মেসির জীবনের ‘ভিলেন’ এখন মেসির পাশেই বার্সায় খেলতে চান
মারিও গোৎসা এখন কোথায়?
ইউরোপের ফুটবল নিয়ে কুইজে বেশ ভালো একটা প্রশ্ন হতে পারে এটি। তাঁকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সমর্থকেরা আদরের স্মৃতিতে আঁকড়ে রাখেন, ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে গত দশকের শুরুর দিকে বেশ নজরকাড়া ডর্টমুন্ডের প্রাণভোমরা ছিলেন গোৎসা। রিয়াল মাদ্রিদ হয়তো তাঁকে মনে রাখে দুঃস্বপ্ন হিসেবে, ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে রিয়ালের বিপক্ষে ডর্টমুন্ডের জার্সিতে রবার্ট লেভানডফস্কির ‘লন্ডভন্ডস্কি’ হওয়ার দিনে আলো ছড়িয়েছিলেন গোৎসাও।
তবে তাঁকে ঘিরে সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন দেখে হয়তো আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির জীবনে যে বিশ্বকাপ একটা ট্র্যাজেডির গল্প হয়ে আছে, সে গল্পে সবচেয়ে বড় ভিলেন তো গোৎসাই। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়েছিলেন।
সময়ের ফেরে সেই গোৎসার ঠাঁই এখন নেদারল্যান্ডসের ক্লাব পিএসভি আইন্দহফেনে। তবে সেখান থেকে আবার ইউরোপের বড় কোনো ক্লাবে যেতে চাইছেন ২৮ বছর বয়সী জার্মান ফরোয়ার্ড। যে-সে ক্লাব নয়, তাঁর ইচ্ছা বার্সেলোনায় যাওয়া। যাঁকে জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বমঞ্চে কাঁদিয়েছেন, সেই মেসির সঙ্গে বার্সার জার্সিতে জুটি গড়া!
২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের সে স্মৃতি আর্জেন্টিনার কোন ভক্ত ভুলতে পারবে! জার্মানিও ভুলবে না কোনো দিন। আর্জেন্টিনা হয়তো একটু বেশি মনে রাখবে সেটি তাঁদের অনেক আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত গভীর হতাশায় ডুবিয়েছে বলে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে বিশ্বমঞ্চে বিবর্ণ আর্জেন্টিনা সেবার মেসির হাত ধরে ফাইনালে উঠেছিল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী ব্রাজিলের বিখ্যাত মাঠ মারাকানায় ফাইনাল, সেখানে ম্যারাডোনারই উত্তরসূরি মেসির হাত ধরে ঘুচবে বিশ্বকাপের অপেক্ষা...আর্জেন্টিনার এই সুখকল্পনার বাকবাকুম থেমেছে ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে।
১১৩ মিনিট। তখনো ম্যাচ গোলশূন্য। আর্জেন্টিনার হয়ে গঞ্জালো হিগুয়েইন ও রদ্রিগো পালাসিও দুটি সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছেন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মেসিও এমন এক সুযোগে গোল করতে ব্যর্থ, যেটিতে বার্সেলোনার জার্সিতে হয়তো চোখ বন্ধ করে গোল করতে পারবেন! ব্যর্থতাগুলোর কষ্ট চিরস্থায়ী করে দিলেন কিছুক্ষণ আগেই বদলি নামা গোৎসা। বাঁ দিক থেকে আন্দ্রে শুরলার ক্রসে তাঁর দারুণ ভলি জড়িয়ে গেল আর্জেন্টিনার জালে, বাকি সাত মিনিটে আর গোলটা ফেরত দেওয়া সাধ্যে কুলায়নি আর্জেন্টিনার।
মেসি সেই বিশ্বকাপের পর একই রকমই আছেন। আরও দুবার কোপা আমেরিকায় ফাইনালে উঠেও আর্জেন্টিনার জার্সিতে শূন্যতা ঘোচাতে পারেননি। বার্সেলোনার জার্সিতে একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। কিন্তু ক্রমেই তাঁর ওপর অতিনির্ভর হয়ে পড়া বার্সাকে এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ পর্যন্ত নিতে পারেননি। লিগ-টিগ অবশ্য জিতেছেন নিয়মিতই।
