যেভাবে টুখেলকে হারালেন গার্দিওলা

অবশেষে টুখেলকে ইংল্যান্ডে হারালেন গার্দিওলাছবি : রয়টার্স

চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হারের ক্ষতটা এখনও দগদগে। টমাস টুখেলের চেলসির বিপক্ষে সেদিন কোনো জবাবই ছিল না পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির কাছে।

শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল বলেই নয়, ওই দুমাসে টুখেলের চেলসির কাছে মোট তিনবার হেরেছিল গার্দিওলার সিটি। টুখেলের চেলসিকে কীভাবে বশ মানানো যায়, সে উপায় বেরই করতে পারছিলেন না গার্দিওলা।

জেসুসের গোলে ম্যাচ জিতেছে সিটি
ছবি : রয়টার্স

শেষ তিন ম্যাচে কৌশলের খেলায় গার্দিওলা টুখেলকে হারাতে পারেননি বলে কখনই পারবেন না, তা তো না। গার্দিওলার বিপক্ষে টুখেলের ‘জয়রথ’-ও থেমে গেছে গতকাল। এ ম্যাচ জিতে অবশ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো কোনো শিরোপা জোটেনি গার্দিওলার কপালে। না জুটুক, তবু যে কোচ কয়েক মাস ধরে গার্দিওলার মাথায় চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েই যাচ্ছিলেন, তাঁকে অবশেষে হারানোর পথ খুঁজে পাওয়া একটু হলেও স্বস্তি দেবে গার্দিওলাকে। সঙ্গে স্বস্তি দেবে অন্যান্য কোচদেরও — যাঁরা হারাতে চান চেলসিকে, টুখেলকে।

বড় ম্যাচে কৌশল নিয়ে খামোকা বেশি চিন্তা করা গার্দিওলার পুরোনো ‘দোষ।’ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যার প্রমাণ মিলেছিল। না ফার্নান্দিনিও, না রদ্রি — কোনো প্রথাগত রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ছাড়াই সিটিকে নামিয়েছিলেন গার্দিওলা। রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল জার্মান মিডফিল্ডার ইলকায় গুন্দোয়ানকে। সিটি রক্ষণের সামনে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের বাড়তি নিরাপত্তা না থাকার সুফল পুরোপুরি তুলে নিয়েছিলেন চেলসির মেসন মাউন্ট, কাই হাভার্টজ ও এনগোলো কান্তেরা। মাউন্ট আর হাভার্টজ এমনিতেই প্রতিপক্ষের মাঝমাঠ ও রক্ষণের মাঝের ফাঁকফোকর বের করে প্রেস করার জন্য কার্যকরী, তার ওপর প্রতিপক্ষ দলে যদি কোনো আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার না থাকে, তাহলে কী হতে পারে সেটা সেদিন বেশ ভালোই বোঝা গিয়েছিল।

সে ভুলটা এবার করেননি গার্দিওলা। গতকাল সিটির একাদশে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রিকে নামানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, রক্ষণের দিক দিয়ে রদ্রিকে সহায়তা করার জন্য প্রায় সময়ই পর্তুগিজ মিডফিল্ডার বের্নার্দো সিলভা নেমে যাচ্ছিলেন, ডিফেন্ডারদের কাছ থেকে বল সংগ্রহ করছিলেন, ভাবা যায়!

