মেসিই কি আসল সমস্যা আর্জেন্টিনার?
রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলতে পারবে কি না, সেটি নিশ্চিত ছিল না বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচের আগেও। অনেক সমীকরণ সামনে রেখে আর্জেন্টিনাকে ইকুয়েডরের বিপক্ষে জিততেই হতো। সেটিও ইকুয়েডরের মাঠে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ ফুট উচ্চতায়। ৫ মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে কাজটা আরও কঠিন করে তোলে আর্জেন্টিনা। তারপরেই মেসি-ঝলক। হ্যাটট্রিক করে দলকে খাদের কিনারা থেকে উঠিয়ে বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পাইয়ে দেন। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার দুরবস্থার জন্য কিনা সেই মেসিকেই দায় দেওয়া হচ্ছে। আসলেই কি দোষী মেসি?
সর্বকালের সেরা নিয়ে যে বিতর্কটি চলে সেখানে মেসির দুর্বলতা হিসেবে দেখানো হয় আর্জেন্টিনার হয়ে বড় কোনো শিরোপা না জিততে পারা। সর্বকালের সেরা হতে হলে মেসিকে বিশ্বকাপ জিততেই হবে, এর পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধরনের বক্তব্য আছে। আধুনিক ফুটবলে নিজেকে সেরা প্রমাণের একমাত্র জায়গা বিশ্বকাপ নয়। পেলে কিংবা ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে যেমনটা ছিল। এখন চ্যাম্পিয়নস লিগ মানে, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব পিছিয়ে থাকা টুর্নামেন্ট নয়। সেখানে সেরাদের সঙ্গে লড়াই করেই জিততে হয়।
বিশ্বকাপ না জিতলেও মেসি মেসিই থাকবেন। তাই বলে বিশ্বকাপে মেসির না-পারাকে হালকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। শুধু প্রশ্নটা এখানে থেকে যায়, মেসির এই না-পারায় তাঁর নিজের দায় কতটা? এমন তো নয়, জাদুমন্ত্রের বশে তাঁকে বিবশ করে রাখা হয়। চাপ নিতে পারেন না? নেইমারকে হারিয়ে টালমাটাল বার্সেলোনার এবারের মৌসুমে পুরো চাপ সামলানো কাঁধটার নাম লিওনেল মেসিই। চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা কোপা ডেল রের ফাইনাল, সেমিফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনালে মেসির ঝলসে ওঠা পারফরম্যান্সের নজির আছে ঢের। কেবল একটি বিশ্বকাপ না জিততে পারলে তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন হবেন না, এ কথাটি ধোপে টিকবে না। একই কথা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তবু প্রশ্ন ওঠে। রোনালদো তো পেরেছেন, মেসি কেন পারছেন না? আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি কেন অনুজ্জ্বল? এর উত্তর খুঁজতে যেতে হবে গভীরে।
প্রথমত, মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে সফল নন, এই প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ আছে। টানা তিনটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা কি তবে ব্যর্থতা? এবারের বাছাই পর্ব মেসি বাদে আর্জেন্টিনার বাকিদের গোল কত? এবারের বাছাই পর্বে মেসি খেলেছেন আর মেসি খেলেননি এমন ম্যাচে আর্জেন্টিনার ফল কেমন?
