রণজিৎ দাসের বাড়িতে এক বেলা

সিলেটের বাড়িতে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের আজীবন সম্মাননার ট্রফি হাতে নিজের ছবি দেখাচ্ছেন রণজিৎ দাস l প্রথম আলো
সিলেটের বাড়িতে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের আজীবন সম্মাননার ট্রফি হাতে নিজের ছবি দেখাচ্ছেন রণজিৎ দাস l প্রথম আলো

শহর থেকে একটু দূরের নির্জন পাহাড়ি রাস্তার ঢালে এই বাড়ি। শরতের হাওয়ায় কেমন পুজো পুজো গন্ধ। আর সেই গন্ধটা টের পাওয়া গেল সিলেটের করের পাড়া মহল্লায় গিয়ে। বাড়ির পাশের মন্দিরে সবাই ব্যস্ত শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতিতে।

শুধু ব্যস্ততা নেই সাবেক ফুটবলার রণজিৎ দাসের। সারা দিন অঢেল সময়। অথচ একসময় খেলার মাঠেই সারা দিন পড়ে থাকতেন। যাঁর ‘টিকি’ খুঁজে পেতেও স্ত্রী রেখা দাসকে চেয়ে থাকতে হতো পথের দিকে, সেই রণজিৎ দাসের দিন কাটছে টেলিভিশনে খেলা দেখে, পত্রিকা পড়ে। ইদানীং খেলার সঙ্গী জুটেছে। এক বছরের নাতনি অদ্রিজা দাস বুড়ো-দাদুর খেলার সেই সঙ্গী!

ক্রিকেট ও হকি খেলেছেন। তবে ফুটবলার পরিচয়েই বেশি পরিচিত রণজিৎ দাস। ছিলেন গোলরক্ষক। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল ও হকির গোলপোস্ট আগলানোর কীর্তি আছে রণজিৎ দাসের। পঞ্চাশের দশকে ফুটবল খেলার পর ঢাকায় হকি লিগে খেলেছেন ১৯৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত। ফুটবলে আইএফএ শিল্ডে ত্রিপুরা একাদশ ও ঢাকা মোহামেডানের জার্সি পরে খেলেছেন। কলকাতা মোহামেডানেও ডাক পেয়ে খেলতে গেছেন ভারতে। দিল্লিতে খেলেছেন ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপে। ১৯৫৮ সালে রণজিৎ দাসের অধিনায়কত্বে ঢাকা ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। হকিতে অধিনায়ক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের পর খেলেছেন সোনালী ব্যাংকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেট দলের অধিনায়ক ছিলেন।

২০০৬ সালে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। পরের বছর জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। সেই রণজিৎ দাসকে ‘কেমন কাটছে দিনকাল’ প্রশ্ন করে উত্তর মিলল না। মিলবে কী করে! বছর তিনেক কানে শোনেন না। স্ত্রী রেখা দাস কানের কাছে মুখ নিয়ে উঁচু স্বরে বললেও বুঝতে পারেন না। কাগজে প্রশ্নগুলো লিখে দেওয়ার পর মুখে কথার খই ফুটতে শুরু করল।

আগামী মাসে পঁচাশিতে পা দেবেন। কিন্তু মনের দিক দিয়ে ‘চিরতরুণ’। এখনো রোজ বিকেলে নিয়ম করে হাঁটেন। পাশের চা-বাগান ছেড়ে কখনো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও চলে যান। এই বয়সেও খেলায় দারুণ আগ্রহ, ‘নাতনি অদ্রিজার সঙ্গে খুনসুটি করি। তা ছাড়া বেশির ভাগ সময় টিভিতে ক্রিকেট-ফুটবল দেখি। স্টেডিয়ামে খেলা হলেই আমার নামে কার্ড পাঠায় ওরা। ভাবছি, লিগের খেলা দেখতে যাব একদিন।’

তাঁর সময়ের অনেক ফুটবলার চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। নিজেকে ইদানীং ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে, ‘সম্ভবত বেঁচে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র আমি। জহিরুল হক, বশীর আহমেদ, জাকারিয়া পিন্টুরা বেঁচে আছে। ওদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানে গেলে পুরোনো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। তখন কী যে ভালো লাগে!

জাতীয় দলের খোঁজখবরও যে ভালোই রাখেন, তা বোঝা গেল রণজিৎ দাসের কথাবার্তায়, ‘ফুটবল দল জিততে পারে না দেখে খারাপ লাগে।’

স্বামী বড় মাপের ফুটবলার। অথচ রেখা দাসকে খেলা একদমই টানত না, ‘খেলাধুলা নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে এ জন্য কখনো ঝগড়া হয়নি আমাদের। দিনের বেলা ওর সঙ্গে দেখা হতো কম। একটু অভিমান হতো। তবে অবসরে হাসির গল্প করে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত।’

বসার ঘরের শোকেস ভর্তি ট্রফি। রয়েছে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গুণীজন সম্মাননার পুরস্কার, প্রশংসাপত্র। মাঝেমধ্যেই এসব এখন দেখেন আর অতীতে ফিরে যান রণজিৎ দাস।