যে বের্নার্দো গোটা ক্যারিয়ার উইঙ্গার, ইনসাইড ফরোয়ার্ড, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ইত্যাদি ভূমিকায় খেলে গেছেন, সে বের্নার্দোকেই গতকাল দলের প্রয়োজনে অনেক নিচে নেমে খেলতে হলো। বলা যেতে পারে, যে গার্দিওলা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে কোনো রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার রাখারই প্রয়োজন মনে করেননি, সে গার্দিওলাই গতকাল রক্ষণভাগের সামনে দুই মিডফিল্ডারকে রক্ষণের দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।

সিটির খেলোয়াড়দের অবস্থান
ছবি : সংগৃহীত

এ পর্যায়ে দুই দলের একাদশের দিকে একটু নজর দেওয়া যেতে পারে। কাগজে কলমে সিটি ৪-৩-৩ ছকে নেমেছে বলে মনে হলেও, মাঠে ৪-২-৪ ও ৩-৩-৪ ছকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছিল তাদের। রাইটব্যাক কাইল ওয়াকার প্রায় সময়েই দুই সেন্টারব্যাক রুবেন দিয়াস ও এমেরিক লাপোর্তের সঙ্গে তৃতীয় সেন্টারব্যাকের ভূমিকা নিচ্ছিলেন, ওদিকে রক্ষণ থেকে শুধু লেফটব্যাক জোয়াও কানসেলোকে ওপরে ওঠার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মাঝমাঠে রদ্রির পাশে বের্নার্দো। বাকি চারজন কেভিন ডি ব্রুইনা, গাব্রিয়েল জেসুস, ফিল ফোডেন ও জ্যাক গ্রিলিশ — প্রত্যেকে খেলেছেন ওপরে।

শুধু খেলেছেন বলা ভুল হবে, এই চারজনের প্রত্যেকের ওপরে দায়িত্ব ছিল চেলসির পাঁচ ডিফেন্ডারের চারজনকে প্রেস করার। চেলসি যেন পেছন থেকে খেলা গড়ে বল ওপরে না পাঠাতে পারে, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য প্রথম থেকেই চেলসির রক্ষণকে নিরন্তর প্রেস করতে থাকে সিটির আক্রমণভাগ। যে কাজটা চেলসির বিপক্ষে আগের কোনো ম্যাচেই এত কঠোরভাবে করতে পারেনি সিটি। চেলসির তিন সেন্টারব্যাক আন্তোনিও রুডিগার, আন্দ্রেয়াস ক্রিস্টিয়ানসেন ও থিয়াগো সিলভা (রাইট উইংব্যাক রিস জেমস চোটে পড়ার আগে সেজার আজপিলিকেতাকে) কে বলতে গেলে আলাদা আলাদাভাবে প্রেস করেন ফোডেন, গ্রিলিশ ও ডি ব্রুইনা। বাকি দুই উইংব্যাকের একজন মার্কোস আলোনসোকে প্রেস করার কাজ করেছেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস, ওদিকে আরেক উইংব্যাক রিস জেমসকে (পরে সেজার আজপিলিকেতা) প্রেস করার জন্য নিচ থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছিলেন সিটির লেফটব্যাক কানসেলো।

চেলসির খেলোয়াড়দের অবস্থান
ছবি : সংগৃহীত

রাইট উইংব্যাক রিস জেমসের চোটও ভুগিয়েছে চেলসিকে। জেমস চলে যাওয়ার পর আজপিলিকেতাকে সেন্টারব্যাক থেকে রাইট উইংব্যাকের ভূমিকা নিতে হয়েছে। পরে জেমসের জায়গায় নামা সিলভা নিয়েছেন তিনজন সেন্টারব্যাকের মাঝখানের জায়গাটা।

তিন সেন্টারব্যাককে মার্ক করে রাখার কাজটা ফোডেন, গ্রিলিশ আর ডি ব্রুইনা মিলে এত ভালোভাবে করছিলেন যে, চেলসির গোলকিপার এদুয়ার্দ মেন্দি প্রায় সময়েই এই তিনজনের কাউকে পাস দিতে পারছিলেন না। যে কারণে পেছন থেকে প্রায় সময় দুই উইংব্যাক আলোনসো আর জেমসকে (পরে আজপিলিকেতা) উড়িয়ে বল পাঠাচ্ছিলেন এই সেনেগালিজ গোলকিপার। চেলসির আক্রমণের পরিকল্পনা অনেকাংশে এখানেই ব্যর্থ হয়ে যায়। চেলসি ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি, সিটি তাদের এভাবে প্রেস করে খেলবে।

