২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যার কৌশলে নাকাল হয়েছিলেন কাকা-মালদিনিরা

লিভারপুলের সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ফাইল ছবি

প্রথমার্ধ শেষ।

মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথটা এর আগে কখনো এত দীর্ঘ লাগেনি লিভারপুল অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ডের। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মহাশক্তিধর এসি মিলানের বিপক্ষে খেলতে নেমে গোটা প্রথমার্ধ চরকির মতো ঘুরেছেন, খেই হারিয়ে ফেলেছেন বারবার। কাকা-পিরলোরা ছেলেখেলা করেছেন জেরার্ড-ক্যারাঘারদের সঙ্গে। অধিনায়ক পাওলো মালদিনির এক গোলের সঙ্গে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার হার্নান ক্রেসপোর দুই গোল মিলিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল মিলান। পোড় খাওয়া লিভারপুলের সমর্থকেরাও এই অবস্থায় ম্যাচ জয়ের আশা করেননি। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শিরোপা উৎসবের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন মিলান সমর্থকেরা।

প্রতিভার চেয়ে কৌশলকে বেশি প্রশ্রয় দিতেন বেনিতেজ
ছবি : এএফপি

একজনের ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। এত কষ্ট করে জুভেন্টাস, চেলসি, বেয়ার লেভারকুসেনের মতো দলগুলোকে টপকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তুলেছেন দলকে, সে কি বিনা যুদ্ধে এভাবে আত্মসমর্পণ করার জন্য? অবশ্যই নয়!

তিনি লিভারপুলের স্প্যানিশ কোচ রাফায়েল বেনিতেজ। সে মৌসুমের শুরুতেই ভ্যালেন্সিয়া থেকে লিভারপুলে যোগ দেওয়া এই কোচ বিরতির ওই পনেরো মিনিটে কাজে লাগালেন কৌশল ঠিক করতে। বাকি পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যে করেই হোক, তিন গোল দিয়ে অন্তত ম্যাচে ফেরা লাগবে যে!

ম্যাচ শুরুর আগেই একটা বড় ভুল করেছিলেন বেনিতেজ। মূল একাদশে একজন আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার রাখেননি। অথচ জার্মান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ডিটমার হামান সেমিফাইনালে চেলসির বিপক্ষে আর দ্বিতীয় রাউন্ডে বেয়ার লেভারকুসেনের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত খেলেছিলেন। সেমিফাইনালে মরিনহোর চেলসির বিপক্ষে এতটাই ভালো খেলেছিলেন হামান যে, ওই দলের অধিনায়ক জন টেরি প্রশংসায় মুখর হলেন। ওদিকে ফাইনালের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক ম্যাচেই মূল একাদশে ছিলেন আরেক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, ক্রোয়েশিয়ার ইগর বিসকান। অথচ এই দুজনকে বাদ দিয়ে ৪-৪-২ ছকে স্টিভেন জেরার্ড ও জাবি আলোনসোকে মাঠে নামিয়ে দিলেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে। রক্ষণভাগকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া যে দুজনের মূল কাজ নয়। কোচের এই সিদ্ধান্ত ম্যাচের আগেই চমকে দেয় জেরার্ড-আলোনসোকে।

জাবি আলোনসো
ফাইল ছবি

বেনিতেজের আরেকটা বদভ্যাস ছিল। ম্যাচ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে এসে মূল একাদশ ঘোষণা করতেন। পাছে যদি প্রতিপক্ষ জেনে যায়! ফলে একদম শেষ মুহূর্তে লিভারপুল যখন বুঝল, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছাড়াই খেলা লাগবে, সেখানেই তাঁদের সাহস কমে অর্ধেক হয়ে গেল যেন।

ওদিকে এসি মিলানের মাঝমাঠ তখন তিনজন তুখোড় ‘প্লেমেকারে’ ঠাসা। খেলা বানিয়ে দেওয়ায় যাদের জুড়ি মেলা ভার—ইতালির আন্দ্রেয়া পিরলো, ব্রাজিলের কাকা ও নেদারল্যান্ডসের ক্লারেন্স সিডর্ফ। এ তিনজনকে নিশ্চিন্ত মনে আক্রমণ করতে দেওয়ার লাইসেন্স দিতে ৪-১-২-১-২ ছকে পেছনে ছিলেন দলের মূল রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ইতালির জেনারো গাত্তুসো। দুই দলের শুরুর কৌশলের ফলে যা হওয়ার তাই হলো। গোটা মিডফিল্ডে জেরার্ড আর আলোনসো ওপর রীতিমতো ছড়ি ঘোরালেন কাকা-পিরলো-সিডর্ফ। বিরতিতে মিলান ৩: ০ লিভারপুল।

