রিয়াল না লিভারপুল—বাংলাদেশের কোচ-ফুটবলারদের চোখে কারা এগিয়ে?
লিভারপুলকে তাহলে ট্রফিটা দিয়ে দিলেই হয়! কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। ফাইনালে তাদের লড়তে হবে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে। কিন্তু এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে লিভারপুলের দিকেই পাল্লাটা ভারী দেখছে বাংলাদেশের ফুটবল মহল।
ইউরোপ–সেরার লড়াইয়ে কারা ফেবারিট? এই প্রশ্নে বাংলাদেশের শীর্ষ স্তরের সাতজন কোচ ও ফুটবলারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রত্যেকেই এগিয়ে রাখছেন লিভারপুলকে। ‘রিয়াল মাদ্রিদ ভালো দল’, ‘ফাইনালে যেকোনো কিছুই হতে পারে’ ইত্যাদি বলার পর সবার মুখে অভিন্ন সুর—শেষ হাসি হাসতে পারে লিভারপুলই।
সেটি শুধু লিভারপুলের আক্রমণভাগের শক্তি দেখে নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা দলটাকেই এগিয়ে রাখছেন বাংলাদেশের ফুটবলবোদ্ধাদের বেশির ভাগ। যদিও কঠিন একটা ম্যাচই হবে মনে করছেন তাঁরা। কারণ, দুই দলই আক্রমণে খুব ভালো। তবে তুল্যমূল্য বিচারে দেশের শীর্ষ কোচ-ফুটবলারের অনেকেরই বিশ্বাস, ট্রফি থেকে যেতে পারে ইংল্যান্ডেই।
এবার রিয়ালের বিপক্ষে লিভারপুলকে এগিয়ে রাখার ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ সাইফুল বারী টিটু বলছেন, ‘দুই দলেরই মান খুব ভালো, আক্রমণে যেতে পছন্দ করে দুই দলই। তবে চুলচেরা বিচারে লিভারপুল বেশি আক্রমণাত্মক। অনেক টিম যেমন গুটিয়ে থাকে, রয়েসয়ে খেলে, লিভারপুল তেমন নয়। তারা প্রেস করে এবং দ্রুত আক্রমণে চলে যায়। ওরা আক্রমণ তৈরি করতে ভালোবাসে, যা তাদের এগিয়ে রাখছে।’
দুই উইংব্যাকের অতি সক্রিয়তায় আজকের লিভারপুল দুর্দান্ত এক দলে পরিণত হয়েছে, বলছেন সাইফুল বারী। রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। খুব কার্যকরী এক ফুটবলার। তিনি ৪টি গোল করিয়েছেন এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে। আলেক্সান্ডার-আরনল্ড অনেক সময় ১০ নম্বর পজিশনে চলে যান এবং প্রতিপক্ষ সীমানায় বল দেওয়া-নেওয়া করেন। লিভারপুলের লেফটব্যাক রবার্টসনও ওভারল্যাপ করেন। ফলে লিভারপুলের দুই উইংব্যাককে সামলানো কঠিন হতে পারে রিয়ালের জন্য।
লিভারপুলের আক্রমণের গভীরতা বেশি দেখছেন সাইফুল বারী। কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ দলটা এমনভাবে তৈরি করেছেন যে বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা অনবরত মাঠের ১১ জনের ওপর চাপ দিয়ে যান। অর্থাৎ খারাপ খেললেই বাদ পড়তে হবে। ফলে দল হিসেবে লিভারপুল ভালো করছে।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, রিয়াল মাদ্রিদ ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে প্রতিপক্ষকে। সেটা এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগেই দেখা গেছে একাধিকবার। পিএসজি, চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে অনেকটা সময় পর্যন্ত বোঝাই যায়নি রিয়াল পরের রাউন্ডে যাবে। কিন্তু তারা পরের রাউন্ডে গেছে। এখানেই রিয়ালের জাদু। কোচ কার্লো আনচেলত্তি অসম্ভব শান্ত মেজাজের। ঘোর বিপদেও তিনি মাথা ঠিক রেখে কাজ করে যান, বলছেন সাইফুল বারী।
সাইফুল বারীর কথা, ‘রিয়ালে আক্রমণে ভিনিসিয়ুসের গতি দারুণ। করিম বেনজেমার সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া খুব ভালো। এবার বেনজেমার পাওয়া গোলের বেশ কয়েকটি ব্রাজিলিয়ান তারকার পাসে। সুতরাং তাঁদের দুজনের ওপর বাড়তি নজর রাখতে হবে লিভারপুলকে। আমি বলব, এই জুটিকে আটকাতে না পারলে বিপদ আছে লিভারপুলের।’