টুখেল যে কৌশলে চেলসিকে খেলান, সে কৌশলে মেসন মাউন্টের ভূমিকা অনেক বেশি। টুখেলের ৩-৪-২-১ ছকে দুই রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের সামনে মাউন্টের ভূমিকা থাকে অনেকটা আক্রমণাত্মক, যিনি প্রতিপক্ষের রক্ষণ ও মাঝমাঠের ফাঁকা জায়গাগুলো প্রেস করে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেন। চোটের কারণে গতকাল মাউন্ট ছিলেন না। সে কারণে টুখেল যেন আরও বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে গেলেন।

হতাশ করেছেন কান্তে
ছবি : রয়টার্স

এনগোলো কান্তে আর জর্জিনিও দুজনই রক্ষণাত্মক মানসিকতার। আর তাঁরা মাঝমাঠে মাউন্টের বদলে যাঁকে পাশে পেলেন, সেই মাতেও কোভাচিচের ভূমিকাও অনেকটা একই রকম হয়ে গেল। মাউন্ট না থাকায় রক্ষণাত্মক চেলসিকে প্রেস করার কাজ আরও সহজ হয়ে যায় সিটির জন্য। মাউন্ট ছাড়াও প্রেসিংয়ের ক্ষেত্রে আক্রমণভাগে চেলসির অন্যতম কার্যকরী খেলোয়াড় কাই হাভার্টজ। চোটের কারণে মাউন্ট ছিলেন না, কিন্তু কোনো একটা কারণে টুখেল হাভার্টজকেও খেলাননি।

তা-ও সমস্যা হতো না, যদি এনগোলো কান্তে ফর্মে থাকতেন। সিটির প্রেসিংয়ের কারণে চেলসির রক্ষণ ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওপরেও উঠতে পারছিল না। ওপরে উঠতে পারছিলেন না জর্জিনিও-ও। ওদিকে এই ম্যাচে ৩-৪-২-১ ছক বদলে ৩-৫-২ ছকে খেলানো টুখেল চেলসির আক্রমণভাগে রোমেলু লুকাকুর পাশে রেখেছিলেন জার্মান ফরোয়ার্ড টিমো ভের্নারকে। এ দুজন, অর্থাৎ ভের্নার ও লুকাকুর মধ্যে যেন কোনো সংযোগ না থাকে, সেটা নিশ্চিত করছিলেন সিটির তিন ডিফেন্ডার (দুই সেন্টারব্যাক দিয়াস ও লাপোর্তের সঙ্গে প্রায়ই সেন্টারব্যাক হয়ে যাওয়া রাইটব্যাক ওয়াকার)। সব মিলিয়ে চেলসির আক্রমণভাগ আর মাঝমাঠের মধ্যে কোনো যোগাযোগই ছিল না। এই যোগাযোগ নিশ্চিত করার কাজটা কান্তেকে একা করতে হচ্ছিল।

কিন্তু রক্ষণাত্মক মানসিকতার হলে যা হয়, কান্তে হাভার্টজ বা মাউন্টের মতো সেভাবে প্রেস করে ওপরে উঠে যেতে পারছিলেন না। শেষমেশ কান্তেকে উঠিয়ে সেই হাভার্টজেরই দ্বারস্থ হতে হয় টুখেলকে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এক গোলে পিছিয়ে গেছে চেলসি।

দ্বিতীয়ার্ধে চেলসিকে প্রথমার্ধের মতো অত বেশি প্রেস না করলেও, ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ কখনোই হাত থেকে বেরোতে দেয়নি সিটি। ফলে ফুটবলবিশ্বও বুঝেছে, টুখেলের কৌশল ভেস্তে দেওয়া যায় কী করে।