রিয়ালে ১৮ মাসে ২ গোল, রিয়াল ছাড়তেই ২৮ মিনিটে ২
গত নভেম্বর থেকে তাঁকে মাঠে নামাননি জিনেদিন জিদান। একদিকে রিয়াল মাদ্রিদ গোলের জন্য হাপিত্যেশ করছে, অন্যদিকে এমন একজন স্ট্রাইকারকে মাঠের বাইরে রেখেছেন রিয়াল কোচ জিদান—প্রশ্নটা তখনই ঠারেঠোরে উঠেছিল।
লুকা ইয়োভিচকে শেষ পর্যন্ত তিন দিন আগে ধারে অন্য ক্লাবে পাঠিয়ে দিয়েছে রিয়াল। অন্য ক্লাব বলতে যে-সে ক্লাব নয়, যে ক্লাবে আলো ছড়িয়ে রিয়ালের নজর কেড়েছিলেন ইয়োভিচ, সেই জার্মান ক্লাব আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টেই পাঠিয়েছে। ধারের মেয়াদ এই মৌসুমের শেষ পর্যন্ত। উদ্দেশ্য, চেনা আবহে ফিরে গিয়ে যেন ছন্দ আর আত্মবিশ্বাস ফিরে পান ইয়োভিচ। রিয়ালে যেটি সার্বিয়ান স্ট্রাইকারের ছিল না বললেই চলে।
রিয়ালের সে উদ্দেশ্য সফল, তবে জিদানকে নিয়ে প্রশ্নও উঠছে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে ইয়োভিচের প্রথম ম্যাচের পর। চার দিন আগেই মাদ্রিদ থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে তাঁর ধারের চুক্তি হয়েছে, গতকাল প্রথম মাঠে নেমেছেন ২৩ বছর বয়সী সার্বিয়ান স্ট্রাইকার। নেমেই গোল করেছেন। মাঠে ছিলেন ২৮ মিনিট, তাতে একটি নয়, দুটি গোল ইয়োভিচের! অথচ রিয়ালে গত দেড় মৌসুমে তাঁর গোল ছিল দুটি!
প্রশ্নটা তাই তুলছেন অনেকে—তবে কি জিদানের কৌশলই ইয়োভিচের গোল না পাওয়ার পেছনে দায়ী?
অবশ্য সেটার পাল্টাও দেওয়া যায়। জিদানের কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না বলে এবার মৌসুমের শুরুতে গ্যারেথ বেলকেও তো তাঁর পুরোনো ক্লাব টটেনহামে ধারে পাঠিয়েছে রিয়াল, কিন্তু জোসে মরিনিওর কৌশলের সঙ্গেও তো মানিয়ে নিতে পারেননি ওয়েলশ ফরোয়ার্ড। দুদিন আগে মাদ্রিদভিত্তিক স্প্যানিশ দৈনিক ‘মার্কা’র প্রতিবেদনে এসেছে, মরিনিও নাকি টটেনহামের অনুশীলনে বেলকে শাসিয়েছেন এই বলে, ‘তুমি কি এখানে খেলতে চাও, নাকি মাদ্রিদে ফিরে গিয়ে বেঞ্চে বসেই সময় কাটাতে চাও?’
বেল যেখানে ব্যর্থ, ইয়োভিচ সেখানে শুরুতেই করেছেন বাজিমাত। শালকের বিপক্ষে লিগের ম্যাচে কাল তাঁকে একাদশে রাখেননি ফ্রাঙ্কফুর্ট কোচ আদি হুটের। নিজেদের মাঠে শুরু থেকেই ম্যাচে দাপট ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টের, পর্তুগাল জাতীয় দলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সতীর্থ আন্দ্রে সিলভার গোলে ২৮ মিনিটে এগিয়েও যায় দলটা। কিন্তু এক মিনিট পরই শালকে সমতায় ফেরে তাদের নতুন আমেরিকান সেনসেশন ম্যাথিউ হপের গোলে। এরপর মিনিট যায়, প্রথমার্ধ শেষ হয়ে দ্বিতীয়ার্ধেরও ১৫ মিনিট পেরিয়ে যায়, কিন্তু দাপটটাকে গোলে পরিণত করতে পারছিল না ফ্রাঙ্কফুর্ট।
দলটার কোচ হুটেরের চোখ যায় বেঞ্চে, ৬২ মিনিটে মাঠে নামান ইয়োভিচকে। চেনা স্টেডিয়াম, ঘাসগুলোও হয়তো তাঁকে চেনে এখানে—সার্বিয়ান স্ট্রাইকার হয়তো প্রথম মিনিট থেকেই নিজ ঘরে ফেরার অনুভূতিই পাচ্ছিলেন। এই ফ্রাঙ্কফুর্টের জার্সিতেই তো ২০১৮-১৯ মৌসুমে চোখধাঁধানো ফুটবল খেলে রিয়ালের নজরে পড়েছিলেন ইয়োভিচ। সেবার ৪৮ ম্যাচে ২৭ গোল করেছিলেন সার্বিয়ান স্ট্রাইকার, করিয়েছিলেন আরও ৭টি।
