ভারতকে নিষিদ্ধ করবে ফিফা?
লিওনেল মেসিকে কি পেছনে ফেলার সুযোগ পাবেন সুনীল ছেত্রী?
ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কের সঙ্গে মেসিকে একই বাক্যে নিয়ে আসাই হয়তো ভ্রু কুঁচকে দেবে অনেকের। তবে তুলনাটা চলে আসে আপনা–আপনি, যখন হিসাব হয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের। কদিন আগে এস্তোনিয়াকে ৫-০ গোলে হারানোর পথে মেসিই আর্জেন্টিনার সব কটি গোল না করলে তো সেখানে মেসির চেয়ে ছেত্রীই এগিয়ে থাকতেন! আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের তালিকায় এখনো খেলছেন, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর (১১৭ গোল) পরই থাকত ছেত্রীর নাম।
৩৭ বছর বয়সী ছেত্রীর এই মুহূর্তে গোল ৮৪টি, মেসির দুটি বেশি। কদিন আগে শেষ হওয়া ২০২৩ এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের তৃতীয় রাউন্ডে চার গোল ছেত্রীর। তাঁর দারুণ পারফরম্যান্সেই বাছাইপর্বের তিনটি ম্যাচই জিতে টানা দ্বিতীয়বার মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে উঠেছে ভারত।
কিন্তু এত কিছুর পরও ছেত্রী শঙ্কায়। মেসিকে ছাড়িয়ে যাওয়া পরের ব্যাপার, ভারতের জার্সিতে খেলারই আর সুযোগ পাবেন? ফুটবল ফেডারেশনে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে যে ভারত ফিফার কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার শঙ্কায়! এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান।
শঙ্কাটা কিছুদিন ধরেই ঝুলছে ভারতের ফুটবলে, কদিন আগে এ নিয়ে ছেত্রীই বলছিলেন, ‘আশা করি এই দেশের খেলাধুলার জন্য সবকিছু ঠিকঠাকই থাকবে, আমরা কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়ব না। নিষিদ্ধ হলে সেটা শুধু পুরো দেশের জন্যই খুব খারাপ হবে না, আমার জন্যও হবে ভয়াবহ। আমার বয়স ৩৭ হয়ে গেছে। কখন কোন ম্যাচটা ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হয়ে থাকে, সেটা তো আর কেউ বলতে পারে না।’
অধিনায়কের এমন কথার পর ভারত জাতীয় দলের ক্রোয়েশিয়ান কোচ ইগর স্তিমাচও দেশের ফুটবলকর্তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জেগে উঠুন!’
মাঠে ভারতের জাতীয় দল ভালোই করছে। এই মুহূর্তে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ভারত ১০৬তম, টানা দ্বিতীয়বার এশিয়ান কাপে খেলছে, নিয়মিত ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের মাঝারি সারির দলগুলোর সঙ্গেও খেলছে। কিন্তু ভারতের ফুটবল ফেডারেশন—অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ) বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। ফেডারেশনের সভাপতি প্রফুল প্যাটেলের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়া এবং এর পরের নির্বাচন নিয়ে যত ঝামেলা।
২০০৮ সালে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর (যিনি নিজে ১৯৮৮ সাল থেকে দায়িত্বে ছিলেন, দায়িত্বও ছেড়েছেন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায়) বদলে এআইএফএফের প্রধান নির্বাচিত হন প্যাটেল। দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, এর পর থেকে ভারতের ফুটবলের চেয়েও দ্রুতগতিতে ওপরের দিকে উঠেছেন প্যাটেল। ভারতের ফেডারেশন থেকে খুব অল্প সময়েই এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি নির্বাচিত হন, সদস্য হয়েছেন ফিফা কাউন্সিলের।
তাঁর সময়ে ভারতের জাতীয় দলগুলোর ভাগ্য একেক সময় একেক রকম হয়েছে, সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, তবে ভারতের ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে জটিলতা বেড়েছে। ২০১০ সালে ভারতের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সের সঙ্গে এআইএফএফের ১৫ বছরের বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়েও এখনো বিতর্ক আছে।
গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, গত মার্চে ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২০২২-২৩ মৌসুমে ভারতের ফেডারেশনের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছে, সেটি ২০১৯-২০ মৌসুমের বরাদ্দের চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম! শোনা যায়, জাতীয় দলের ফলাফল প্রত্যাশামাফিক না হওয়া, বয়সভিত্তিক দলগুলোর পারফরম্যান্সে হতাশা এবং মেয়েদের ফুটবল নিয়ে শঙ্কার কারণেই মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত।
এআইএফএফকে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে তৃণমূলে নজর দেওয়ার। এসবের পাশাপাশি বড় ঝামেলা ছিল ফেডারেশনের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টকে আহ্বান জানানো হয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার।
সেটিই প্যাটেলের ক্ষমতার শেষ টেনে দেয়। নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিন মেয়াদেই ফেডারেশনের প্রধান নির্বাচিত হতে পারতেন, সে অনুযায়ী এমনিতেই প্যাটেলের মেয়াদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে নতুন নির্বাচন দেওয়া হয়নি।
নতুন নির্বাচন হলেও সেটিতে আর প্যাটেলের প্রার্থিতার আবেদনের সুযোগ নেই। কিন্তু নির্বাচন না হওয়ায় প্যাটেলই চেয়ারে থেকে গেছেন। সে সময় প্যাটেল জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে ফেডারেশনের সংবিধানে আগে একটি বিষয় সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
এমন জটিলতার মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট তিনজনের ‘কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিওএ)’ ঠিক করে দেয়, যাদের ফেডারেশনের সবদিক দেখভাল করবেন। তখন আশা করা হয়েছিল, জুনের শেষ ভাগের মধ্যেই নির্বাচন শেষ করা যাবে। তবে এখন বলা হচ্ছে, নির্বাচন হতে পারে সেপ্টেম্বরে।
কিন্তু এত জটিলতা ফিফার পছন্দ হচ্ছে না। ফুটবল ফেডারেশনের সরকারের হস্তক্ষেপ ফিফা কখনোই মেনে নেয় না, সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো এশিয়ান দেশগুলোকে ফেডারেশনে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে ফিফার নিষেধাজ্ঞা পেতে হয়েছে। এসব ব্যাপারেই আরও ভালো খোঁজখবর করতে আজ সোমবার ফিফার কয়েকজন কর্মকর্তার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল।
এআইএফএফের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিওএ-র তিন সদস্যের একজন ড. এসওয়াই কুরাইশি অবশ্য বলছেন, ‘আমার মনে হয় না ফিফার এসব দিক (ফেডারেশনে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা) নিয়ে কোনো আপত্তি থাকবে। ফুটবল নির্বাচনের সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। এর আগের মেয়াদের প্রশাসকেরা তাঁদের মেয়াদের বাইরেও দায়িত্বে থেকে গেছেন, সে সময়ে নির্বাচন আয়োজন করা দরকার ছিল। এখানে ফিফার নিয়ম না মানার মতো কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। আশা করি ফিফা সব দিক বুঝবে, সাহায্য করবে। আমরাও তাদের সাহায্য করব, কারণ আমরা চাই সরকার আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটি শেষ করতে।’