ম্যাচে ২-২ গোলে সমতা, ম্যারাডোনার দারুণ এক থ্রু, সেটি ধরে বুরুচাগার গোল...আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের উচ্ছ্বাস! সেই হোর্হে বুরুচাগা ৩৬ বছর আগের সেই গোল, বিশ্বকাপ জয় আর সেই জয়ের সমার্থক হয়ে যাওয়া ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রথম আলোকে। সেই সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। বুরুচাগা ভালো ইংরেজি জানেন না। প্রশ্ন স্প্যানিশে অনুবাদ করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর পর বুরুচাগা উত্তর দিয়েছেন স্প্যানিশেই। সেটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছেন ঢাকায় অবস্থান করা জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক ও বর্তমানে শেখ জামাল ধানমন্ডির ট্রেনার এরিয়েল কোলম্যান।
প্রশ্ন :
৩৬ বছর আগে আপনার গোলে এই দিনে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। তিন যুগ পরে এসে এই দিনটিতে আপনার কেমন অনুভূতি হয়?
হোর্হে বুরুচাগা: একজন ফুটবলারের স্বপ্নই থাকে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সৌভাগ্যক্রমে আমি সেই কাজটি করতে পেরেছি। খুশি করতে পেরেছি পুরো দেশকে। ১৯৮৬ সালের ২৯ জুন দিনটি সব সময় মনে থাকে। সেদিনটি ছিল রোববার। আমার জীবনের খুব আনন্দময় এক দিন, যা কোনো দিনও ভুলব না।
গোলটির কথা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। যদি সাধারণ জীবনের সঙ্গে তুলনা করে বলি, প্রথম বাবা হওয়ার পর সন্তানকে কোলে নিলে যেমন আনন্দ হয়, সেই গোলটার পর তেমন আনন্দ হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, এরপর আমার জীবনে আর এমন দিন আসেনি।
প্রশ্ন :
ম্যারাডোনার পাস থেকে সেই জয়সূচক গোলটি করেছিলেন। এখনো কি মনে আছে গোলটি কীভাবে করেছিলেন?
বুরুচাগা: পরিষ্কার মনে আছে। ডিয়েগো দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে বলটি দিয়েছিল। আমি আর ডিয়েগো অনুশীলনে এমনটা করতাম। সে জানত, আমি বলের জন্য ওখানেই দৌড়টা দেব। বল নিয়ে ৪০ গজ দৌড়েছিলাম। খুব আনন্দময় দৌড় ছিল।
গোলকিপার শুমাখার বেরিয়ে এসেছিল। আমি ভাবছিলাম, চ্যাম্পিয়ন হতে হলে গোলটা করতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য আমাদের ওপর অনেক চাপ ছিল। গোল করা পর্যন্ত বলে মাত্র তিনবার স্পর্শ করেছি। গোলের পর হাঁটু গেড়ে বসে হাত ওপরের দিকে দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘ধন্যবাদ, আমাকে এই সুযোগটি দেওয়ার জন্য।’
প্রশ্ন :
আপনার এই গোলটিই আর্জেন্টিনাকে সর্বশেষ বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল। এ নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার খুব গর্ব হয়!
বুরুচাগা: অবশ্যই। আমার পরে আর্জেন্টিনার আর কোনো ফুটবলার ফাইনালে গোল করতে পারেনি। অথচ এরপর আর্জেন্টিনা আরও দুবার ফাইনালে খেলেছে। সর্বশেষ সুযোগ এসেছিল ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে।
আর্জেন্টিনা ভালো খেলেও সেদিন জিততে পারেনি। আমি জানি, বিশ্বকাপ জেতা খুবই কঠিন কাজ। আর্জেন্টিনার ফুটবলের জন্য খুবই হতাশার ব্যাপার যে অনেক বছর ধরে বিশ্বকাপ জিততে পারে না আর্জেন্টিনা।
প্রশ্ন :
পুরোনো ম্যাগাজিনে পড়েছি, সেবার আর্জেন্টিনার মানুষও আশা করেননি, আপনারা বিশ্বকাপ জিতবেন। আপনাদের বিশ্বকাপ জয়ের রেসিপি কী ছিল?