ওদিকে রিয়াল তখনো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে হারানোর ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে রোনালদো রিয়াল ছেড়ে জুভেন্টাস গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতো করে মৌসুমে গোটা পঞ্চাশেক গোল না হোক, অন্তত ২৫-৩০ গোল করার মতো এক করিম বেনজেমা ছাড়া আর কাউকে পাচ্ছিল না রিয়াল। তাই চোখ পড়ল ইয়োভিচের দিকে। কম নয়, একেবারে ৬ কোটি ইউরো খরচ করে তাঁকে নিয়ে আসেন রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। উদ্দেশ্য, বেনজেমার বিকল্প হিসেবে, কিংবা মাঝে মাঝে বেনজেমার সঙ্গী হয়েই রিয়ালে গোল ফেরাবেন ইয়োভিচ।
হলো কী? কাঁচকলা! রিয়ালে ১৮ মাসে ৩২ ম্যাচে ১০১৪ মিনিটে মাত্র দুই গোল করতে পারলেন ইয়োভিচ। অর্থাৎ প্রতি ৫০৭ মিনিটে এক গোল! সঙ্গে করোনাভাইরাস ইউরোপে প্রথম দফা আঘাত হানার পর লকডাউনের নিয়ম ভেঙে বেশ বিতর্কেও এসেছেন বারবার। অথচ কাল ফ্রাঙ্কফুর্টের জার্সিতে ফিরে সেই ইয়োভিচই অন্য রূপে! তাঁর পুরোনো সেই রূপে, যে রূপ দেখে মোহিত হয়েছিল রিয়াল। ৬২ মিনিটে নামার ১০ মিনিট পরই ফ্রাঙ্কফুর্টকে ম্যাচে কাল এগিয়ে দেওয়া গোলটি করলেন ইয়োভিচ, এরপর যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে আবার! ২৮ মিনিটে দুই গোল, অর্থাৎ প্রতি ১৪ মিনিটে একটি! রিয়ালের সঙ্গে যেন আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
শুধু রিয়ালেই গোল পেতে ঝামেলা হতো ইয়োভিচের, সার্বিয়া জাতীয় দলে কিন্তু ঠিকই গোল পেয়েছেন। ফ্রাঙ্কফুর্টের জার্সিতে কালকের দুই গোল মিলিয়ে ক্লাব আর সার্বিয়া জাতীয় দলে সর্বশেষ চার ম্যাচে পাঁচ গোল ও দুই অ্যাসিস্ট ইয়োভিচের, এর একটিও রিয়ালের জার্সিতে নয়।
রিয়াল–ভক্তদের একদিকে ইয়োভিচকে ফর্মে ফিরতে দেখে হয়তো ভালো লাগছে। ধারের মেয়াদ শেষে রিয়ালে ফিরে ছন্দ আর আত্মবিশ্বাসটা ইয়োভিচ এবার ধরে রাখতে পারলে তো রিয়ালেরই লাভ! কিন্তু ইয়োভিচের ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরেই এভাবে গোল পাওয়া রিয়াল ভক্তদের একটু হতাশও করবে। গোল করার মতো একজন যে রিয়ালেরও এখন খুব দরকার। মৌসুমে সব মিলিয়ে ২৫ ম্যাচে এবার মাত্র ৪২ গোল করেছে রিয়াল, অর্থাৎ ম্যাচপ্রতি গড়ে ১.৭টিও নয়!
রিয়াল আর জিদানকে অবশ্য একটু খোঁচা কাল ফ্রাঙ্কফুর্টও মেরেছে। ইয়োভিচ দুই গোল করার পরই জার্মান ক্লাবটি তাদের স্প্যানিশ সংস্করণের টুইট অ্যাকাউন্টে লিখেছে, ‘ওকে শুধু মাঠে খেলার সুযোগ করে দেওয়াই দরকার...। ঘরে ফেরাটা কী দারুণই না হলো, লুকা!’ জিদান তাঁকে রিয়ালে সব সময় সুযোগ দিতেন না, সেদিকেই কি ইঙ্গিত করল টুইটটি?
তা যা-ই হোক, ইয়োভিচ নিজেও অবশ্য দারুণ খুশি। ইনস্টাগ্রামে নিজের অনুভূতি সার্বিয়ান স্ট্রাইকার জানিয়েছেন এভাবে, ‘অসাধারণ অনুভূতি! জয় এসেছে, দুই গোল করেছে, এর চেয়ে ভালোভাবে (পুরোনো ক্লাবে) ফেরার কথা ভাবতেও পারতাম না। আশা করি এটা মাত্রই শুরু হলো, সেরাটা এখনো আসার বাকি। সমর্থনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।’