কিন্তু গোৎসা? ওই বিশ্বকাপের আগের মৌসুমেই আঁতুড়ঘর ডর্টমুন্ডের সমর্থকদের হৃদয় ভেঙে বায়ার্ন মিউনিখে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আলো ছড়াতে পারেননি মোটেও। এর মধ্যে তাঁর শারীরিক কিছু সমস্যায় (মেটাবলিজম–সম্পর্কিত) ফিটনেস গেল হারিয়ে। ডর্টমুন্ড তাঁকে আবার অনেক আবেগে জড়িয়ে ঠিক করার চেষ্টায় ফিরিয়ে এনেছিল ২০১৬ সালে, লাভ হয়নি। চার বছর সেখানে থেকে গত মৌসুমে যোগ দেন পিএসভি আইন্দহফেনে।
সেখানে অবশ্য একেবারে খারাপ করছেন না। ফরোয়ার্ড থেকে নিচে নেমে এখন মাঝমাঠেই বেশি খেলেন, কখনো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে, কখনো–বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। এই করেই এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ২৬ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল, করিয়েছেন আরও ৫টি। স্বপ্ন এখন তাঁর আবার পুরোনো দিন ফেরানোর এবং সেটা বার্সার জার্সিতে, মেসির পাশে। জার্মান মাসিক সাময়িকী ইলেভেন ফ্রউন্দেতে স্বপ্নটার কথা জানিয়েছেন গোৎসা, ‘এই দলটার (বার্সেলোনা) বল পায়ে রেখে খেলার ধরনে খেলা, লিওনেল মেসির পাশে...ওটা হতো স্বপ্নের মতো। আমি আরেকবার চ্যাম্পিয়নস লিগেও খেলতে চাই।’
কিন্তু সে তো স্বপ্ন, বাস্তবে ফিরে এলে গোৎসা বোঝেন, বার্সেলোনা কিংবা ইউরোপের বড় কোনো ক্লাবে খেলতে গেলে তাঁকে আরও অনেক ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে হবে। সে কারণে তাঁর বাস্তবতাবোধ তাঁকে পিএসভিতেই ২০২২ সালে শেষ হতে যাওয়া চুক্তিটা নবায়নের পরামর্শ দেয়। সেখানে যদিও একটা শর্ত রেখে দিতে চান গোৎসা, যে শর্তে জড়িয়ে পিএসভি কোচ রজার স্মিট। গোৎসার কথা, ‘যদি রজার ক্লাব ছাড়তে চায়, সে ক্ষেত্রে আমি অন্য কিছু ভাবব। পিএসভির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়েই আছে যে দারুণ কোনো প্রস্তাব এলে আমরা সেটি নিয়ে আলোচনায় বসব।’
এ তো গেল ক্লাব ফুটবলে স্বপ্ন-বাস্তবতার কথা, জাতীয় দলে গোৎসা আর নিজেকে খেলতে দেখেন? ২০১৮ সালে সর্বশেষ খেলেছিলেন, অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন তারও অনেক আগে থেকেই। আগামী জুনে হতে যাওয়া ইউরোর পর জার্মানি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া বর্তমান কোচ ইওয়াখিম ল্যুভ কিছুদিন আগে আভাস দিয়ে রেখেছিলেন, পিএসভির জার্সিতে গোৎসা এভাবে আরও ধারাবাহিক হয়ে খেলে যেতে থাকলে জার্মানির জার্সিতে ডাক পেলেও পেতে পারেন। এই মাসের শেষ দিকে ইউরোর দল ঘোষণা করার কথা ল্যুভের, সে দলে ফেরার আশা দেখেন গোৎসা? কিংবা ইউরোর পরেই হোক, জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন আর দেখেন?
বাস্তব সম্ভাবনা অত বেশি নয়, তা নিজেও বোঝেন। বয়স একেবারে বেশি না হলেও কালে কালে বেলাও কম গড়ায়নি। তবে জার্মানির জার্সিতে ফেরার স্বপ্নটা ঠিকই দেখেন গোৎসা, ‘জাতীয় দলে জার্মানির সেরা খেলোয়াড়দেরই একসঙ্গে খেলা উচিত। তা না হলে বড় দলগুলোর বিপক্ষে ভালো খেলা মুশকিল হয়ে যাবে। ইয়োগির (ল্যুভ) উত্তরসূরিও নিশ্চিত এভাবেই ভাববেন। আর এটা পরিষ্কার, আরেকবার জাতীয় দলে খেলতে হলে আমাকে ধারাবাহিকভাবে খুব ভালো খেলে যেতে হবে।’
তেমন করতে পারলে, কে জানে, বার্সাও হয়তো তাঁকে পেতে প্রস্তাব পাঠিয়ে বসবে পিএসভির কাছে!