ভিনিসিয়ুস-জাদুতে এমবাপ্পের প্যারিস রাঙানোর আশা রিয়ালের

ভিনিসিয়ুস জুনিয়রছবি: টুইটার
আগামীকাল প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। ভালোবাসার শহর কাকে বরমাল্য দেয়, সেটা জানতে এখন সবার অধীর অপেক্ষা। এই ফাইনাল উপলক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ আয়োজন। আজ পড়ুন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে আলো কাড়তে পারেন এমন একজন সম্পর্কে—

শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় ওঠার পথে সমালোচকদের মিছিল থাকবে, থাকবে সন্দেহবাদীদের কোলাহল। সে কোলাহল থামানোর উপায়টা ‘সহজ’—চুপচাপ নিজের কাজটা ঠিকমতো করে যাও, নিজের সামর্থ্যকে বাস্তবতায় রূপ দাও। মেসি থেকে রোনালদো, ফেদেরার থেকে নাদাল কিংবা শচীন-কোহলি—সবার সাফল্যের দাওয়াই একই। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রও যার ব্যতিক্রম নন।

আরও পড়ুন

গত কয়েক বছরে কত কথাই না শুনতে হয়েছে তাঁকে! বল নিয়ে শুধু কারিকুরিই করতে পারেন, কিন্তু বক্সে ঢুকলে গোল আর করতে পারেন না! স্প্যানিশ পত্রিকা এল মুন্দো লিখেছিল, ভিনিসিয়ুসের দুই পা সমানতালে চলে না, নিয়ন্ত্রণ নেই কোনো। আশ্চর্য হলেও সত্যি, সতীর্থ করিম বেনজেমাও ছিলেন এল মুন্দোর দলে। বেশি না, বছরখানেক আগেই চ্যাম্পিয়নস লিগে বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখের বিপক্ষে এক ম্যাচে টানেলে ভিনিসিয়ুসের দিকে ইঙ্গিত করে আরেক সতীর্থ ফারলাঁ মেন্দিকে এই ফরাসি স্ট্রাইকার বলেছিলেন, ‘ওকে পাস দিয়ো না, ও আমাদের বিপক্ষে খেলছে।’

বছরখানেক পর সেই ভিনিসিয়ুসই বেনজেমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলাচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাগ। এ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫১ ম্যাচে ২১ গোল আর ২০ গোলে সহায়তা করে ভিনিসিয়ুস দিয়েছেন নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ, চুপ করিয়ে দিয়েছেন সমালোচকদের। শনিবার রাতে ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের লক্ষ্যে রিয়াল মাদ্রিদ যখন প্যারিসের স্তাদে দে ফ্রান্স স্টেডিয়ামে নামবে, বিশ্বব্যাপী রিয়াল সমর্থকেরা বেনজেমার পাশাপাশি তাঁর দিকেও তাকিয়ে থাকবেন। প্রত্যাশার পারদটা যে ভিনিসিয়ুস নিজেই চড়িয়ে দিয়েছেন!

আরও পড়ুন

ভিনিসিয়ুসের এই যে রিয়াল মাদ্রিদের আস্থা হয়ে ওঠা, এর জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন হুনি কালাফাত। বাকিরা যেটা এত দিনে এসে বুঝতে পারছেন, সেটা বছর আটেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন ক্লাবের প্রধান স্কাউট কালাফাত। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তখন নেইমার-প্রেমে মশগুল। রিয়ালের পরবর্তী গ্যালাকটিকো-যুগের সূচনা নেইমারের হাত ধরেই হবে, সে স্বপ্নে বিভোর পেরেজ শেষমেশ বার্সেলোনার সঙ্গে পেরে ওঠেননি। সে প্রেমের তীব্রতা এতটাই ছিল, নেইমার বার্সেলোনা যাওয়ার পরও পেরেজ আশা ছাড়েননি। পরের কয়েক মৌসুমে বিভিন্ন সময়ে রিয়ালের সঙ্গে নেইমারকে জড়িয়ে গুঞ্জন উঠেছিল।

ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে দুর্দান্ত এক গোল করেছেন ভিনিসিয়ুস
ফাইল ছবি: এএফপি

