মেসি-রোনালদো: শেষের শুরু?
দুজনের উচ্চাশার কমতি ছিল না কখনোই।
অবশ্য কথাটা যখন লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে হচ্ছে, প্রায় দুই দশক ধরে দুজনের ফুটবলীয় রাজত্বের মুগ্ধ দর্শক হয়ে থাকার পর তাঁদের উচ্চাশা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। উচ্চাশার সঙ্গে ‘লড়াকু মানসিকতা’র কথাও আসে এখানে। ৩৪ পেরিয়েও দুজন একই রকম লড়াকু। হারার আগে হার মানতে চান না। দৃষ্টিসীমায় ব্যক্তিগত ও দলগত যত পুরস্কার আছে, সব নিজের করে নিতে চান।
যে বয়সে এসে বিশ্বের অধিকাংশ খেলোয়াড় বুটজোড়া তুলে রাখার চিন্তা মাথায় নিয়ে নেন, সে বয়সে এই দুজনের মাথায় তখন ঘোরে গোলের হিসাব, নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যাওয়ার ভাবনা। আর দশজনের সঙ্গে দুজনকে আলাদা করে দেয় এই উচ্চাশা আর লড়াকু মানসিকতাই।
উচ্চাশার কারণে মৌসুমের শুরুতে ক্লাব বদল করেছিলেন দুজন। প্রিয় বার্সেলোনার স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে মেসি পাড়ি জমিয়েছিলেন অজানা প্যারিসে। রোনালদো অবশ্য পুরোপুরি মেসির মতো অদৃষ্টের হাতে নিজের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেননি। জুভেন্টাস থেকে ফিরেছিলেন আঁতুড়ঘরে। যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আজকের তারকা রোনালদোর জন্ম দিয়েছিল, সে ইউনাইটেডই ১৩ বছর পর দুহাত বাড়িয়ে টেনে নেয় পর্তুগিজ রাজপুত্রকে। দুজনই বুঝেছিলেন, বার্সেলোনা কিংবা জুভেন্টাস—নিজেদের উচ্চাশার সঙ্গে দুই দলের সামর্থ্য ঠিক মিলছিল না।
ওদিকে ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোতে নিয়মিত শক্তির স্বাক্ষর রাখা পিএসজি চেয়েছিল মেসিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের অধরা শিরোপাটা স্পর্শ করতে। টানা চার মৌসুম শিরোপার স্বাদ না পাওয়া ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের লক্ষ্যও পিএসজির চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। তারা ভেবেছিল, ঘরের ছেলের সঙ্গে সঙ্গে ওল্ড ট্রাফোর্ডে আবারও প্রবেশ করবে সাফল্য-সানাইয়ের সুর।
কিন্তু গত রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে রোনালদোর ইউনাইটেডের পরাজয় যখন নিশ্চিত হলো, সাফল্য-সানাইয়ের সে সুরও দূরে মিলিয়ে গেল। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে গত সপ্তাহেই চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে হেরে বিদায় নেওয়া মেসি সে ব্যথা বুঝবেন ভালো।
আগস্ট থেকে মার্চ। মাত্র সাত-আট মাসের ব্যবধানেই স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই কথা, যা গুঞ্জন হয়ে কিছুদিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছিল ফুটবল-বিশ্বের কোনায় কোনায় মেসি-রোনালদোর দিন নেই আর। প্রায় দুই দশক ধরে ফুটবল-বিশ্বকে শাসন করা দুই রাজার প্রতাপ এখন অস্তগামী। হ্যাঁ, ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় এখনো সবাই চোখ বন্ধ করে দুজনের নাম নেবেন ঠিকই, কিন্তু বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মেসি-রোনালদোর নাম উচ্চারণ করতে একটু দ্বিধা, একটু সংশয় ঠোঁটের কোনায় এসে হাজির হবে। যে সংশয়ের উপস্থিতি গত দেড় দশকে ছিল না অন্তত। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আর্লিং হরলান্ড, মোহাম্মদ সালাহ কিংবা রবার্ট লেভানডফস্কিরাই জন্ম দেবেন, দিচ্ছেন সেই সংশয়ের।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মেসি-রোনালদোর মতো বর্তমান সময়ের দুই বড় তারকা এমবাপ্পে ও হরলান্ডও তো বিদায় নিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চ থেকে। তার মানে কি এই যে তাঁরাও ফুরিয়ে যাচ্ছেন? ফুল হয়ে পুরোপুরি ফোটার আগেই ঝরে যাচ্ছেন? না, সেটা বলা যাবে না। কারণ, তাঁদের পক্ষে আছে এমন এক জিনিস, মেসি-রোনালদোর কাছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা ফুরিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে—সময়, বয়স।
এমবাপ্পের বয়স ২৩, হরলান্ড ছাড়িয়েছেন ২১। বিশ্ব শাসন করার যথেষ্ট সময় আছে তাঁদের যাত্রাপথে। মেসি-রোনালদো কি সে দাবি করতে পারবেন?