তবে সাইফুলের মতে, বিশ্বের সেরা দুটি ক্লাব এখন ম্যান সিটি আর লিভারপুল। ইউরোপ তো বটেই, বিশ্বের সেরা লিগ অবশ্যই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। লিভারপুল দৌড়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত সিটির সঙ্গে পারেনি এবার। ১ পয়েন্টের ব্যবধান ঘুচিয়ে হতে পারেনি চ্যাম্পিয়ন। সেই দুঃখ ভুলতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তারা একটু বেশি ঝাঁপাবে বলে মনে করেন ঘরোয়া ফুটবলে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের বিদায়ী কোচ সাইফুল বারী।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালটা একটু অন্য রকম। বেশির ভাগ সময়ই এখানে উঁচু মেজাজের ফুটবল হয়। গতি থাকে অনেক বেশি। ফলে এই ফাইনাল জমজমাট হবে বলেই আমার বিশ্বাস
ওদিকে স্প্যানিশ লিগে রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় বেশ আগেই। সেদিক থেকে দেখলে এই ফাইনাল এক লিগ চ্যাম্পিয়ন আর আরেক রানার্সআপের লড়াইও। তবে বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক কোচ মারুফুল হক এই ফাইনালে সেই ব্যাপার দেখছেন না। কারণ, চ্যাম্পিয়নস লিগ ভিন্ন মঞ্চ এবং এর মেজাজই আলাদা। সাইফুলের মতো মারুফও এগিয়ে রাখছেন লিভারপুলকে। লিভারপুলের আক্রমণভাগের গভীরতার কারণেই।
মারুফুল বলছেন, ‘লিভারপুলের আক্রমণই শুধু ভালো নয়, পুরো দলটাই খুব ভালো। খেলার স্টাইলেও ওরা এগিয়ে থাকবে। সালাহর ওপর একটু বেশিই চোখ রাখব। সে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।’
তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাস আর ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছেন না মারুফুল, ‘রিয়াল বড় টুর্নামেন্টে বরাবর ভালো করেছে। ওদের আক্রমণও ভালো নম্বর পাবে। সুতরাং আপনি রিয়ালকে পিছিয়ে রাখতে পারবেন না। তারপরও দিন শেষে বলব, এই ফাইনালে লিভারপুলের সম্ভাবনাই বেশি।’
মারুফুলের মতে, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে অনেক সময়ই হিসাবি ফুটবল হয়। দুই দলই রয়েসয়ে খেলে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালটা একটু অন্য রকম। বেশির ভাগ সময়ই এখানে উঁচু মেজাজের ফুটবল হয়। গতি থাকে অনেক বেশি। ফলে এই ফাইনাল জমজমাট হবে বলেই আমার বিশ্বাস।’
ধারেভারে নিশ্চিতভাবেই লিভারপুলের আগে আসে রিয়াল মাদ্রিদ নামটা। কিন্তু এই ফাইনালে লিভারপুলকে এগিয়ে রাখছেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকও। তাঁর বিশ্লেষণ, ‘রিয়াল অনেকবারের সেরা হয়েছে ইউরোপে (১৩ বার)। সাদা চোখে তাদের এগিয়ে রাখতে হবে। তবে এই ফাইনালে আমার ফেবারিট লিভারপুল। কারণ, দলটার মধ্যে একটা বন্ধন আছে। সেটাই হয়তো তাদের টেনে নিতে পারে।’
শুধু কি বন্ধন? ‘না না, তা নয়। কোচের ট্যাকটিকস, খেলোয়াড়দের আন্তরিকতা এবং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্মিলিত চেষ্টার ফল যোগ হলে আমার ধারণা, লিভারপুলই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে’—বলছিলেন শফিকুল ইসলাম।
জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার ও বর্তমানে মোহামেডানের সহকারী কোচ আলফাজ আহমেদের প্রিয় দল বার্সেলোনা। কিন্তু বার্সা এবার গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে। তাতে কী, আজ রাতে রিয়াল-লিভারপুল ফাইনালে তাঁর চোখ ঠিকই থাকছে। যেকোনো ফলই হতে পারে, আলফাজ তা ভুলে যাচ্ছেন না। তাঁর মতে, দুই দলই সর্বশক্তি নিয়ে খেলবে। কিন্তু জিতবে লিভারপুল।
কেন? ‘লিভারপুলের ফরোয়ার্ড লাইন খুবই শক্তিশালী। রক্ষণও অনেক জমাট। গোলকিপারও বিশ্বসেরা। ফলে শক্তির লড়াইয়ে লিভারপুলই এগিয়ে। সালাহ, জোতা, সাদিও মানে...ফরোয়ার্ড লাইনে দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় লিভারপুলের। দলটার বেঞ্চও খুব ভালো। দু-তিন বছর ধরে প্রায় একই দল খেলছে লিভারপুলের। তাই বোঝাপড়া ভালো। রিয়ালে এই সময়ে কিছু বদল হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার বাজি লিভারপুল’—আলফাজ যেন একটু বেশিই মুখিয়ে আছেন লিভারপুলের জয় দেখতে। রিয়ালের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সমর্থক বলেই কী!