উত্তরটা বলে দেবে, মেসি কী করে একা কাঁধে আর্জেন্টিনাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। তবু তাঁকে ব্যর্থই দেখায়। দিশেহারা আর্জেন্টিনা চায়, মেসি মাঝমাঠ থেকে খেলা গড়বেন, আবার গোলও করবেন। পারলে মেসি যেন ডিফেন্সও সামলে দিয়ে যান।
অথচ লিওনেল মেসির সতীর্থদের নাম ডি মারিয়া-আগুয়েরো-হিগুয়েইন-দিবালারা। ক্লাবে যাঁরা বড় তারকা। তারকা ছিলেন হাভিয়ের মাচেরানো। তাহলে? সতীর্থরা আসলে বেশির ভাগ সময় মেসির বাধা। আর্জেন্টিনার খেলার কৌশলই হলো, মেসিকে বল দাও, সে কিছু করতে পারলে দল জিতবে, মেসি ব্যর্থ তো আর্জেন্টিনাও ব্যর্থ। মূল কারণটা অবশ্যই মানসিক বাধা। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচেই দেখা গিয়েছে, মার্সেলো ব্রজোভিচকে দিয়ে মেসির কাছে বল যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতেই পুরো আর্জেন্টিনা অফ!
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বাকি স্কোয়াড নিয়েই। তারকাসমৃদ্ধ আক্রমণভাগের পেছনে যে মাঝমাঠ নিয়ে রাশিয়া এসেছে আর্জেন্টিনা, সেই মাঝমাঠ সাম্পাওলির দর্শনের সঙ্গে কতটা মানায়, সেটিই প্রশ্ন। সাম্পাওলির হাই প্রেসিং, গতিশীল ফুটবল দর্শনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন, মাঝমাঠে তেমন কোনো খেলোয়াড়ই নেই আর্জেন্টিনার। এটি জেনেও সাম্পাওলি তাঁর দর্শনে অটুট। সাম্পাওলির কাছে আছে শুধু ভাত আর আলু, তিনি রান্না করতে চাইছেন বিরিয়ানি।
রক্ষণভাগ আরও যাচ্ছেতাই। ফেদেরিকো ফাজিও, নিকোলাস ওটামেন্ডি, মার্কোস রোহো, গ্যাব্রিয়েল মার্কাদোর কেউই বিশ্বমানের কাতারে পড়েন না। ওটামেন্ডি ছাড়া নিজেদের ক্লাবেও নিয়মিত নন তাঁদের কেউই। আর্জেন্টিনার রাইট ব্যাক হিসেবে খেলছেন এদুয়ার্দো সালভিও, আদতে যিনি মনেপ্রাণে একজন রাইট উইঙ্গার। লেফট ব্যাক হিসেবে আছেন নিকোলাস টাগলিয়াফিকো, আন্তর্জাতিক মঞ্চে যিনি এসেছেন মাত্র ৩ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে।
গোলকিপিংয়ে মূল ভরসা সার্জিও রোমেরো আগেই চোটের কারণে ছিটকে গিয়েছেন। তাঁর জায়গায় খেলা কাবায়েরো ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কী করেছেন সেটি সবাই দেখেছে। অন্য পজিশনের খেলোয়াড়কে দিয়ে তৈরি করা রক্ষণভাগই আর্জেন্টিনার রক্ষণের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। এই দলের গোলরক্ষক যে কাবায়েরো, আর দলের সেরা ডিফেন্ডার যে ওটামেন্ডি; সেটিও নিশ্চয়ই মেসির দোষ নয়!
আর্জেন্টিনার সব শক্তি যেন ওই এক জায়গাতেই আবদ্ধ, মেসি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের উদাহরণই দেওয়া যাক। পর্তুগাল দলে একমাত্র মহাতারকা রোনালদো। তার পরও পারফর্ম করার জন্য রোনালদোর পেছনে বিশ্বাসযোগ্য একটি দল রয়েছে। এখানেই মেসি যেন রোনালদোর ঠিক উল্টো মেরুতে। মহাসমুদ্রে দিক হারানো এক জাহাজের নাবিক তিনি, তাঁকে পথ দেখানোর কেউ নেই, যুদ্ধ করে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত এক সেনাপতি তিনি, তাঁকে সাহায্য করার কেউ নেই।
আরও পড়ুন:
সাম্পাওলির ট্যাকটিকসে সমস্যা যেখানে
তৃতীয় পর্বে পড়ুন: কেন আর্জেন্টিনা ভালো ডিফেন্ডার পায় না