রোনালদো বহু আগে থেকেই আগের রোনালদো নেই। দর্শকদের পায়ের জাদু দেখিয়ে মোহাবিষ্ট করার চেয়ে এখন বক্সে বসে গোল করার দিকেই বেশি মনোযোগ তাঁর। খেলোয়াড়ি সৌন্দর্য নয়, নিরন্তর জয়ের আশা রোনালদোকে আগ্রহী করে তুলেছে ফুটবলীয় পরিসংখ্যানের দিকে। ওদিকে পায়ের জাদু দেখানোর দিক দিয়ে মেসি এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তাঁর খেলাও যে এখন আর নিখুঁত নেই, মাঝেমধ্যেই তা বোঝা যায়। মেসির খেলা দেখলে আধুনিক ফুটবল-কৌশলের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ প্রেসিংয়ের হদিস পাওয়া যায় না। অথচ আধুনিক ফরোয়ার্ড হয়ে ওঠার জন্য প্রেসিংয়ের বিকল্প নেই।
এখন যেকোনো মেসি বা রোনালদোর ভক্ত হা রে রে করে তেড়ে আসবেন, নিশ্চিত। বলবেন, মেসি কি তবে আধুনিক ফরোয়ার্ড নন? রোনালদো কি আধুনিক নন? অবশ্যই তাঁরা আধুনিক। আধুনিকের চেয়ে বেশি আধুনিক। সে আধুনিকতাটা আর দশজন ফরোয়ার্ডের মতো এখন আর খুঁতহীন নেই, এই আরকি। খুঁত থাকা আধুনিক ফরোয়ার্ড তো সালাহ-লেভানডফস্কি-এমবাপ্পে-হরলান্ডও। তার মানে কি এই দুই মহারথী শেষমেশ আর দশটা বিশ্বমানের ফরোয়ার্ডের কাতারেই নেমে আসছেন না? এত দিন তো সবাই এ দুজনকে ভিনগ্রহের বলেই চিনে এসেছে!
টানা দুই বছর মেসি ও রোনালদোর দল চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিল। রিয়াল ছাড়ার পর ফাইনালের স্বাদই পাওয়া হয়নি রোনালদোর। ওদিকে মেসি টানা তিন বছর ধরে উঠতে পারছেন না সেমিতে। শিরোপা? দূর অস্ত!
আগামী বছর ইউরোপীয় ক্লাব প্রতিযোগিতার এ আসরে দুজনের কারোর হাতে শিরোপা উঠবে, বাস্তবতার করাঘাতে সে আশাটাও বেশ অলীক ঠেকছে। স্কাই স্পোর্টসের এক অনুষ্ঠানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি রাইটব্যাক গ্যারি নেভিল কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, ‘ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের কাউকে যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন, কোন খেলোয়াড়কে তাঁরা নিজের ক্লাবের হয়ে কিনতে চান, কেউ মেসি-রোনালদোর নাম নেবে না। সবাই হয় লেভানডফস্কি, নয় সালাহ কিংবা এমবাপ্পে-হরলান্ডের নাম বলবে।’
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেভিলদের মতো সংশয়বাদীদের মুখ বন্ধ করে আসার কাজটা গত দুই দশকে মেসি-রোনালদোর চেয়ে ভালোভাবে কেউ করে দেখাননি। আবারও কি পারফরম্যান্সের আলোকচ্ছ্বটায় সংশয়বাদীদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন তাঁরা? যদি পারেন, তাতে আপামর ফুটবলপ্রেমীদেরই মঙ্গল।
তত দিন পর্যন্ত দুজনের ক্রমশ অস্তাচলযাত্রা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই।