মৃত নানাকে কথা দিয়েছিলেন রিয়ালে যাবেন, গেলেন বার্সেলোনায়
এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি বার্সেলোনা; আর্সেনালও জানায়নি কিছু। কিন্তু ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবাই জানেন পিয়েরে এমেরিক-অবামেয়াং গতকাল থেকেই বার্সেলোনার খেলোয়াড়। কালই বার্সেলোনা বিমানবন্দরে দেখা গিয়েছিল আর্সেনাল ফরোয়ার্ডকে। দলবদলের শেষ দিনে কোনো খেলোয়াড়ের এভাবে কোনো শহরে হাজির হওয়ার অর্থ একটাই, নতুন দলে যাচ্ছেন তিনি।
দলবদলের খবরের জন্য বিশ্বস্ত সূত্র ফাব্রিজিও রোমানো। এই ইতালিয়ান সাংবাদিক কাল জানিয়ে দিয়েছেন, অবামেয়াংয়ের সঙ্গে বার্সেলোনার চুক্তি হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আজই সে খবর জানানো হবে। তবে গতকাল রাতে বার্সেলোনার কর্তাদের সদর সপ্তরে একত্র হওয়া আর চুক্তি শেষে গ্যাবনিজ এ ফুটবলার ও বার্সা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তার উল্লাসের ছবির পর এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকছে না। এ চুক্তির ফলে অবামেয়াংয়ের বহুদিনের একটা স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে, সেটি স্পেনের বড় কোনো দলে খেলতে পারা; যদিও নানাকে দেওয়া কথা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন এই স্ট্রাইকার।
এ মৌসুমে আর্সেনালের অধিনায়ক হিসেবে শুরু করেছিলেন অবামেয়াং। গত ২ ডিসেম্বর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষেও খেলেছেন অধিনায়ক হিসেবে। এরপরই কোচ মিকেল আরতেতার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। পরের ম্যাচে ৬ ডিসেম্বর এভারটনের বিপক্ষে মূল একাদশে জায়গা হারিয়েছেন, অধিনায়কত্ব তো হারিয়েছেনই।
সে ম্যাচে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য তাঁকে মাঠে দেখা গিয়েছিল। এমনিতেই ফর্ম ভালো যাচ্ছে না তাঁর। লিগে ১৪ ম্যাচে মাত্র ৪ গোল করেছেন, যার সর্বশেষটি ছিল ১০ অক্টোবর, অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে। লিগ কাপে এক ম্যাচ খেলেই ৩ গোল করলেও সেটি দ্বিতীয় স্তরে থাকা ব্রমউইচের বিপক্ষে।
একদিকে ফর্ম নেই, ওদিকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়। আর্সেনালে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছিলেন অবামেয়াং। গত ৬ ডিসেম্বরের পর আর তাঁকে খেলায়নি ‘গানার’রা। আগামী জুনে ৩৩ পূর্ণ হবে, কোচেরও আর পছন্দ নয়; এমন এক খেলোয়াড়কে ছাড়তে পারলেই খুশি তারা। ওদিকে বার্সেলোনাও খুঁজছে একজন স্ট্রাইকার। চুক্তি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় উসমান দেম্বেলেকে ক্লাব থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে। নিজেদের আনসু ফাতি আবারও চোটে পড়েছেন। মেম্ফিস ডিপাইয়ের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
জানুয়ারির দলবদলে যাঁকে ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেই লুক ডি ইয়ংই এখন বার্সেলোনার ত্রাতা। এমন অবস্থায় একজন স্ট্রাইকার খুব দরকার ছিল জাভির। স্প্যানিশ আলভারো মোরাতাকে প্রথম পছন্দ ছিল জাভির। কিন্তু জুভেন্টাস ছেড়ে যাননি মোরাতা। অগত্যা অবামেয়াংই ভরসা। ওদিকে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন, সেটাও বার্সেলোনার মতো ক্লাবে, অবামেয়াংও নিজের বেতন কমিয়ে নিয়েছেন। আর্সেনালে সপ্তাহে সাড়ে ৩ লাখ ইউরো বেতন নেওয়া গ্যাবনিজ স্ট্রাইকার বার্সেলোনায় নেবেন মাত্র ১ লাখ ইউরো। ফলে বেতন সীমা অতিক্রম করছে না বার্সেলোনা।
