রিয়াল-বার্সা শাস্তি পেলে ‘পালিয়ে যাওয়া’ ৯ ক্লাবকে দেখে নেবেন পেরেজ
যেন চরম নাটকীয়তায় ভরা কোনো টিভি সিরিজের চিত্রনাট্য। গোপন আঁতাত আছে এতে, বিদ্রোহের নামে নিজ স্বার্থে সমাজকে ঠকানোর পরিকল্পনা আছে, এরপর আবার তথাকথিত বিদ্রোহীদের মধ্যে কারও আঁতাত থেকে সরে যাওয়ার টুইস্ট আছে। কিন্তু নাটক এখানেই শেষ হলে তো সরলীকরণ হয়ে যায়! আঁতাত টিকিয়ে রাখা পক্ষের মনে হচ্ছে, বিদ্রোহ ছেড়ে যারা চলে যাওয়া পক্ষগুলো আসলে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা কোণঠাসা বটে, তবে তারা ক্ষুব্ধও।
এবার পক্ষগুলো মিলিয়ে নিন। টিভি সিরিজটার জায়গায় ধরে নিন ইউরোপিয়ান সুপার লিগকে। সেখানে গোপন আঁতাত করেছিল ১২টি ক্লাব। বাকি ৯ ক্লাব চলে গেলেও পরিকল্পনার মূল হোতাদের মধ্যে তিন ক্লাব বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাস এখনো সুপার লিগের পরিকল্পনা আঁকড়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে কাল বাকি ৯ ক্লাবকে সুপার লিগ ছেড়ে আসায় উয়েফা ঘোষণা দিয়েছে, এই ৩ ক্লাবও সুপার লিগের পরিকল্পনা বাতিল করে ফিরে না এলে তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া হবে।
এতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বটে, তবে বিষাক্ত সাপের মতো এখন ফণা তুলে কামড় বসানোর পরিকল্পনাও নাকি আঁটছেন সুপার লিগের পরিকল্পনার অন্যতম কুশীলব, সুপার লিগের প্রস্তাবিত কমিটির চেয়ারম্যান ও রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। উয়েফা সত্যি সত্যিই রিয়াল-বার্সা-জুভেন্টাসকে শাস্তি দিলে নাকি সুপার লিগ ছেড়ে পালানো বাকি ৯ ক্লাবকে দেখে নেবেন, এমনটাই জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস।
সুপার লিগের আয়োজনের পেছনে আরও বেশি অর্থ পাওয়ার লোভই সবচেয়ে বড় কারণ। সে কারণেই ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে পরিকল্পনা ক্লাবগুলো এঁটে আসছে আরও চার থেকে পাঁচ বছর আগ থেকে। এর মধ্যে করোনা আসায় আর্থিকভাবে আরও নাজুক হয়ে পড়েছে ক্লাবগুলো। কিন্তু টুর্নামেন্টটার উদ্দেশ্য ও ধরনই একে গ্রহণযোগ্যতা পেতে দেয়নি।
১২টি ক্লাব এমনভাবে খেলতে চেয়েছে, যেখানে তাদের কখনো সুপার লিগ থেকে অবনমন হবে না। প্রতি মৌসুমেই তাদের টুর্নামেন্টটিতে খেলাও নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে নিজ নিজ লিগে শিরোপার বাইরে বড় ক্লাবগুলোর আর চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু থাকত না। এখন যেমন ইউরোপের শীর্ষ লিগে প্রতি মৌসুমে সেরা চারে থেকেই পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিতে হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজই না থাকলে ফুটবলের আর মজাই-বা কী থাকত!