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে রহমতগঞ্জের ফুটবলার মামুনুল ইসলামের ফেবারিটও লিভারপুল। কেন ফেবারিট, ব্যাখ্যাও করেন তা, ‘কয়েক বছর ধরেই লিভারপুল শীর্ষ স্তরে দারুণ ফল করছে। দলটির আক্রমণ দারুণ। টিম ওয়ার্ক দুর্দান্ত। এবার ওরা ইংলিশ লিগটা পায়নি, ফলে চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য মুখিয়ে আছে। তা ছাড়া কোচের কারণেও এগিয়ে রাখছি লিভারপুলকে। ক্লপ যখন দায়িত্ব নেন, লিভারপুল তখন মাঝারি মানের দল। দায়িত্ব নিয়ে তিনি ওপরে নিয়ে আসেন। তিনি যে দলেই হাত দেন, ফুল ফোটান। সব মিলিয়ে আমার ফেবারিট লিভারপুলই।’
আবাহনী স্ট্রাইকার ও অধিনায়ক নাবিব নেওয়াজের চোখে দুই দলই শক্তিশালী। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত প্রত্যাশা, লিভারপুল যেন জেতে। কেন এমন প্রত্যাশা? কেন রিয়াল নয়? ‘রিয়াল অনেক ট্রফি জিতেছে। তাই আমি চাই লিভারপুল জিতুক। তারা কিছুটা হলেও ফেবারিট। সালাহ, সাদিও মানে, জোতা, ফিরমিনোদের হাতে উঠুক ট্রফি’—চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল নিয়ে এই হলো নাবিবের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।
চোটের কারণে সদ্য জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া ফুটবলার সাদ উদ্দিনের প্রিয় দল লিভারপুল। বলাই বাহুল্য, ফাইনালে তিনি লিভারপুলকেই সমর্থন করবেন। তাঁর মতে, লিভারপুলেরই জেতার সম্ভাবনা সব দিক থেকে বেশি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এবার যেভাবে শেষ পর্যন্ত এসেছে লিভারপুল, তাতে ওরা যেকোনো দলকে হারানোর ক্ষমতা রাখে বলে মনে করেন সাদ। বলছেন, ‘লিভারপুলের প্রচুর খেলা দেখি আমি। ফলে দলটা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা আছে। আক্রমণে ওরা সেরা। এ জন্যই লিভারপুল আমার ফেবারিট।’
তা ছাড়া রিয়ালের কাছে চার বছর আগে ফাইনালে লিভারপুল হেরেছে ৩-১ গোলে। কাজেই সেই প্রতিশোধ নেওয়ার একটা স্পৃহা কাজ করবে, বিশ্বাস সাদের।
এসবই ম্যাচের আগের সরল হিসাব-নিকাশ। কিন্তু ফুটবল কি সব সময় অঙ্ক মেনে চলে? চলে না। আর চলে না বলেই হিসাবের বাইরে অনেক ফাইনালই দেখেছে ফুটবল–বিশ্ব। তবে এবার এই ফাইনাল রাঙাতে একটু বেশিই তৈরি হয়ে আছে লিভারপুল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ফুটবলার বা কোচের নীরব সমর্থনও থাকছে তাদের দিকেই।