মেসির এই ভালোবাসার গল্পটা পূর্ণতা পায়নি
‘কাদিজ খুব সুন্দর একটা শহর। ওখানে খেলতে পারলে ভালো লাগবে আমার।’
২০০৫ রামোন দে কারানসা ট্রফির ফাইনাল। মুখোমুখি বার্সেলোনা ও কাদিজ। বার্সার জার্সিতে গা গরম করছেন ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ। বয়স আর কতই-বা, ১৮ হবে। জার্সির নম্বর ৩০, নামের জায়গাটায় লেখা—মেসি। কথাগুলো তিনিই বলছিলেন। শ্রোতা—কাদিজের সহকারী কোচ লুইস সোলের।
রোনালদিনিওর জোড়া গোল আর সামুয়েল ইতোর গোল মিলিয়ে ম্যাচটা ৩-১ গোলে সেদিন জেতে বার্সেলোনা। বিস্ময়বালক হয়ে আবির্ভূত লিওনেল মেসি নামের প্রতিভা সেদিন একাদশেও ছিলেন। কিন্তু মৌসুমে সেবার বার্সার হয়ে খেলার সুযোগ তেমন পাবেন কি না, তা ছিল সংশয়ে।
১৩ বছর বিরতির পর সেবার লা লিগায় উঠে আসে কাদিজ। নামী খেলোয়াড় কেনার টাকা তো তেমন নেই, এদিক-সেদিক থেকে তরুণ প্রতিভাকে কম দামে কিংবা ধারে নিয়ে আসার চেষ্টা ক্লাবটার। যে প্রতিভাগুলোর দিকে এখনো ইউরোপের বড় ক্লাবের চোখ পড়েনি, কিংবা যে প্রতিভাগুলো বড় ক্লাবে আছেন কিন্তু সেখানে সুযোগ পান না। মেসি যখন সোলেরকে কথাগুলো বলছিলেন, তার আগেই বাজারে চাউর হয়ে যাওয়া গুঞ্জন—মেসিকে ধারে আনতে চেষ্টা চালাচ্ছে কাদিজ।
বার্সার জার্সিতে তার আগের মৌসুমেই অভিষেক হয়ে যায় মেসির। নয়টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচও খেলেছেন প্রথম মৌসুমে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে অভিষেক তার কদিন বাদেই হয়েছে। কিন্তু ২০০৫-০৬ মৌসুমের শুরুতে আলোচনা, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের সেই বার্সেলোনা দলে মেসির জায়গা নিশ্চিত নয়। প্রতিভা যতই হোক, তরুণ একজনকে খেলানোয় ঝুঁকি আছে—কোচদের চিরায়ত এই সাবধানী মানসিকতাই কি তবে মেসির বার্সায় নিয়মিত হওয়ায় বাধা ছিল?
না। কারণ অন্য। ক্লাবে ইউরোপের বাইরের খেলোয়াড়ের কোটা নির্দিষ্ট—৩ জন, সেই মৌসুমে ওই কোটা আগেই রোনালদিনিও, ইতো আর রাফায়েল মার্কেজের মতো মাঠ মাতানো খেলোয়াড়দের দিয়ে পূরণ করে ফেলেছে বার্সেলোনা। তাহলে মেসির জায়গা কীভাবে হবে? লিগের প্রথম পাঁচ ম্যাচে মেসি তাই দলে নেই। যদিও চ্যাম্পিয়নস লিগে ওই নিয়মের বালাই ছিল না বলে ভেরডার ব্রেমেন ও উদিনেসের বিপক্ষে খেলেছেন মেসি।
কাদিজ এই অনিশ্চয়তার সুযোগটা নিতে চেয়েছিল। এরই মধ্যে আরেক অখ্যাত কিন্তু প্রতিভাবান ব্রাজিলিয়ান লেফটব্যাকের দিকেও চোখ পড়েছিল কাদিজের, রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা নামটা চিনে থাকবেন—মার্সেলো! তিনি আর মেসি—দুজনকেই ধারে নিতে চেয়েছিল কাদিজ।
‘আমরা বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে আনতে চেয়েছিলাম যারা কিছু করে দেখাতে চায়, শুধু মেসিই নয়, মার্সেলোকেও’—গোলডটকমকে বলছিলেন সে সময়ে কাদিজের ক্রীড়া পরিচালক আলভারো বেনিতো।
মেসিকে আরও অনেক দিন ধরেই চোখে চোখে রেখেছিলেন বলেও জানালেন বেনিতো, ‘আমরাই সবার আগে চেষ্টা করেছিলাম ওর জন্য। ওকে বয়সভিত্তিক দলগুলোর হয়ে খেলতে দেখেছি আমি, কলম্বিয়ায় আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়েও খেলতে দেখেছি। সে কারণে আর্জেন্টিনার মানুষ ওকে যতটা চিনত, তার চেয়েও আমি বেশি জানতাম ও কী করতে পারে।’ বার্সার কাছে তাই মেসির জন্য ধরনা দিয়েছিলেন বেনিতো, ‘টিকি বেগিরিস্তাইনের (সে সময়ে বার্সার ক্রীড়া পরিচালক) সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল, কারণ এর আগে বার্সার বি দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম আমরা। মেসিকে ওরা সেভাবে সুযোগ না দিলে সে ক্ষেত্রে ওকে আমাদের কাছে ধারে দিয়ে দিতেও অনুরোধ করেছিলাম।’
মেসিকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে মনে দ্বিধা থাকলেও বেগিরিস্তাইন সরাসরি না বলেননি। বার্সা মেসিকে ক্লাবেই রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ে ধোঁয়াশার কারণে বার্সা বা মেসি কেউই ধারে যাওয়ার ব্যাপারটি উড়িয়ে দেননি।
মেসির বাবার সঙ্গে কথা বলেনি কাদিজ, তবে পাঁচ বছর আগে যাঁদের চেষ্টায় মেসির বার্সায় আসা, তাঁদের একজন হোরাসিও ফার্নান্দেজের কাছে ঠিকই ধরনা দিয়েছিল কাদিজ।
কিন্তু গল্পটা আর পূর্ণতা পায়নি। কাহিনিতে আসে অন্য টুইস্ট!