লিভারপুলের সেই দলটার কোচ ছিলেন রাফায়েল বেনিতেজ
ছবি : এএফপি

বিরতিতে এই ভুলটা শোধরালেন বেনিতেজ। গোটা একাদশের ছকটাই বদলে দিলেন। ৪-৪-২ থেকে এবার লিভারপুলের ছক হল ৩-৪-১-২। আরেক ইতালীয় দল জুভেন্টাসকে এই ছকেই কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছিলেন বেনিতেজ। তাই মিলানের বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধে আবারও সেই ছকেই ফিরলেন। প্রথমার্ধে লেফটব্যাক জিমি ট্রায়োরের পারফরম্যান্সে বেনিতেজ এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে, বিরতির সময় তাঁকে বলে দিলেন, ‘তোমাকে আর মাঠে নামানো হচ্ছে না। তোমার জায়গায় হামান নামবে।’ ট্রায়োরেও সুন্দরমতো কোচের কথা মেনে কাপড়-চোপড় খুলে খালি গায়ে গোসল করতে চলে গেলেন। কিন্তু এখানেও ঝামেলা হল আরেক। দলের ফিজিও এসে জানালেন, রাইটব্যাক স্টিভ ফিনান চোটে পড়েছেন, গোটা নব্বই মিনিট খেলা সম্ভব না তাঁর পক্ষে। ফিনানকে মাঠ থেকে তুলে নিতেই হবে।

তাহলে উপায়? ট্রায়োরের জায়গায় ফিনানকে বদলি করলেন বেনিতেজ। মাঠে নামালেন হামানকে। বেচারা ট্রায়োরে, শান্তিমতো গোসলটাও করতে পারেননি। কোচের ডাকাডাকিতে বাথরুম থেকে যখন দৌড়ে বের হয়ে আসলেন, মাথায় তখনো শ্যাম্পু। বেনিতেজ যখন গোটা দলকে নিজের নতুন কৌশল বোঝাচ্ছেন, ট্রায়োরে তখনো নিজের মোজা জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন! পরে ট্রায়োরেকে মাঠে দেখে আরেক বদলি খেলোয়াড় হামানও চমকে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই যাকে টাওয়েল জড়ানো অবস্থায় গোসল করার জন্য ঢুকতে দেখলেন, সে আবার মাঠে নামছে কেন?

লিভারপুলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী সাবেক অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড
ছবি : টুইটার

চেক স্ট্রাইকার মিলান বারোসের জায়গায় ফরাসি স্ট্রাইকার জিব্রিল সিসেকেও তখনই বদলি করে মাঠে নামাতে চেয়েছিলেন বেনিতেজ। কিন্তু বিধি বাম! এক সহকারী এসে মনে করিয়ে দিলেন, প্রথমার্ধেই চোটে পড়া অস্ট্রেলীয় উইঙ্গার হ্যারি কিউয়েলের বদলে ভ্লাদিমির স্মিৎসারকে নামানো হয়ে গেছে, যেটা ভুলে গিয়েছিলেন বেনিতেজ। সব বদলি খেলোয়াড় প্রথমার্ধের পরেই নামিয়ে ফেললে বাকি ম্যাচে সমস্যা হতে পারে।

দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামলেন জেরার্ডরা। মাথায় তখন কোচের নতুন কৌশল, খেলতে হবে ৩-৪-১-২ ছকে। মিডফিল্ডে আলোনসো আর হামান জুটি বাঁধবেন, তাঁদের একটু সামনে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হয়ে খেলবেন জেরার্ড। বামদিকে উইংব্যাক ট্রায়োরে, ডানদিকে স্মিৎসার। সামনে দুই স্ট্রাইকার বারোসের সঙ্গে লুইস গার্সিয়া।

টোটকাটা কাজ করল একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই। পনেরো মিনিটের মধ্যেই ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘কামব্যাক’ দেখল বিশ্ব। পেছনে হামানকে রেখে নির্ভারচিত্তে আক্রমণ করতে পারলেন স্টিভেন জেরার্ড। ৫৪ মিনিটে জেরার্ডের বুলেটগতির হেড, ৫৬ মিনিটে স্মিৎসারের দূরপাল্লার শট, ৬০ মিনিটে আলোনসোর পেনাল্টি মিলান গোলরক্ষক দিদা প্রথম দফায় বাঁচিয়ে দিলেও ফিরতি বল জালে জড়িয়ে ওই আলোনসোরই গোল। স্কোরলাইন ৩-৩!

শুভ জন্মদিন রাফায়েল বেনিতেজ!
ছবি: এএফপি

বাকি সময়ে লিভারপুলের এই নতুন ছকে নির্বিষ হয়ে রইলেন কাকা-শেভচেঙ্কোরা। জুভেন্টাসের মতো মিলানও বের করতে পারল না, কীভাবে বেনিতেজের এই ছক ভেঙে গোল করা যায়। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময় শেষেও ব্যবধান রইল ৩-৩। পেনাল্টি শুটআউটে গোলরক্ষক জের্সি দুদেকের বীরত্বে লিভারপুল পেল অমূল্য সেই জয়।

লিভারপুলের জয়টাকে শুধু ‘ফ্লুক’ বললে তাই বেনিতেজের প্রজ্ঞার প্রতি অসম্মানই করা হয় যেন। এই প্রজ্ঞাবান কোচের জন্মদিন আজ, লিভারপুলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাতের স্মৃতিচারণে একটা ভালো উপলক্ষ্য বটে!

শুভ জন্মদিন রাফায়েল বেনিতেজ!