মৃত স্ত্রী দেন শক্তি, বর্তমান স্ত্রী জোগান অনুপ্রেরণা
বাসায় পা রাখতেই চোখ পড়ে পাশাপাশি দুটি ছবিতে। দুই ছবিতে মিল বলতে একজনের মুখ, সোহেল রানার। বাঁ পাশের বড় ছবিতে সোহেলের সঙ্গী একজন নারী ও বাচ্চা।
ডান পাশের অপেক্ষাকৃত ছোট ছবিতেও তা–ই, নারী ও বাচ্চার সঙ্গে সোহেল। ছোট শিশু নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কোনো আনন্দময় পারিবারিক মুহূর্তের স্মৃতি ধারণ করে রাখা দুটি ছবি।
এমন পরিস্থিতিতে সবার আগে যে প্রশ্ন মাথায় আসে, সোহেলের দুই স্ত্রী? ব্যক্তিজীবনে অনুপ্রবেশ মনে হলেও এমন দৃশ্যে কৌতূহল জাগাটা ঠিক অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ছবি দুটোর পেছনের গল্প আপনাকে কাঁদাবে, চোখের জল পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার আগে মুখে একচিলতে হাসিও হয়তো ফোটাবে।
একটি ছবি সোহেলকে দেয় শক্তি আর ডানের ছবি জোগায় শোক সামাল দিয়ে সামনে চলার অনুপ্রেরণা।
বাঁ পাশের ছবিটি বড়। গল্পটা সেখান থেকেই শুরু করা যাক। ফুটবলার স্বামী মাঠে গেলেই জায়নামাজে বসতেন তাসলিমা আফরিন (ঝুমা)। দুই হাত তুলে দোয়া করতেন। ভালো খেলুক, সুস্থ শরীর নিয়ে ফিরে আসুক ঘরে।
‘বাবা ভু. . বাবা ভুহহহ...’—বাবার কোলে চড়ে এভাবেই কল্পিত গাড়ি চালাত দুই বছরের আবদুল্লাহ আফরান। বাবার বুট, জার্সি-প্যান্ট নিয়ে খেলা করে সময় কাটত সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটির। ২৪ নভেম্বর ২০১৮, সোহেলের জীবনের সবচেয়ে কালো দিন। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সোহেলকে একা রেখে চলে গেছেন স্ত্রী তাসলিমা ও ছেলে আফরান।
সোহেল অবশ্য পুরোপুরি হারাতে দেননি তাঁদের। তাসলিমা ও আফরান এখনো সোহেলকে সঙ্গ দেয় ছবি হয়ে।
এবার চলুন পরের ছবির গল্পে। ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন সোহেল। নতুন সংসার তাঁর অন্ধকার জেকে বসা দিনগুলোয় আলো ফিরিয়েছে। স্ত্রী শম্পা আক্তারের কোলজুড়ে এসেছে এক ছেলে। ঢাকার লালমাটিয়ায় সোহেল-শম্পার সুখের সংসার। সে সুখের ভাগ পাচ্ছেন ফ্রেমে বন্দী তাসলিমা ও আবদুল্লাহ।
নতুন সংসারে শুধু বাসার ড্রয়িংরুমেই তাঁদের অস্তিত্ব নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই প্রয়াত দুজন মানুষ বাস করে সোহেলের সঙ্গে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে আবাহনী লিমিটেডকে জেতানোর পরই সোহেলের গল্পটি আলোচনায় আসে।
বক্সের বাইরে থেকে বুলেটগতির শটে দুর্দান্ত গোল করে জার্সি উঁচিয়ে ধরেন সোহেল। জার্সির নিচে হলুদ গেঞ্জিতে বুকের মধ্যে ছবি হয়ে এখনো ‘জীবন্ত’ প্রয়াত স্ত্রী ও ছেলে।
সেদিন ম্যাচ শেষে চোখের কোণে জমা জল নিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। ওদের কখনো ভুলতে পারব না। তাই তাদের ছবি টি-শার্টে নিয়ে খেলতে নামি। তাদের স্মরণ করি। আমার গোলটা তাদের উৎসর্গ করছি।’
২০১৮ সাল থেকেই সোহেল এই কাজ করেন। ক্লাবের ভিন্ন ভিন্ন রঙের জার্সি থাকে, তাই প্রয়াত স্ত্রী ও ছেলের ছবি দিয়ে ১৮টি রঙের জার্সি বানিয়েছেন তিনি। অনুশীলন ও ম্যাচ শেষে সেগুলো আবার খুব যত্ন করে তুলে রাখা হয়।
পারিবারিক আয়োজনে সোহেল ও তাসলিমার প্রেমের বিয়ে হয়েছিল ২০১৪ সালের ১ মে। পরের বছর ১৫ ডিসেম্বর তাঁদের কোলজুড়ে এসেছিল আবদুল্লাহ। ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর সোহেলকে একা রেখে বিদায় নেন তাঁরা। সেদিন মোটরসাইকেলে চেপে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় ফিরছিলেন সোহেল। পথিমধ্যে সাভার নবীনগরের নয়ারহাটের রাস্তায় ঘটে সে ভয়ানক দুর্ঘটনা।
প্রিয়জনদের মৃত্যুতে শোকের সাগরে ডুবে যান সোহেল। পরিবারের পছন্দে ও চাপাচাপিতে ২০২০ সালে শম্পা আক্তারের সঙ্গে বিয়ে। সে বিয়েতে ‘উকিল বাবা’ ছিলেন প্রয়াত স্ত্রীর বাবাই। দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে সোহেল বলছিলেন, ‘পরিবার থেকে আমার জন্য শম্পাকে পছন্দ করে। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলি, “আমার আগের স্ত্রী-সন্তানকে আমি কখনোই ভুলতে পারব না। আমাদের নতুন সংসারে তাদের অস্তিত্ব রাখতে হবে।” শম্পার এ নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না।’
শম্পার কোলজুড়ে ২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর এসেছে পুত্রসন্তান। আগের সন্তানের সঙ্গে মিল রেখেই নাম রাখা হয়েছে সাইফ আবদুল্লাহ। প্রয়াত-বর্তমান—সবাই মিলেই ঢাকার লালমাটিয়ায় একটা সংসার। দেয়ালের ছবির দিকে চোখ রেখে বড় বোনকে খুঁজে পান শম্পা, ‘ভালো লাগে আমার ঘরে তাঁর ছবি আছে। আমি ভাবি, তিনি আমার বড় বোন ছিলেন। এটাই আমার ভালো লাগে।’
প্রয়াত স্ত্রীর স্বপ্ন ছিল, সোহেল জাতীয় দলে খেলবে। জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আফরানের বাবা, তুমি কবে জাতীয় দলে খেলবা?’ স্ত্রী হারানোর শোক বুকে নিয়ে শেখ রাসেলের জার্সিতে দুর্দান্ত খেলে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাকও পান সোহেল।
ম্যাচ খেলার সুযোগ আসেনি। তবে আবাহনীর জার্সিতে এ মৌসুমে নিয়মিত আলো ছড়াচ্ছেন। জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার সুনজরে আছেন বলেই শোনা যাচ্ছে।
সোহেলকে খেলতেই হবে জাতীয় দলে। প্রয়াত স্ত্রীর সঙ্গে স্বপ্নটা যে এখন বর্তমান স্ত্রীরও। সোহেলের বিশ্বাস, একজন যেমন অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন পাশ থেকে, তেমনি অন্যজন অলক্ষ্যে দূর থেকে শক্তি জোগাচ্ছেন তাঁকে।