কারানসা ট্রফিতে যখন খেলছেন মেসি, তাঁর স্প্যানিশ পাসপোর্ট পাওয়ার প্রক্রিয়া তত দিনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। বার্সা তাই অপেক্ষায় ছিল। মেসি স্প্যানিশ পাসপোর্ট পেয়ে গেলেই যে তাঁকে আর ‘অ-ইউরোপীয়’ খেলোয়াড় হয়ে খেলতে হবে না! সে ক্ষেত্রে তাঁকে ধারে পাঠানোরও আর দরকার পড়বে না—এ-ই ছিল বার্সার হিসেব। অবশেষে সে বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর এল সেই দিন। আর্জেন্টিনার পাশাপাশি মেসি পেয়ে গেলেন স্পেনের নাগরিকত্বসূচক পাসপোর্টও।
‘শেষ পর্যন্ত ওটা (মেসিকে ধারে আনা) আর হয়নি কারণ বার্সা চায়নি ওকে ছাড়তে। রাইকার্ডও মূল দলে ওর ওপর ভরসা রাখতে শুরু করেন’—বলছিলেন বেনিতো। অক্টোবর থেকেই মূল দলে নিয়মিত হয়ে ওঠা শুরু মেসির। ডিসেম্বরে আবার যখন লিগে কাদিজের মাঠে গেল বার্সা, তত দিনে মেসিকে চেয়েও কাদিজের না পাওয়ার গল্প জেনে যাওয়া কাদিজ সমর্থকেরা মাঠে মেসির জন্য কোরাস তোলেন, ‘মেসি, চলে এসো।’
‘প্রতিবছরই লা মাসিয়া থেকে অনেক রত্ন উঠে আসে, কিন্তু অনেকেই মূল দল থেকে বাদ পড়ে যায়। মেসির ক্ষেত্রে এমন কিছু হলে আমরা তৈরি ছিলাম (মেসিকে নেওয়ার জন্য)। কাদিজে ওর এমন কিছু অভিজ্ঞতা হতো যেটা বার্সেলোনায় কখনোই হতো না। যেমন এখানে খেলোয়াড়দের জন্য সমর্থকদের যে প্যাশন সেটা অনেকটা আর্জেন্টাইন দলগুলোর মতোই’—বেনিতোর বিশ্লেষণ।
কাদিজের জন্য দুঃসংবাদ, বার্সেলোনায় দ্রুতই মূল একাদশেই জায়গা পাকা করে নেন মেসি। সেই মৌসুমে (২০০৫-০৬) লিগে ১৭টি ম্যাচে নেমেছেন, মার্চে চোটে পড়ে বাকি মৌসুমের জন্য মাঠের বাইরে চলে না গেলে সংখ্যাটা আরও বাড়ত। সেবার বার্সেলোনার লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের শেষ ভাগটা তাই দর্শক হয়েই দেখতে হয় মেসিকে।
সে আক্ষেপ এখনো মেসিকে পোড়ায় কি না, কে জানে! পরের ১৫ বছরে বার্সাকে তো কম জেতাননি! তবে তাঁকে না পাওয়ার আক্ষেপটা কাদিজের না থেকে পারে না। আজ যখন লিগে নিজেদের মাঠে বার্সার বিপক্ষে নামবে কাদিজ, এবার আর মেসিকে চলে আসতে অনুরোধ করে গান গাওয়ার মতো কোনো কাদিজ সমর্থক করোনার কারণে মাঠে থাকবেন না ঠিকই, তবে মেসিকে দেখে তাঁদের হয়তো দীর্ঘশ্বাস ঝরবে।
দীর্ঘশ্বাসটা অনুচ্চারে বলবে, গল্পটা অন্য রকম হলেও হতে পারত!