ব্রেন্টফোর্ড: ৬ কোটি টাকার দেনা থেকে ২৫৭০ কোটি টাকার সম্পদ
তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি।
‘জুয়াড়ি’ শব্দটা শুনেই নাক সিঁটকানোর ইচ্ছা হতেই পারে। খেলার জগতে এই শব্দ যে অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। তবু একটু ধৈর্য ধরে গল্পটা পড়ার অনুরোধ করছি। কারণ, এই জুয়াড়ি যা করেছেন, সেটি ক্রীড়া দুনিয়ায় অনেকের জন্যই অনুকরণীয়।
দেনার দায়ে ধ্বংস হতে বসেছিল হাজারো মানুষের স্বপ্ন। এই জুয়াড়ি কেবল সেই স্বপ্ন পুনরুদ্ধার করেননি, সেই সঙ্গে সেটিকে এখন দারুণ সফল এক বিনিয়োগে রূপ দিয়েছেন। কীভাবে? খেলার দুনিয়ার আর্থিক দিকগুলো বিশ্লেষণ নিজের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেন জো পমপ্লিয়ানো। চলুন চেনা যাক সে জুয়াড়িকে।
ম্যাথু বেনহাম একজন ক্রীড়া জুয়াড়ি। তাঁর পরিচয় অবশ্য শুধু এ গণ্ডিতে আটকে রাখা যাচ্ছে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হন বেনহাম।
কর্মজীবনে অবশ্য পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করেননি। ১২ বছর কাজ করেছেন ফাইন্যান্সে (বিনিয়োগ ব্যবসা)। ব্যাংক অব আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে তাঁর এই পেশায় আর মন বসছিল না।
২০০১ সালে ব্যাংক অব আমেরিকা ছেড়ে দিলেন বেনহাম। যোগ দিলেন খেলাধুলা নিয়ে বাজি ধরার প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার বেট-এ। তাঁর কাজ ছিল অ্যানালিটিকস ব্যবহার করে অনুমেয় বাজির মডেল বানানো। বিশ্বের অন্যতম সফল জুয়াড়ি টনি ব্লুমের অধীনে থেকে কাজ শেখার সুযোগ মিলেছিল বেনহামের।
কিন্তু দুজন স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, সেটিই হলো। কয়েক বছর পর দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল। ঠিক কী কারণে জানা যায়নি, তবে ২০০৩ সালে বেনহাম প্রিমিয়ার বেট ছেড়ে দেন।
চাকরি ছাড়লেও তাঁর আগের পেশায় ফেরার ইচ্ছা ছিল না। মানে বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ের জগতে আর ফিরতে চাইছিলেন না তিনি। পেশাদার জুয়াড়ি হিসেবে ক্যারিয়ার গড়াটাই তখন ধ্যানজ্ঞান।
বিভিন্ন খেলায় বাজি ধরে লাখ লাখ ডলার আয় করা শুরু করেন বেনহাম। কিন্তু ২০০৪ সালে নিজেই একটি বাজিনির্ভর প্রতিষ্ঠান স্মার্টঅডস সৃষ্টি করলেন। বিভিন্ন খেলায় বাজি ধরার কাজে সহযোগিতার জন্য পরিসংখ্যান এবং বাজি ধরার জন্য বিভিন্ন মডেল দেওয়াই এর কাজ। যে অ্যালগরিদম, পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ ব্যবহার করে নিজে সফল জুয়াড়ি হয়েছেন, সে পরামর্শই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অন্যদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বেনহাম।
স্মার্টঅডস খুব দ্রুতই সাফল্য পেয়ে যায় এবং সে সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বাজি ধরার প্রতিষ্ঠান ম্যাচবুকেরও মালিক বনে যান বেনহাম। আর নিজের আর্থিক দিকটা সুরক্ষিত হওয়ার পর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস নিয়েও ভাবার সুযোগ পেলেন। কী সেটা? ব্রেন্টফোর্ড এফসি।
ইংলিশ ফুটবলে বহুদিন ধরেই মধ্যম সারিতে পড়ে ছিল দলটি। শীর্ষ পর্যায়ে তাদের সর্বশেষ দেখা গেছে গত শতাব্দীর পঞ্চম দশকে। ১১ বছর বয়সে প্রথম স্টেডিয়ামে গিয়ে ব্রেন্টফোর্ডের খেলা দেখা বেনহাম বাকি জীবন এই ক্লাবেরই সমর্থক বনে যান।
২০০৭ সালে যখন এই ক্লাব আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত, তখন পাশে দাঁড়ালেন বেনহাম। সাবেক সভাপতি রন নোডসের হাতে থাকা মালিকানা যেন ক্লাবের সমর্থকেরা কিনে নিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করেন তিনি। আর সে কাজটা করেছেন ৭ লাখ ডলার (প্রায় ৬ কোটি টাকা) ধার দিয়ে।
তবে সে কাজটা করার পথে একটা শর্ত দিয়েছিলেন বেনহাম। যখন এই অর্থ ধার দিয়েছিলেন ম্যাথু, তখন বলে দিয়েছিলেন, সমর্থকেরা এই ধার শোধ না করেন, তখন ক্লাবটার মালিক হওয়ার সুযোগ পাবেন তিনি। ২০১২ সালে ক্লাবের সমর্থকেরা ধার শোধ করতে অপারগতা জানান। আর বেনহাম তাঁর শৈশবের ক্লাবের মালিক হয়ে যান। কিন্তু এখানেই থামতে চাননি তিনি।