বুরুচাগা: শুরুতে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিকেরা কেউই আমাদের দলের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন না। কারণ, বিশ্বকাপের আগে অনুশীলন ম্যাচগুলোতে আমরা ভালো খেলতে পারিনি।
আমি ইউরোপ থেকে সরাসরি দলের সঙ্গে মেক্সিকোতে যোগ দিয়েছিলাম। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে শুনেছিলাম, বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার দিন বিমানবন্দরে কেউ দলকে শুভকামনা জানাতে আসেননি। এমনকি খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরাও নয়। আসলে কোনো মানুষ আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখেনি।
মেক্সিকোতে গিয়ে আমরাও কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। শুধু খেলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিলাম। কোচ কার্লোস বিলার্দোর নতুন দর্শনের প্রতি আমাদের খেলোয়াড়দের পূর্ণ আস্থা ছিল। বিশ্বকাপ জেতার পর তো সবাই বিলার্দোর ফুটবল-কৌশলকে নকল করার চেষ্টা করেছে। আমরা মেক্সিকোতে জীবনের সেরা খেলাটাই খেলেছি।
প্রশ্ন :
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে ম্যারাডোনার মতো আপনারও অনেক অবদান ছিল। কিন্তু আপনাকে তো আর্জেন্টিনায় সেভাবে জনপ্রিয়তা পেতে দেখা যায়নি!
বুরুচাগা: জনপ্রিয়তা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। দলের খেলোয়াড়েরা সবাই জানত ডিয়েগো শুধু দলের-ই নয়, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। দলের সব খেলোয়াড়ই ডিয়েগোকে অনুসরণ করত। সে সব সময় চ্যাম্পিয়ন হতে চাইত।
আমাদেরও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাত। জনপ্রিয়তা নয়, আমি শুধু চ্যাম্পিয়নই হতে চেয়েছিলাম। ডিয়েগো ছিল আমাদের নেতা। আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানোর পরও দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ডিয়েগোর ব্যবহার ছিল আগের মতোই সাধারণ। সে কখনোই নিজেকে মহাতারকা ভাবত না।
প্রশ্ন :
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, আপনার সঙ্গে ম্যারাডোনার দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। আপনার মুখ থেকে সে গল্প শুনতে চাই।
বুরুচাগা: ডিয়েগোর সঙ্গে আমার খুবই ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সবার সঙ্গেই। মানুষ হিসেবে সে ছিল খুবই ভালো। দারুণ একজন নেতা। আমরা দুজন একসঙ্গে টানা দুটি বিশ্বকাপে ১১টি ম্যাচ খেলেছি।
আর্জেন্টিনা ফুটবলের ইতিহাসে ম্যারাডোনার সঙ্গে একমাত্র আমি টানা ৪০টি ম্যাচ খেলেছি। আমি তাকে সব সময় স্মরণ করি একজন চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় ও ভালো বন্ধু হিসেবে। আমরা একসঙ্গে দেশের জন্য লড়াই করেছি।
প্রশ্ন :
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আপনি ম্যারাডোনার বিখ্যাত দুটি গোলের সাক্ষী। একটি ‘হ্যান্ড অব গড’, আরেকটি ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’। দুটি গোল সম্পর্কে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
ডিয়েগো অনুশীলনেও এভাবে গোল করার চেষ্টা করত। মাঝে মাঝে গোলও করত। কিন্তু বিশ্বকাপে এভাবে গোল করার কাজটি ছিল কঠিন। কোথায় অনুশীলন আর কোথায় বিশ্বকাপ! ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের সময় আমি মাঠের অন্য প্রান্তে ছিলাম। আমি তাই সেভাবে তা দেখিনি।
আসলে ডিয়েগো খুবই স্মার্ট খেলোয়াড়, তার চতুরতা বুঝতে পারা অসম্ভব। তখন তো ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ইংল্যান্ডও এভাবে ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে (জিওফ হার্স্টের গোলের প্রতি ইঙ্গিত করে)। আজকের ভিএআর যুগে এভাবে গোল করা সম্ভব নয়।
এরপর পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করাটা তো বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাস। আমি সব সময় বলে আসছি, এটা ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোল। আমি খুবই খুশি যে এই গোলটার সময় আমি ম্যারাডোনার পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। আমিই বোধ হয় পুরো ব্যাপারটি সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা মানুষ।
প্রশ্ন :
এখন লিওনেল মেসির মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা কেন বিশ্বকাপ জিততে পারছে না?
