যেভাবে ভারতকে অসহায় বানাল বাংলাদেশ
>যুবভারতীতে গতকাল লড়াইটা ছিল দুই দেশের দুই বিদেশি কোচেরও। বাংলাদেশের ইংলিশ কোচ জেমি ডে'র সঙ্গে ভারতের ক্রোয়েশিয়ার কোচ ইগর স্টিমাচের। কী দুর্দান্তভাবেই না সে লড়াইটা জিতে গেলেন বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে! বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসী রক্ষণের সামনে অসহায় মনে হলো ভারতের কুশলী আক্রমণভাগকে।
নিজেদের মাঠে খেলা। কলকাতার যুবভারতীতে খেলা দেখতে আসা গ্যালারি ভর্তি সমর্থকের প্রায় সবাই-ই ভারতের পক্ষে গলা ফাটিয়েছেন কালকে। নিজেদের পক্ষে সমর্থন পাবেন, সেটা বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে থেকে শুরু করে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া কেউই হয়তো ভাবেননি। কিন্তু এই শতভাগ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কী অসাধারণভাবেই না এক পয়েন্ট নিয়ে আসলেন জেমি ডে! নিজেদের মাঠে, ৬০ হাজার দর্শকের সামনে ভারত হয়ে পড়ল অসহায়। ৮৮ মিনিটে সেট পিস থেকে আদিল খানের ওই গোলটি না হলে বড় লজ্জাতেই পড়তে হতো ভারতকে।
জেমি ডে'র কৌশল মাঠে সফল ভাবে ঠান্ডা মাথায় বাস্তবায়ন করলেন সাদউদ্দিন, জামাল ভূঁইয়া, মোহাম্মদ ইব্রাহিমরা। যে কৌশলের কোনো জবাব জানা ছিল না ইগর স্টিমাচের কাছে।
জেমির কৌশল ছিল সাধারণ। তিনি নিজের দলের খেলোয়াড়দের সামর্থ্য বেশ বোঝেন। তাই তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন ম্যাচে। বাড়তি কিছু চাননি। এমন কোনো দুর্বোধ্য কৌশল খেলোয়াড়দের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে চাননি যা খেলোয়াড়েরা বুঝতে না পারেন। নিজেদের ঘর আগে সামলাও, তারপর সুযোগ পেলে প্রতি আক্রমণে যাও। রক্ষণভাগের চারজনের মধ্যে যেন যোগাযোগের ঘাটতি না থাকে মাঠের মধ্যে। সহজ হিসাব।
বাংলাদেশের এগারো খেলোয়াড় মাঠের মধ্যে সে কথাগুলো মেনেছে বেদবাক্যের মতো। কলকাতার দর্শকদের উত্তাল গর্জন সে লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই কোচের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা শুরু করেছিলেন ইব্রাহিমরা। প্রথম মিনিটেই হুট করে আক্রমণে যাওয়া ইব্রাহিমকে যেভাবে ডি-বক্সে অবৈধ ভাবে ফেলে দিলেন ভারত রাইটব্যাক রাহুল ভেকে, একজন ফুটবল বোঝা সমর্থকও স্বীকার করবেন, ওটা আসলে পেনাল্টিই ছিল।
ব্যস, ম্যাচের প্রথম মিনিটেই ভারতের মনের মধ্যে ভয়টা ঢুকিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। জানান দেওয়া হয়েছিল, যুবভারতীতে বাংলার টাইগাররা নিজেদের ছাপ রাখতেই এসেছে, ভারতীয়দের উন্নতির ধাপ হতে আসেনি।
কাতারের বিপক্ষে দুটো উটকো গোল বাদ দিলে সে ম্যাচেও বাংলাদেশ খেলেছিল দুর্দান্ত। কোচ তাই সেই পরীক্ষিত রসায়নের মধ্যে বাড়তি কোনো নিরীক্ষা করতে চাননি। কাতারের বিপক্ষে খেলা একাদশটাই এই ম্যাচে খেলেছে। জেমি জানতেন, ভারত কেন ফিফার র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৮৩ ধাপ এগিয়ে আছে, সেটা তারা হাতে-কলমে বাংলাদেশকে দেখাতে চাইবে। আট বছর পর কলকাতায় খেলতে আসা সুনীলরা কলকাতার দর্শকদের দেখাতে চাইবেন, কেন তারা প্রতিবেশী দেশের চেয়ে ফুটবলেও সেরা। ফলে আগের ম্যাচের মতো সেই ৪-১-৪-১ ছকেই খেলেছে বাংলাদেশ। আক্রমণে যেটা ৪-৩-৩ হয়ে যায়।
গোলের নিচে আশরাফুল রানা। তাঁর সামনে রক্ষণভাগে ইয়াসিনের সঙ্গে রিয়াদুল, দুদিকে রায়হান আর রহমত। রক্ষণভাগকে আগলে রেখে আক্রমণ গড়ে দেওয়ার কাজটা রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডে একা থেকেই করেছেন অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। তাঁর সামনে জুটি বেঁধে খেলেছেন সোহেল রানা আর বিপলু আহমেদ। দুই উইংয়ে ইব্রাহিম আর সাদ। আর সবার সামনে নাবিব নেওয়াজ।
ভারতের ছক অনুযায়ী একদম মাঝখানে থেকে খেলার কথা সুনীল, অনিরুদ্ধ থাপা আর সাহাল আবদুল সামাদের। আর উইঙে খেলবেন উড়ন্ত সিং। এই চারজনই ঘুরেফিরে ভারতের প্রধান খেলোয়াড়। এই চারজনকে বোতলবন্দী করে রাখলে, এদের মধ্যকার রসায়নটা নষ্ট করে ফেলতে পারলেই ব্যস, কেল্লাফতে!
