, ছয় ম্যাচে দলের হয়ে সর্বোচ্চ তিন গোল করে এই আফগান ডিফেন্ডার এএফসি কাপের গ্রুপ পর্ব উতরে দিয়েছেন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নদের। অথচ এফসি কাপের দ্বিতীয় পর্বের আগেই তিনি নাম লিখিয়েছেন চেন্নাইতে। দলের সেরা তারকাকে ধরে না রাখতে পারাটা আকাশি-নীল কর্তাদের জন্য ব্যর্থতা বটে।
কিন্তু মাসিহই বা কেন আবাহনী ছেড়েছিলেন? ‘অবশ্যই সম্মানীটা বড় ব্যাপার। তবে আমি ভালো পরিবেশে খেলতে চাই। অনুশীলন ও ম্যাচের জন্য ভালো মাঠ থাকবে, গ্যালারিভর্তি দর্শক থাকবে। চেন্নাইয়িনের এ বিষয়গুলোই আমাকে আকৃষ্ট করেছে।’
লি, সাইগানিরা তবু আলোচনা করে ক্লাব ছেড়েছেন। তাঁদের আগে তো সনি নর্দে একপ্রকার বাধ্য হয়ে মিথ্যা কথা বলেই বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন। সহজেই ভুলে যাওয়ার কথা নয় হাইতিয়ান এই ফুটবলারের কথা। শেখ রাসেল ও শেখ জামালের জার্সিতে দুই মৌসুম খেলেছিলেন ঢাকায়। দুর্দান্ত গতি ও ড্রিবলিংয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে। তাঁর ফুটবল কারিকুরি দেখতে স্টেডিয়ামে দর্শক সমাগমও গিয়েছিল বেড়ে। সনির গায়ে উঠে গিয়েছিল ঢাকার মাঠে খেলা অন্যতম সেরা বিদেশির তকমাও।
কিন্তু এই বেশি ভালো খেলাটাই ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াল শেখ জামালের! জামালের হয়ে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আইএফ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েই হাইতিয়ান এই প্লেমেকারের ওপর নজর পড়ে কলকাতার ক্লাবগুলোর। পরে ২০১৪ সালে শেখ জামাল থেকে মোহনবাগানে পাড়ি জমান তিনি। খেলোয়াড় এক ক্লাব ছেড়ে আরেক ক্লাবে যাবেন, পেশাদার ফুটবলে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মোটেও স্বাভাবিক ছিল না সনির বাংলাদেশ ছাড়ার গল্পটা। নিয়েছিলেন মিথ্যার আশ্রয়। শেখ জামাল থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন। সেই যাওয়াই শেষ, আর ফেরেননি জামালের এ ‘পোস্টার বয়’। পরে জানা গেল, মোহনবাগানে নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশি ফুটবল সমর্থকদের মন জয় করা সনি।
গত বছর প্রতিবেশী ভারত থেকেও বিদায় নিয়েছেন সনি। তবে প্রতিবেশী দেশ থেকে তাঁর বিদায়ের দৃশ্যটা আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যেই সনি ঢাকা ছেড়েছিলেন মিথ্যা বলে, সেই সনিই ভারত ছেড়েছেন অশ্রুসিক্ত হয়ে। তাঁকে বিদায় দিতে এসে একাধারে কেঁদেছেন সমর্থকেরা, শিশুর মতো কেঁদেছেন সনি নিজেও। আসলে ভারত ছাড়তে চাননি। হাঁটুর চোটের কাছে হার মানতে হয় তাঁকে। কিন্তু সনির কান্নার সেই দৃশ্যটাই বলে দেয় দুই দেশ ছাড়ার ফারাকটা কোথায়।