এর আগে ম্যাথু বেনহাম ডেনমার্কে আরেকটি ক্লাব কিনেছিলেন। ক্লাবটি বেশ ছোট এবং নামটা তখনো খুব একটা পরিচিত নয়। গত কয়েক বছরে অবশ্য ইউরোপা লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছে সে ক্লাব—মিতিউলান।
ডেনমার্কের প্রায় অচেনা এই ক্লাবেই ১ কোটি ডলার ঢেলেছিলেন বেনহাম। কেন? কারণ, তাঁর কিছু বিশ্লেষণ পরীক্ষা করে দেখা দরকার ছিল। যে বুদ্ধিগুলো কাজে লেগেছে, সেটা ব্রেন্টফোর্ডে ব্যবহার করেছেন। যা ব্যর্থ হয়েছে, সেটা নিয়ে আর দুবার ভাবেননি।
বেনহাম ক্লাবের সঙ্গে জড়িত আগের সব কর্মীকে ছাঁটাই করে দিলেন। সে জায়গায় ক্লাব চালানোর প্রথাগত অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু বিশ্লেষণী মনোভাবের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া শুরু করলেন। দল জিতল না হারল, তা নিয়ে ভাবনা বাদ গেল। বরং কিছু পারফরম্যান্স নির্দেশক ঠিক করা হলো, যা দেখে উন্নতি হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটার বিচার করা শুরু হলো।
উদাহরণস্বরূপ, একজন খেলোয়াড় কয়টি গোল করলেন, সেদিকে নজর দেওয়া হতো না। বরং একজন খেলোয়াড় ম্যাচে কয়টি সুযোগ সৃষ্টি করছেন বা তাঁর সম্ভাব্য গোলের সংখ্যা কত—সেদিকেই বেশি আগ্রহ দেখাল ব্রেন্টফোর্ড।
এর পেছনের যুক্তি? ফুটবল স্কোর কম হয় (বাস্কেটবল বা রাগবির তুলনায়) এমন এক খেলা যেখানে ভাগ্য ও আকস্মিক কোনো ঘটনার প্রভাব বিস্তর, সে খেলায় সুযোগ সৃষ্টির সংখ্যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বেনহামের উদ্যোগ এখানেই থামেনি। তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল ক্লাবের একাডেমি বাতিল করে দেওয়া। বিশ্বের সব বড় বড় ক্লাব যেখানে তরুণ প্রতিভা এনে একাডেমি গড়ে তুলছে, খেলোয়াড় সরবরাহের ধারাবাহিকতা রাখতে চাচ্ছে, সেখানে ব্রেন্টফোর্ড সে পথে হাঁটেনি। বরং ১৭ থেকে ২০ বছর বয়সী ফুটবলারদের নিয়ে একটি ‘বি’ দল সৃষ্টি করেছে। সেখানেও তাঁদেরই সুযোগ দেওয়া হতো, যাঁরা অন্য ক্লাব অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন।
ব্রেন্টফোর্ডের স্টাফদের যুক্তি, একজন খেলোয়াড়ের সঠিক অবস্থা বুঝতে অন্তত ৩৫ ম্যাচ খেলাতে হবে। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর পক্ষে এত ধৈর্য ধরা, সময় দেওয়া কিংবা এটা করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে আগ্রহী বলে ব্রেন্টফোর্ড সেটা করতে পারত। এর ফলে দাম পাচ্ছেন না, এমন সব খেলোয়াড় ক্লাবে যোগ দিচ্ছিলেন। নিজেদের প্রমাণের জন্য তাঁরা থাকতেন মরিয়া।
এ পথে সাইদ বেনরাহমাকে ৩৮ লাখ ডলারে কিনে ৪ কোটি ডলারে বিক্রি করেছে ব্রেন্টফোর্ড। ওলি ওয়াটকিনসকে ২৩ লাখ ডলারে কিনে তারা বিক্রি করেছে ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারে, নিল মপের ক্ষেত্রেও ব্রেন্টফোর্ড ২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার আয় করেছে।
এ কারণে, প্রাথমিকভাবে সাফল্য না পাওয়া গেলেও এক দশক পর এখন ঠিকই টের পাওয়া যাচ্ছে বেনহামের কৌশলের প্রভাব। ব্রেন্টফোর্ড ৭৪ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ফিরেছে। প্রথম ম্যাচেই হারিয়ে দিয়েছে আর্সেনালকে।
লিভারপুলের সঙ্গে ৩-৩ গোলে ড্র করেছে। আর সে সঙ্গে দেনার দায়ে ডুবতে থাকা দলটি আর্থিক দিক থেকে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। বর্তমানে এই ক্লাবের মূল্য ৩০ কোটি ডলার (২৫৭০ কোটি টাকা)। লিগে দারুণ শুরু করা ব্রেন্টফোর্ড যদি অবনমন করে, তবু তার মূল্য ৩০ কোটি ডলার থাকবে। আর যদি এ বছর প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকে, তাহলে সে মূল্য হবে ৪০ কোটি ডলার।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এখন সম্প্রচার স্বত্ব এতটাই লোভনীয়, যত দিন টিকে থাকবে, তাদের মূল্য তত বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই এখন নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব। আর সেটা যদি না–ও করতে পারে, তার জন্য তো বেনহাম আছেনই। যখন ফুটবল ঐতিহ্যগতভাবে ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রে অ্যানালিটিকস পাত্তা দেয়নি, তখন পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে ক্লাবের ভাগ্য যিনি বদলে দিতে পারেন, তিনি নিশ্চয় প্রিমিয়ার লিগে খেলা এক ক্লাবকে নিয়ে আরও দারুণ কিছুর জন্ম দেবেন!