জামালরা সেটা জানতেন। আর আশ্চর্যজনকভাবে জামালদের কাজটা যেন আরেকটু সহজ করে দিলেন ভারতের কোচ ইগর স্টিমাচ। ভারতের বিপক্ষে তুলনামূলক শক্তিশালী কাতার যে ভুলটা করেছিল, যে ভুলের কারণে নিজেদের মাঠে দুর্বল ভারতের বিপক্ষে তাদের ড্র করতে হয়েছিল, 'দুর্বল' বাংলাদেশের বিপক্ষে সে একই ভুল করল ‘শক্তিশালী’ভারত।
কী ভুল? বাংলাদেশকে সহজ প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবা। নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে হয়তো অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল ভারত। নিজেদের মাঠে ষাট হাজার দর্শকের সামনে বাংলাদেশকে সহজেই হারানো যাবে, সেটা হয়তো ভেবেছিলেন স্টিমাচ। কিন্তু বাংলাদেশকে গোলবন্যায় ভাসানোর দুর্নিবার বাসনায় তারা সহজ কিছু হিসাবে ভুল করে বসে। একে তো তাদের মূল স্কোয়াডের তিনজন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার (রাওলিন বোর্গেস, প্রণয় হালদার ও অমরজিৎ সিং) ছিলেন না। এমন অবস্থায় কোনো ধরনের রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ছাড়াই মূল একাদশ সাজানোর সাহস দেখিয়ে ফেলেন স্টিমাচ। মূল একাদশে কোনো রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার না নামিয়ে সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে আরেকজন বাড়তি স্ট্রাইকার মানবীর সিং কে মাঠে নামান এই ক্রোয়েশিয়ান কোচ।
উদ্দেশ্য পরিষ্কার, অল আউট অ্যাটাক। আক্রমণের পর আক্রমণ করে নিজেদের মাঠে বাংলাদেশকে পর্যুদস্ত করতে চায় তারা। দুই স্ট্রাইকার (সুনীল ছেত্রী ও মানবীর সিং) এর পাশে দুই উইঙ্গার (আশিক কুরুনিয়ান ও উড়ন্ত সিং), আর একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার (সাহাল আবদুল সামাদ) - নিজেদের মাঠে বাংলাদেশকে বেশি গোল দিতে যাওয়ার আশায় মোট পাঁচজন আক্রমণ নির্ভর খেলোয়াড় নামালেন স্টিমাচ। পাঁচজন আক্রমণ নির্ভর খেলোয়াড়ের সঙ্গে চারজন নিয়মিত ডিফেন্ডার নামাতে গিয়ে উল্টো মাঝমাঠটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল তাদের। যে একজন মিডফিল্ডার নামলেন, সে অনিরুদ্ধ থাপাকে বলা হয়েছিল রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে। যে পজিশনে খেলার তাঁর তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
থাপার খেলার ধরনটা একটু খোলাসা করে বলা যাক। রক্ষণ থেকে শুরু করে আক্রমণভাগ পর্যন্ত সব জায়গায় তাঁর বিচরণ থাকে। দলের ফুসফুস বলা হয় তাঁকে। ৯০ মিনিট ধরে বিরামহীন দৌড়ে যান তিনি। রক্ষণভাগে থেকে বল ট্যাকল করা থেকে শুরু করে বিপজ্জনক বল ক্লিয়ার করা, বল নিয়ে আক্রমণভাগের দিকে এগিয়ে যাওয়া—সব একাই করতে পারেন থাপা। মাঝেমধ্যে হুট করে প্রতিপক্ষের ডি বক্সে ঢুকে গিয়ে গোলও করতে পারেন এই তারকা। এখন এমন একজন মিডফিল্ডারকে যদি বলা হয় ওপরে না উঠে নিজেদের রক্ষণভাগকে আগলে যাও, তাহলে হবে? এখানেই ভুল করে ফেলেছেন স্টিমাচ।
