রোমাঞ্চের রাত শেষে মেসির জাদুকরি ভোর
ইউরো ও কোপা আমেরিকা নিয়ে রসিকতা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটি মন্তব্য এমন, ‘ইউরো হচ্ছে কাচ্চি বিরানি, আর কোপা হচ্ছে কাচ্চির ভেতর আলু।’
এতে লাতিন ফুটবলপ্রেমীরা নাখোশ হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে একটা বিষয় আছে। বিপক্ষে গেলেই তা হয়ে ওঠে কঠিন বাস্তব। খেলায় উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিচারে লাতিন ফুটবলপ্রেমীদের জন্য মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের বাস্তবতা কাচ্চির তুলনায় আলুর মতোই। সমবেদনা।
যদিও কাল রাত এসব সহমর্মিতার ধার ধারেনি। সে কথায় পরে আসছি। কোপার বড় ম্যাচগুলো সাধারণত ভোরের আলো ফোটার পর শুরু হচ্ছে। ইউরোর মারমার কাটকাট খেলা দেখে তখন চোখ এমনিতেই ঢুলুঢুলু। এরপর ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার পাঁড় ভক্তরা জেগে থাকেন দুই চোখ কচলে, চোখে পানি ছিটিয়েও হয়তো।
অবশ্য চোখে পানিটা এমনিতেই চলে আসে যখন তাঁরা দেখেন, মাঠে বল একটানা পাঁচ মিনিটও থাকছে না। ফাউলের ছড়াছড়ি। বল পায়ে লাতিনদের সৃষ্টিশীল সৌরভও গায়েব! আর গ্যালারিও? যেন ‘হরর’ সিনেমার খাঁ খাঁ প্রান্তর।
বাজে খেলা দেখে গ্যালারির দর্শকেরা দুয়ো দেবেন, তা দেখে কষ্ট করে জেগে থাকা টিভির দর্শকেরাও নিজেদের পাশে লোকবল পাওয়ার আত্মতৃপ্তি পাবেন, সে সুযোগটুকও নেই। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে কোভিড তা কেড়ে নিয়েছে। একেবারে নীরব–নিথর মৃত্যুপুরীর মতো মাঠে কোপার ম্যাচগুলো কারও কারও কাছে চোখের জন্যও ক্ষতিকর।
মাঠের কথা না–ইবা বলা হলো। ব্রাজিলের এবড়োখেবড়ো মাঠগুলো নিয়ে খোদ তাদের দেশেরই সবচেয়ে বড় তারকা নেইমার অভিযোগ তুলেছেন। ব্রাজিল কোচ তিতে এর আগে অভিযোগ তুলে জরিমানা গুনেছেন। ওদিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আরেক মহাদেশে যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই চলছে, সেখানে আরেক বড় তারকা টাইব্রেকারে চাপ সইতে না পেরে পেনাল্টি মিস করে ক্ষমা চাচ্ছেন।
দুই মহাদেশের ফুটবলে পার্থক্য বোঝাতে এটুকু–ই তো যথেষ্ট!
কিন্তু কথায় আছে, গেম ইজ আ গ্রেট লেভেলার—মানে, খেলাধুলা সবাইকে সমান কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। দুই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উত্তেজনা বিচারে সেই কাতার এখনো অসমান। তবু কাল রাতটা অন্তত অনুভূতির জায়গায় এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে দর্শকদের।
সকালে সবাই বেশ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঘুমোতে গেছেন। বুঝিয়ে বলছি। রাত ১০টা থেকে প্রায় ভোর ৪টা পর্যন্ত চলল ইউরোর পাগল করা প্রদর্শনী—আশ্চর্য, অত্যাশ্চর্য...যা বলতে চান বলতে পারেন, তবু বোধ হয় কিছু কম বোধ হয়!
প্রায় ছয় ঘণ্টাব্যাপী দুটি ম্যাচের সারমর্ম হতে পারে এমন—নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ২৪০ মিনিটে ১৪ গোল, গতি, সৌন্দর্য, চাপ, পাল্টা চাপ, ভুল আর কামব্যাক। দুটি ম্যাচেই ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প।
সেটি কেমন তা বুঝিয়ে দেবে পরিসংখ্যান—ইউরোর ইতিহাসে কোনো দল কাল রাতের আগে ম্যাচে ৮০ মিনিটের পর একাধিক গোলে পিছিয়ে পড়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমতায় ফিরতে পারেনি। যে ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি, সেটাই এক রাতে একবার নয়, দু–দুবার ঘটল! টানা দুই ম্যাচে–ই! প্রথমে ক্রোয়েশিয়া তারপর সুইজারল্যান্ড। ক্রোয়াটরা অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে ভেঙে পড়েছে, আর সুইজারল্যান্ড?
বড় টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে টাইব্রেকার এমনিতেই ভীষণ চাপের। সুইজারল্যান্ড বড় টুর্নামেন্টে এর আগে কখনোই তা জিততে পারেনি। কিন্তু কাল টান টান উত্তেজনার শেষ অঙ্কে সুইসদের এ জয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে দর্শকদের। এমনকি ফ্রান্স জিতলেও রাতটা কেউ ভুলতে পারত না। সেখানে সুইসরা জিতেছে এই টুর্নামেন্টে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কাছ থেকে মহাতারকার ‘ব্যাটন’টা যাঁর নেওয়ার কথা ছিল, সেই কিলিয়ান এমবাপ্পের পেনাল্টি মিসে!
না, ইউরোর সঙ্গে মোটেও তুলনা নয়। বিষয়টিকে এভাবে দেখা যায়, ইউরোর দুটি ম্যাচের সব উত্তেজনা, রোমাঞ্চ পেট পুরে ভোজনের পর কোপার শেষ পাতে দুচামচ দই তুলে দিয়ে হজমে সাহায্য করেছেন লিওনেল মেসি।
বলিভিয়ার বিপক্ষে ৪–১ গোলের জয়ে লিওনেল মেসি রেকর্ড ভেঙেছেন, নিজে জোড়া গোলের পাশাপাশি একটি গোলও করিয়েছেন। সব মিলিয়ে দেখার মতো ফুটবল খেলেন আর্জেন্টাইন তারকা। সেই দেখায় চোখের মণি হয়ে থাকবে বলিভিয়ান গোলরক্ষক কার্লোস লাম্পের মাথার ওপর দিয়ে করা তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর লব। গোল!
একটা রাত, সেই রাতে, কেউ করল প্রায়শ্চিত্ত—স্পেনের আলভারো মোরাতার গোল মিসের ব্যর্থতা কাটিয়ে অতিরিক্ত সময়ে করা গোল, স্প্যানিশ গোলরক্ষক উনাই সিমনও আত্মঘাতী গোলের পর গোল ঠেকিয়েছেন—কেউ আবার টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিস করায় তাঁর দেশের (বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন) বিদায় ঘটল, আবার সেই রাতেরই শেষ আখ্যানে কেউ বুঝিয়ে দিলেন, ২৮ বছরের শিরোপাখরা ঘোচাতে এই এবড়োখেবড়ো মাঠেও ‘ফুল’ ফোটাতে পারেন।
হ্যাঁ, রোমান্টিক রাতই বটে! যেখানে কারও বুকে সুখের ব্যথা বাজে, কারও আবার বিরহ দহন লাগে!