কৃষ্ণ সাগর লাগোয়া রাশিয়ার আকর্ষণীয় অবকাশ নগর সোচি। সোচিতে বেড়াতে যাননি এমন রুশদের সংখ্যা খুব কমই আছে। শুধু কি রুশরা? এই সোচিতে অনেক বাংলাদেশিরও নিয়মিত পদচারণ ছিল। তা অবশ্য অনেক বছর আগের কথা। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চশিক্ষার জন্য অবস্থান করা অনেক বাংলাদেশি সোচিতে নিয়মিত বেড়াতে আসতেন। সোচিতে কাটানো তাঁদের মধুর স্মৃতির কথা অনেকেই এই প্রতিবেদকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্মৃতিচারণা করেছেন
সোচি শহরের এক পাশে দিগন্তজোড়া সমুদ্রের বেলাভূমি, অন্যদিকে ককেশাস পর্বতমালা সোচিকে করে তুলেছে অনন্য। পুরো শহরটি যেন সারি সারি পামগাছ দিয়ে মোড়ানো। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, বাহারি ফুলের সৌরভ আর সবুজ প্রকৃতি দেখে পুরো সোচি শহরকে মনে হতে পারে বিশাল এক পার্ক। বিশ্ববাসী সোচিকে চিনেছে চলমান ফুটবল বিশ্বকাপেরও আগে। ২০১৪ সালে এই সোচিতে বসেছিল শীতকালীন অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিকের আসর। রাশিয়া বিশ্বকাপের কারণে শহরের অলিগলিতে এখন বিদেশিদের পদচারণ।সোচি শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দূরে বিশ্বকাপের ভেন্যু। সোচির আদলের এলাকায় কৃষ্ণ সাগর লাগোয়া ফিশত স্টেডিয়ামের অবস্থান। ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। পরে ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্বকাপের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে রুশ সরকার। রাশিয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের চারটি ম্যাচ সোচিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৬ জুন অস্ট্রেলিয়া বনাম পেরুর ম্যাচটি দিয়ে শেষ হবে সোচি ভেন্যুর গ্রুপপর্বের খেলা। গতকাল বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ খেলায় এখানেই সুইডেনের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়লাভ করে জার্মানি।
সোচি শহর থেকে ট্রেন, বাস কিংবা ট্যাক্সিতে করে আদলেরে যাওয়া যায়। বিশ্বকাপের জন্য শহরের সব জায়গায় রয়েছে রুশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি সংকেত। ম্যাচের টিকিট ও ফ্যান আইডি যাঁদের রয়েছে, তাঁরা বিনা টিকিটেই গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারছেন।
সোচি শহর থেকে যে বাসে আমরা উঠলাম, তার ৯০ ভাগই ছিল জার্মানি-সুইডেন ম্যাচের দর্শক। নানা দেশ, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের এমন মিলনমেলা খুব কমই দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের সমর্থকদের নিয়ে আমাদের বাস এসে থামল সোচির অলিম্পিক পার্ক বাস ডিপোতে। বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হেঁটে স্টেডিয়ামে যেতে হয়।
বিশাল এলাকাজুড়ে ওয়াকওয়ে আর চারদিকের সবুজের সমারোহ ফিশত স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যেতে যেতে চোখে পড়বে অলিম্পিক গেমসের জন্য নির্মাণ করা বিভিন্ন অবকাঠামো।
বিকেল থেকেই দুই দলের সমর্থকেরা স্টেডিয়ামে জড়ো হতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে পুরো অলিম্পিক পার্ক দর্শক-সমর্থকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
বিশ্বকাপের খেলা দেখতে আসা দর্শকদের নানা কর্মকাণ্ডে উৎসবের আমেজ ছিল পুরো স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে। ব্যানার, ফেস্টুন, বাঁশি, মুখোশ—যে যা পেরেছেন সঙ্গে করে এনেছেন। সুইডিশ ও জার্মানদের অনেকেই এসেছেন নিজ দলের জার্সি গায়ে কিছুটা ভিন্ন সাজে। আর তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলতে ছেলে-বুড়ো কেউই বাদ যাননি। বিয়ারের দোকানগুলোতে ছিল লম্বা লাইন। সেখানে জার্মান ও সুইডিশদের উপস্থিতিই ছিল বেশি।
রাশিয়া বিশ্বকাপের অন্য ভেন্যুগুলোর মতো সোচির ভেন্যুতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক চোখে পড়বে। নানা বয়সের স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসিমাখা মুখ এবং হাই ফাইভ দিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে বিশ্বকাপের মাঠে।
শনিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টা থেকেই স্টেডিয়ামে ঢোকা শুরু করেন দর্শকেরা। হঠাৎ করেই স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশপথে হাজির সাদাপোশাকের রনপা নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক রুশ তরুণী। তাঁর পরনের টি-শার্টে বড় অক্ষরে লেখা রাশিয়া। রুশ তরুণীর এমন উদ্যোগ নজর কেড়েছে আশপাশের অনেকের। কাছে গিয়ে অনেকেই তাঁর ছবি তুললেন। ওই তরুণী কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক বয়োজ্যেষ্ঠ জার্মান দৌড়ে গিয়ে তরুণীর হাতে চুমু দিতে চাইলেন! তরুণীও হাত বাড়িয়ে দিলেন। এ সময়ে আশপাশের সবাই মুহুর্মুহু করতালি দিতে লাগল। কেউ আবার ওই মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করে রাখলেন। আসলে বিশ্বকাপ মানেই সব বিচিত্র ঘটনার এক সংগ্রহশালা, যা খেলা দেখতে আসা দর্শক-সমর্থকদের স্মৃতির জাদুঘরে দাগ কেটে থাকবে দীর্ঘদিন।