আর সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে'ও সে ভুলের পুরো ফায়দা লুটে নিয়েছেন। থাপাকে একদম বোতলবন্দী করে রেখেছিলেন জামাল ভূঁইয়া আর সোহেল রানা। থাপার সঙ্গে ভারতীয় আক্রমণভাগের যোগাযোগের পথটা একদম বন্ধ করে দিয়েছিলেন জামাল আর সোহেল। নিরন্তর প্রেস করে গেছেন থাপাকে, ফলে থাপার কাছ থেকে বল পাচ্ছিলেন না ওপরে গিয়ে বসে থাকা ভারতের পাঁচ খেলোয়াড়, বিশেষ করে দলে গোলের সবচেয়ে বড় জোগান দাতা অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। এই অবস্থায় থাপার কাজ ছিল দুটি, হয় নিজেদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছোট ছোট পাস খেলতে হবে, অথবা বলকে বাতাসে ভাসিয়ে আক্রমণভাগে পাঠাতে হবে।
এটাই যেন চাচ্ছিলেন জেমি ডে, ভারত যেন 'লং বল' কৌশলের প্রয়োগ ঘটায়। ছোট ছোট পাস না খেলে ভারত যেন লম্বা পাস ও উড়ন্ত বলে বেশি খেলে। কেননা বাংলাদেশের সব খেলোয়াড় এই 'লং বল' কৌশলেই খেলে অভ্যস্ত। উড়ে আসা বল ক্লিয়ার করে পাঠিয়ে দিতে ইয়াসিন, রিয়াদুল বা রায়হান-রহমতদের জুড়ি নেই। কাতার, ভুটানের সঙ্গেও একই কৌশলে খেলে গেছে বাংলাদেশ।
ফলে ভারত যখন বেশি আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় মাঠে নামানোর মাশুল হিসেবে মিডফিল্ডে বল ধরে রেখে খেলতে পারল না, 'পাসিং ফুটবল' খেলতে পারল না, প্রকারান্তরে বাংলাদেশেরই লাভ হলো। মিডফিল্ড থেকে উড়ে আসা বল, উইং থেকে ভেসে আসা বল দক্ষতার সঙ্গে যোদ্ধার মতো ক্লিয়ার করলেন ইয়াসিনরা। সুনীল ছেত্রীদের কাছে তেমন বলই গেল না। উল্টো নিজেদের সেটপিস পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন করে একটা গোলও করে ফেললেন সাদ উদ্দিন। নিজেদের রক্ষণ সামলে মাঝে মধ্যেই বিপজ্জনক কাউন্টারে উঠে যাচ্ছিলেন বিপলু, ইব্রাহিমরা। ওদিকে নিষ্ক্রিয় থাপাকে ৬৭ মিনিটে উঠিয়ে রেইনিয়ার ফার্নান্দেজকে নামান ইগর স্টিমাচ। মিডফিল্ডের দখল নেওয়ার জন্য একজন ডিফেন্ডারকে উঠিয়ে অতিরিক্ত মিডফিল্ডার (ব্রেন্ডন ফার্নান্দেজ) কে মাঠে নামান কোচ। ব্রেন্ডন-রেইনিয়ার নতুন দুই মিডফিল্ডার নামার ফলেই মাঝমাঠে আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ পেতে শুরু করে ভারত। তাদের গোলটাও এসেছে দুই ফার্নান্দেজের মিডফিল্ড-বোঝাপড়ার ফসল হিসেবে। বাংলাদেশের আক্ষেপ, শেষ দিকে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া চোটে পড়ে গিয়েছিলেন। চোটে না পড়লে দুই ফার্নান্দেজ নামার পরেও হয়তো মিডফিল্ডের ব্যাটনটা জামালদের হাত থেকে সরে যেত না। বাংলাদেশকেও গোল খেতে হতো না।
কৌশলের দিক দিয়ে তাই ফুলমার্ক পেয়েছেন বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে। আর ফুলমার্ক পেতে তাঁকে সাহায্য করেছেন এক ঝাঁক অদম্য তরুণ। এমন উদ্যমী বাংলাদেশকেই তো দেখতে চেয়েছিল দেশের ষোলো কোটি মানুষ!