কিন্তু অর্থলোভে অন্ধ ক্লাবগুলো সেদিকটা যেন পাত্তাই দেয়নি। কিংবা দিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে রাখার কোনো পরিকল্পনা তারা কখনো জানায়নি। ইউরোপজুড়ে লিভারপুল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসির মতো সুপার লিগে যেতে চাওয়া ক্লাবগুলোর সমর্থকেরাই তাই সবার আগে বিদ্রোহী লিগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানিয়ে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। এর মধ্যে উয়েফা-ফিফার মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো জানিয়ে দেয়, এই বিদ্রোহী লিগে গেলে শাস্তি পেতেই হবে।
দুদিকের চাপের ফল, প্রথমে ইংল্যান্ডের ছয় ক্লাব আর পরে আতলেতিকো মাদ্রিদ আর ইন্টার মিলানের সরে আসা। এসি মিলান ভুল স্বীকার করলেও তাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল, সেখানে কোথাও তারা সুপার লিগ থেকে নাম কাটানোর ঘোষণা সরাসরি দেয়নি। আর বার্সা-রিয়াল-জুভ তো ‘সুপার লিগই ফুটবলের ভবিষ্যৎ’, কথাটার ব্যাখ্যা না দিলেও কথাটা বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছে।
কিন্তু বাকি আট ক্লাব সরে আসায় যুদ্ধে উয়েফার অবস্থায় শক্তিশালী হয়। কাল উয়েফার বিবৃতি থেকে বোঝা গেল, এসি মিলানও আনুষ্ঠানিকভাবে উয়েফার কাছে আনুগত্য স্বীকার করেছে। এই ৯ ক্লাবকে মৃদু শাস্তি দিয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছে উয়েফা। পাশাপাশি বিবৃতিতে কাল উয়েফা সভাপতি আলেক্সান্দর সেফেরিন জানিয়েছেন, বাকি তিন ক্লাব ফিরে না এলে তাদের কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
সেফেরিনের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা না যেতেই মাদ্রিদভিত্তিক স্প্যানিশ দৈনিক এএস জানাচ্ছে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনের কথা। সেখানে লেখা, উয়েফা সত্যি সত্যিই তিন ক্লাব অর্থাৎ রিয়াল, বার্সা ও জুভকে শাস্তি দিলে তখন রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আর চুপ থাকবেন না। সুপার লিগ ছেড়ে যাওয়া বাকি ৯ ক্লাবকে আইনি উপায়ে জরিমানা করার দিকে যাবেন পেরেজ।
এর আগেও খবর এসেছিল, সুপার লিগের পরিকল্পনার সময়ে ক্লাবগুলো টুর্নামেন্ট থেকে নাম না সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা ‘অলঙ্ঘনীয় চুক্তি’তে সই করেছিল, যেটা না মানলে প্রতিটি ক্লাবকে ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি ইউরো জরিমানা গুনতে হবে। পেরেজ এখন চুক্তির সেই শর্ত কাজে লাগাতে চাইছেন বলেই অনুমান।
গতকাল এক বিবৃতিতে বার্সা, রিয়াল ও জুভেন্টাস অভিযোগ করেছে, বাকি ৯ ক্লাব জনসমক্ষে সুপার লিগ ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে ‘টুর্নামেন্টটির ভিত্তি স্থাপন করা সমঝোতা দৃষ্টিকটুভাবে ভেঙেছে’ এবং ‘অনেক বড় ক্ষতি করেছে, যে ক্ষতির পরিমাণ শুধু বাড়ছেই।’ তবে নিউ ইয়র্ক টাইমসই লিখেছে, ১২টি ক্লাবের ৯টিই ছেড়ে যাওয়ায় সুপার লিগই অবলুপ্ত হয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে আইনি লড়াইয়ে পেরেজরা কতটুকু সফল হবেন তা দেখার বিষয় বটে।
এ ক্ষেত্রে এসি মিলানের ওপর বেশি খেপতে পারে রিয়াল, বার্সা ও জুভেন্টাস। গতকাল মার্কা এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সুপার লিগের গঠনতন্ত্রেই নাকি লেখা ছিল, ১২টির মধ্যে ৯টি ক্লাব চলে গেলেই কেবল সুপার লিগ অবলুপ্ত হবে, ৮টি ক্লাব গেলেও সুপার লিগ অন্তত কাগজে-কলমে টিকে থাকবে। কাল উয়েফার বিবৃতি আসার আগপর্যন্ত এসি মিলান আনুষ্ঠানিকভাবে সুপার লিগ ছাড়েনি বলেই জানত সবাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসি মিলানও উয়েফার আনুগত্য মেনে নেওয়ায় এখন রিয়াল-বার্সা-জুভ আরও কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা।
তবে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, পেরেজ তবু বাকি ৯ ক্লাবকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা তো করেই যাবেন, পাশাপাশি ইউরোপের আদালতে এটাও নাকি প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে উয়েফা এখন যে ঢঙে ইউরোপের ফুটবল চালাচ্ছে, সেটা ক্লাবগুলোর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। উয়েফার পরিচালনার ধরন প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই যুগে ‘মুক্ত ব্যবসায়ের’ নিয়মের সঙ্গে যায় না, এমনটাই বোঝাতে চায় বার্সা-রিয়াল-জুভেন্টাস।