তবে যে সময়ে পেরেজ নেইমারের পেছনে ছোটাছুটি করছিলেন, হুনি কালাফাত তখন ঘুরছিলেন ব্রাজিলের পথে-প্রান্তরে, আগামীর নেইমারের খোঁজে। যে খোঁজ তাঁকে নিয়ে যায় ভিনিসিয়ুসের কাছে। বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে ভিনিসিয়ুসের নৈপুণ্য দেখে কালাফাত বুঝেছিলেন, এই ছেলে আর দশজনের মতো নয়। সাও পাওলোতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের কাপ প্রতিযোগিতায় সাত ম্যাচে ৫ গোল আর ৪ গোলে সহায়তা করেছিলেন এই লেফট উইঙ্গার। ব্যস, পরিসংখ্যানের সঙ্গে নিয়ত স্টেপওভার আর ড্রিবলিংয়ের ঝলক দেখে কালাফাত বুঝলেন, নেইমারের পর ব্রাজিলীয় ফুটবলের বড় তারকা হওয়ার সব গুণ এই ছেলের মধ্যেই আছে।

আরও পড়ুন

শুধু মাঠের ভেতরেই নয়, মাঠের বাইরেও ভিনিসিয়ুস মুগ্ধ করেছিলেন কালাফাতকে। ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে পেরেজকে দেওয়া প্রতিবেদনে কালাফাত লিখেছিলেন, ‘রবিনিও-রোনালদিনিওদের মতো ছন্নছাড়া আর উচ্ছৃঙ্খল নন এই তরুণ। ফুটবল মাঠের সাফল্যই তাঁর মূল লক্ষ্য। দলে সুযোগ না পেলেও নিয়ত নিজেকে আরও উন্নত করার কাজে ব্যস্ত থাকবেন, আচরণগত দিক দিয়ে সমস্যায় ফেলবেন না দলকে।’ অনেকটা মার্সেলো কিংবা কাসেমিরোর মতো। নিজেদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দিয়ে তিল তিল করে যাঁরা রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদের মন জয় করেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে নৈশক্লাবে যান না ভিনিসিয়ুস। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে একই বাংলোতে থাকা বন্ধু লুইজ ফেলিপে মেনেগেত বলেছিলেন, ‘আমরা নৈশক্লাবে যাচ্ছি কিন্তু ও যেতে পারছে না, এটা ভালো লাগত না আমাদের। তাই আমরাও নৈশক্লাবে যাই না।’

রিয়ালের হয়ে মৌসুমের শুরুটা এবার দারুণ হয়েছে ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পেরেজ তত দিনে বুঝে গিয়েছিলেন, নেইমারকে দলে টানার আশা হয়তো পূরণ হবে না কখনোই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার কাছে নেইমার-যুদ্ধে হেরে আর বিশ্বের নামকরা তারকাদের পিএসজি-ম্যানচেস্টার সিটির মতো ক্লাবগুলোর অর্থের প্রতি ক্রমেই আকৃষ্ট হওয়া দেখে পেরেজ অনুমান করতে পেরেছিলেন, আগের সেই দিন আর নেই। যখন রিয়াল চাইলেই টাকার জোরে যে কাউকে দলে টানতে পারত। দলবদল নিয়ে নিজেদের কৌশলে তখনই কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন পোড় খাওয়া এই ব্যবসায়ী। নেইমারকে না পেয়ে আগামীর নেইমারদের দলে টানার প্রকল্প বাস্তবায়নে নজর দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

ফলে ভিনিসিয়ুসকে রিয়ালের জার্সি পরানোর জন্য কালাফাতকেও খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। আজ ভিনিসিয়ুসের পথ ধরে রদ্রিগো, এদের মিলিতাও, রেইনিয়ের, ভিনিসিয়ুস তোবিয়াসরা যে রিয়ালের একাদশে নিয়মিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেটা তো রিয়ালের পরিবর্তিত দলবদল-কৌশলেরই ফল! যে কৌশলের সাফল্য তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন লিগের পাশাপাশি ভিনিসিয়ুস-নৈপুণ্যে রিয়াল চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতবে।

লিভারপুলের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার কাজটা এর আগেও করেছেন ভিনিসিয়ুস। গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে এই ভিনিসিয়ুস-জাদুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল লিভারপুল, ব্রাজিলিয়ান এই উইঙ্গার করেছিলেন জোড়া গোল। প্যারিসের মাঠে যদি একই কাজ আবার করতে পারেন, পেরেজের মুখের হাসিটাই সবচেয়ে বেশি চওড়া হবে।

আরও পড়ুন

কিছুদিন আগেই কিলিয়ান এমবাপ্পের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়া রিয়াল মাদ্রিদ ভিনিসিয়ুস নামের আরেক তরুণ উইঙ্গারের ঝলকে এমবাপ্পের শহর থেকেই চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা নিয়ে ফিরছে—এমন একটা দৃশ্য হয়তো রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরাও কল্পনা করছেন এখনই।