সুপার লিগের ডামাডোলে প্রশ্ন উঠছে নতুন চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়েও
সুপার লিগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় যখন ইউরোপিয়ান ফুটবলের দৃষ্টি একদিকে, উয়েফা অনেকটা চুপিসারে বদল এনেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের অবয়বে। ইউরোপের ফুটবলে ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্টটিকে এখন যেভাবে দেখছেন, ২০২৪ সাল থেকে তেমন আর থাকবে না। দল বাড়বে, ম্যাচ বাড়বে গুনে গুনে ১০০টি। এদিকে বড় ক্লাবগুলোর জন্য টাকা–পয়সা কামানোর সুযোগ তো বাড়বেই, খুলে যাবে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার বিকল্প একটা রাস্তাও।
কিন্তু সেটিও তো বিতর্কমুক্ত নয়। ফুটবল যেখানে হওয়ার কথা ছিল বড়-ছোট সবার জন্য লড়াইয়ের সমান মঞ্চ, অর্থলোভ সেই মূল আদর্শকেই অস্বিত্ব-সংকটে ফেলে দিয়েছে। সুপার লিগ সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, যে কারণে সেটি নিয়ে চারদিকে বিতর্ক-বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগের এই বদলগুলোও অনেকের চোখে কম না। ইলকায় গুন্দোয়ান এমনই একজন।
ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান মিডফিল্ডার চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছকের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর চোখে, দুটি বদলই খারাপ, সুপার লিগ বেশি খারাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছক একটু কম! দুটিকে শয়তান ভেবে নিলে সুপার লিগ বড় শয়তান, চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছক ছোট। দুটির কোনোটিতেই খেলোয়াড়দের ধকলের কথা মাথায় রাখা হয়নি বলে অভিযোগ গুন্দোয়ানের।
‘সুপার লিগ নিয়ে যা চলছে...এর মধ্যে আমরা কি চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছক নিয়েও একটু কথা বলতে পারি? আরও বেশি বেশি ম্যাচ রাখা হচ্ছে। আমাদের খেলোয়াড়দের কথা কি কেউ আসলে ভাবছে?’—কাল টুইটে লিখেছেন গুন্দোয়ান। সুপার লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছক—দুটিকেই শয়তানের সঙ্গে তুলনা করে গুন্দোয়ান লিখেছেন, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছকটা আসলে সুপার লিগের তুলনায় দুই শয়তানের মধ্যে ছোটটি। চ্যাম্পিয়নস লিগের এখনকার যে ছক, সেটি তো বেশ দারুণভাবেই চলছে। সে কারণেই এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব টুর্নামেন্ট, আমাদের খেলোয়াড়দের কাছে যেমন, তেমনি সমর্থকদের কাছেও।’
গত সোমবার ২০২৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই বদল ঘোষণা করেছে উয়েফা। এখনকার ৩২ দলের টুর্নামেন্ট থেকে ২০২৪ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ হয়ে যাবে ৩৬ দলের। এখন যেভাবে ৪টি করে দল নিয়ে ৮টি গ্রুপ নিয়ে শুরু হয় গ্রুপ পর্ব, তখন তা আর থাকবে না। কোনো গ্রুপিং থাকবে না, সব দল একসঙ্গে থাকবে, একটা দল ১০টি দলের বিপক্ষে খেলবে। গ্রুপ পর্ব থেকে পয়েন্ট তালিকার প্রথম ৮টি দল সরাসরি চলে যাবে শেষ ষোলোতে। আর বাকি আট দল ঠিক হবে পয়েন্ট তালিকার ৯ থেকে ২৪তম দলের মধ্যে প্লে-অফের মাধ্যমে। এরপর শেষ আট (কোয়ার্টার ফাইনাল), সেমিফাইনাল ও ফাইনাল চলবে এখনকার ছকেই।
কিন্তু খেলোয়াড়দের জন্য এখানে ধকল কীভাবে বাড়বে? এখনকার ছকে গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে কোনো দল যদি ফাইনাল পর্যন্ত খেলে, সে ক্ষেত্রে একজন খেলোয়াড়কে সর্বোচ্চ ১৩টি ম্যাচ খেলতে হয়। নতুন ছকে ফাইনাল পর্যন্ত গেলে একজন খেলোয়াড়কে কত ম্যাচ খেলতে হবে, সেটি আবার ঠিক করে দেবে গ্রুপ পর্ব থেকে তাঁর দল শেষ ষোলোতে কীভাবে উঠছে, সেটির ওপর। গ্রুপ পর্ব থেকে সরাসরি শেষ ষোলোতে উঠে দল ফাইনাল পর্যন্ত গেলে একজন খেলোয়াড়কে ম্যাচ খেলতে হবে ১৭টি, কিন্তু গ্রুপ পর্ব থেকে প্লে-অফ খেলে শেষ ষোলোতে উঠে ফাইনালে গেলে ম্যাচ খেলতে হবে ১৯টি।
ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে (জার্মানি ছাড়া) মৌসুমে এমনিতেই লিগে ৩৮টি ম্যাচ খেলতে হয় একটা দলকে, এর বাইরে ঘরোয়া কাপ টুর্নামেন্ট তো আছেই। চ্যাম্পিয়নস লিগের এখনকার ছকেই একজন খেলোয়াড়কে মৌসুমে ৫০-৬০টি ম্যাচ খেলতে হয়। নতুন ছকে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। অবশ্য, চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছকের পেছনে উয়েফার পরিকল্পনা ছিল, ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে দল কমিয়ে আনার অনুরোধ করা হবে। ইংল্যান্ড-স্পেন-ইতালি-ফ্রান্সের লিগে এখন ২০টি করে দল খেলে, সেগুলোকে জার্মানির মতো ১৮ দলের লিগ করার পরিকল্পনার কথা আগে জানিয়েছিল উয়েফা। পাশাপাশি ঘরোয়া কাপ টুর্নামেন্টেও কাটছাঁট করার পরিকল্পনা আছে।
তবে সেটি নয়, চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছকের সমালোচনা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বড় দলগুলোর বাড়তি সুবিধা নিয়ে। এখনকার ছকে চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ পেতে দলগুলোকে নিজেদের লিগের পয়েন্ট তালিকায় একটা নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে থাকতে হয় (ইংল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি—সব লিগে পয়েন্ট তালিকার এক থেকে চার নম্বরে থাকা দল সুযোগ পায় পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে), নতুন ছকে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, লিভারপুল, এসি মিলান, বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ইউরোপে কুলীন দলগুলোর জন্য এর পাশাপাশি বাড়তি সুবিধাও রাখা হয়েছে।
সেটি কেমন? কোনো দল লিগের নির্ধারিত জায়গায় থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিতে না পারলেও বিকল্প ব্যবস্থা আছে। লিগে নির্ধারিত স্থানের সুযোগ না পাওয়া দলগুলোর মধ্যে দুটিকে উয়েফা সূচকের (উয়েফার টুর্নামেন্টে দলগুলোর অতীত পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এটি নির্ধারিত হয়) ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়া হবে চ্যাম্পিয়নস লিগে। সেদিক বিবেচনায় অবশ্য মনে হতে পারে, ঠিক সুপার লিগের মতো না হলেও এখানেও তো বড় দলগুলোকে সুযোগ দিতে গিয়ে ছোট দলগুলোর স্বপ্নের রাস্তা আরও সরু করে দেওয়া হচ্ছে!
ইউরোপিয়ান সুপার লিগে অবশ্য রাস্তা সরু করার কিছু নেই, সেখানে ছোট দলগুলোর ঢোকার কোনো রাস্তাই রাখা হয়নি। গত রোববার রিয়াল, বার্সা, জুভেন্টাস, লিভারপুল, ম্যান ইউনাইটেড, ম্যান সিটি, এসি মিলান, ইন্টার মিলানসহ ১২টি ক্লাব একযোগে ঘোষণা দেয়, তারা সুপার লিগ গঠন করছে। সেখানে আরও ৩টি ক্লাবকে নিয়ে ১৫টি ‘প্রতিষ্ঠাতা ক্লাব’ রাখার কথা ছিল, পাশাপাশি ‘অতিথি’ ৫টি ক্লাবকে নিয়ে প্রতি মৌসুমে ২০ দলের টুর্নামেন্ট হতো। এই টুর্নামেন্টকে চ্যাম্পিয়নস লিগের বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। যেখান থেকে প্রতিষ্ঠাতা ১৫টি ক্লাব কখনো অবনমিত হতো না!
স্বাভাবিকভাবেই, ছোট ক্লাবের সেখানে ঢোকার রাস্তা ছিল না। সাদা চোখে, মূলত ইউরোপের ফুটবলের ‘ব্রাক্ষ্মসমাজে’র এই টুর্নামেন্ট তারাই প্রতিষ্ঠা করেছে, তারাই খেলতে চেয়েছে, টাকা-পয়সাও তারাই ভাগাভাগি করত, আবার খেলাটা চলত তাদের নিয়মেই!
চ্যাম্পিয়নস লিগের নতুন ছক তা করছে না। কিন্তু বড় ক্লাবগুলোর জন্যই সুবিধা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে আরকি! সমালোচনা এ নিয়েও কম হবে না।