বুরুচাগা: দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্বকাপ চার বছর পরপর হয় এবং আপনি সেখানে একটি ম্যাচ হেরে গেলেই আবার চার বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। খেলোয়াড়দের জন্য বিষয়টি খুবই হতাশার। কাতার বিশ্বকাপই মেসির জন্য শেষ সুযোগ।
সে খুব করে চাইবে, এই বিশ্বকাপটা জিততে। অনেক বছর পর আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ দিতে চায় সে। কিন্তু কখনো কখনো ফুটবলে আপনি যা চাইবেন, সব পাবেন না। টুর্নামেন্টে আপনি একদিন খারাপ খেলবেন, আর এতেই বিদায়।
সবাই ভাবেন, ম্যারাডোনা ছিল বলেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিততে পেরেছে। কিন্তু ম্যারাডোনা একা কখনোই বিশ্বকাপ জিততে পারত না, যদি আমরা তাকে সাহায্য না করতে পারতাম। ম্যারাডোনার আমাদের প্রয়োজন ছিল। আমরা সবাই সাফল্যের জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম। মেসিরও এমন দশ জন ভালো টিমমেট প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমি জানি, আর্জেন্টিনার ফুটবল সবাই পছন্দ করেন। বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু আর্জেন্টিনার খেলা পছন্দ করে, আমার মনে হয় বাংলাদেশও ভালো ফুটবল খেলে।
প্রশ্ন :
সর্বশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। বিশ্বকাপের মাঝে গুঞ্জন উঠেছিল, সাম্পাওলির জায়গায় আপনি কোচ হবেন। রাশিয়া বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
বুরুচাগা: আর্জেন্টিনা ফুটবলের জন্য সেই বিশ্বকাপটি ভালো যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এখন অনেক রকম কথা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাইরে ভুল তথ্য যাওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি ভালো হয়নি। সবার মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল না।
ফ্রান্সের মতো বড় দলের বিপক্ষে আমরা ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নিয়েছি। সেদিন আমরা খুব খারাপ খেলেছি। কোচ বদলের বিষয়টি ছিল গুঞ্জন। এর কোনো সম্ভাবনা ছিল না আর আমি কোচের দায়িত্ব গ্রহণও করতাম না। কারণ, আমি মনে করতাম, সাম্পাওলি শুরু করেছে এবং তিনিই শেষ করবেন। দলে আমার যে ভূমিকা ছিল, সেটাই ভালো ছিল।
প্রশ্ন :
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
বুরুচাগা: কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার খুব ভালো করার সুযোগ আছে। গত কিছুদিন দলটা খুব ভালো খেলছে। ব্রাজিলে গিয়ে কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। জাতীয় দলের জন্য এই শিরোপাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মেসি, দি মারিয়া, ওতামেন্দি—ওরা আর্জেন্টিনার সর্বশেষ সোনালি প্রজন্ম। ওরা কখনো বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। এবার কোপা আমেরিকা জেতার স্বাদ পেয়েছে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। জাতীয় দলের হয়ে মেসি এখন দুর্দান্ত খেলছে। সে এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী ও সময়টা উপভোগ করছে। বাকি খেলোয়াড়েরাও দুর্দান্ত খেলছে।
দলের রসায়নটা খুব ভালো। মেসি দলকে সাহায্য করছে এবং দলও মেসিকে সাহায্য করছে। মেসি এখন জাতীয় দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে। আশা করি, আর্জেন্টিনা এবার ফাইনালে খেলবে। আর্জেন্টিনা যদি এই পারফরম্যান্স নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে পারে, আশা করি বিশ্বকাপও জিতবে।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার প্রচুর সমর্থক আছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা আছে?
বুরুচাগা: বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমি জানি, আর্জেন্টিনার ফুটবল সবাই পছন্দ করেন। কারণ, সর্বশেষ ৪০ বছরে বিশ্বের সেরা দুজন খেলোয়াড় আর্জেন্টিনার—ম্যারাডোনা ও মেসি।
বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে অনেক মানুষ আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করেন। এটা খুবই আনন্দের যে বাংলাদেশের মানুষ আর্জেন্টিনার ফুটবলকে সমর্থন দেন। বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু আর্জেন্টিনার খেলা পছন্দ করে, আমার মনে হয় বাংলাদেশও ভালো ফুটবল খেলে। ভালো ফুটবলার আছে সেখানে।