কাল রাতে ফ্যাব্রিজিও তাই টুইট করে বার্সেলোনার সমর্থকদের সুখবরটা দিয়ে দিয়েছেন, পিয়েরে এমেরিক-অবামেয়াং বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছেন, ‘চুক্তি সম্পন্ন। চুক্তি হয়ে গেছে এবং অবামেয়াং বার্সেলোনার সদর সপ্তরে চুক্তি সই করবেন। মেডিকেল সম্পন্ন। আর্সেনালও বেতনের বড় অঙ্ক বেঁচে যাওয়ায় খুশি।’
এই দলবদলে অবামেয়াংয়ের মা খুব খুশি হবেন। ২০১৬ সালে এই স্ট্রাইকার বলেছিলেন, ‘মাদ্রিদ বা লা লিগার অন্য বড় ক্লাবে খেলতে পারলে আমার মাকে দারুণ উপহার দিতে পারব আমি।’
২০১৮ সালে যোগ দেওয়ার পর আর্সেনালের জার্সিতে ১৬৩ ম্যাচে ৯২টি গোল করা ও ২১টি গোলে সহায়তা করা অবামেয়াং কাল তাঁর মায়ের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। নিজে গ্যাবন জাতীয় দলে খেলেন, বাবা পিয়েরে অবামেয়াং নিজেও গ্যাবন দলের অধিনায়ক ছিলেন। অবামেয়াংয়ের জন্ম ফ্রান্সে। তবু তাঁর স্পেনে খেলার স্বপ্নটা মায়ের সুবাদে। মা মারগারিতা ক্রেসপো স্প্যানিশ। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের কাছে অবস্থিত আভিলা অঞ্চলে জন্ম মারগারিতার। ছেলেকে তাই স্পেনে দেখার ইচ্ছা তাঁর হতেই পারে।
কিন্তু অবামেয়াং বার্সায় যোগ দেওয়ায় একজনের মন খারাপ হতো। অবামেয়াংয়ের নানা যে চাইতেন নাতি রিয়াল মাদ্রিদে খেলুক। ২০১৩ সালে সেঁত এতিয়েন থেকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে যোগ দিয়েছিলেন। এই ক্লাবে এসেই প্রথম নিজের গোল শিকারির ক্ষমতাটা দেখিয়েছেন। ২১৩ ম্যাচে ১৪১ গোল করার সময়টায় নিয়মিতই রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে গুঞ্জন উঠত।
২০১৬ ও ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চারবারের দেখায় প্রতিবার গোল করেছেন অবা। এর মধ্যে ২০১৬ সালে দুই ম্যাচে ২ গোল করার পরই নিজের ও নানার স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন, ‘আমার ছোটবেলার স্বপ্ন? রিয়াল মাদ্রিদে খেলা। আমার নানার জন্ম আভিলায়, মাদ্রিদ থেকে খুব বেশি দূরে না। ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে আমি কথা দিয়েছিলাম, একদিন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলব।’
স্বপ্ন পূরণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার কথাও জানিয়েছিলেন। মাদ্রিদকে যে ছোটবেলা থেকেই অনুসরণ করেন, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন আরেকটি কথায়, ‘আমি জানি এটা সহজ না, কিন্তু জিনিসটা আমার মাথায় আছে। গোল উদ্যাপন করার সময় আমি হুগো সানচেজের সম্মানে কার্টহুইল দিই। ইন্টারনেটে তাঁর অনেক ভিডিও দেখেছি এবং ছোটবেলা থেকে তাঁকে অনুসরণ করি।’ মেক্সিকান কিংবদন্তি সানচেজ ১৯৮৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ‘লস ব্লাঙ্কো’দের হয়ে ২৮৩ ম্যাচে ২০৮ গোল করেছেন, জিতেছেন টানা পাঁচটি লা লিগা।
কে জানে হয়তো ২০ মার্চে বার্নাব্যুতে সানচেজের মতো কার্টহুইল উদ্যাপন করবেন অবামেয়াং। কিন্তু আদর্শের মতো রিয়ালের জার্সিতে নয়, তাঁকে এখন দেখা যাবে বার্সেলোনার নীল-মেরুন জার্সিতে।