বেনজেমা যেভাবে এখন ব্যালন ডি’অরের এত কাছে
‘মৌসুমে ৫০ থেকে ৬০ গোল করা কারও সঙ্গে খেললে অবশ্যই তার সুবিধা করে দিতে হবে, কারণ সে প্রচুর গোল করছে। আমাকে তাই মানিয়ে নিতে হতো, নিয়েওছিলাম। কিন্তু সে যাওয়ার পর দায়িত্বটা এসে পড়ে আমার কাঁধে। কী পার্থক্য গড়ে দিতে পারি, তা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেখাতে হয় আমাকে’—কথাটা রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি ফরোয়ার্ড করিম বেনজেমার। কাকে নিয়ে তা না বললেও চলে।
কে আবার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো! পর্তুগিজ তারকা রিয়ালে থাকতে বেনজেমা ছিলেন তাঁর সহকারীর ভূমিকায়। রোনালদো যাওয়ার পর রিয়ালকে গোল এনে দেওয়ার দায়িত্বটা এখন তাঁর।
চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগে আজও সে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে বেনজেমাকে। তার প্রস্তুতিও সারা আছে দারুণভাবে—শেষ ষোলোর ফিরতি লেগে পিএসজি এবং কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে হ্যাটট্রিক করেছেন বেনজেমা।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বেনজেমার চ্যাম্পিয়নস লিগে এবারের গোল ১১টি। বায়ার্ন মিউনিখের রবার্ট লেভানডফস্কিই (১২) শুধু গোলসংখ্যায় বেনজেমার চেয়ে এগিয়ে। অথচ রিয়ালে একসময় ছিলেন রোনালদোর ছায়ায়, সতীর্থের জন্য গোল তৈরি করাই ছিল তাঁর কাজ। এখন বেনজেমাই ইউরোপের অন্যতম সেরা আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়। ২০১৮ সালে রোনালদো যাওয়ার পর রিয়ালের হয়ে ১৮৪ ম্যাচে ১২৪ গোল করেছেন বেনজেমা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বেনজেমার গোলসংখ্যা নয়, দেখতে হবে তাঁর গোলের মানও। এ মৌসুমে বেশ কিছু দুর্দান্ত গোল করেছেন ফরাসি তারকা। ৩৪ বছর বয়সে তাঁর কিছু ফিনিশিংয়ের কৌশলগত দক্ষতার সঙ্গে ইউরোপে অনেকেরই তুলনা চলে না, সেটি পা ও মাথা—দুই ক্ষেত্রেই বলা যায়।
তবে সব সময় কিন্তু দৃশ্যটা এমন ছিল না। ফিনিশিংয়ে বেনজেমার ভুলভ্রান্তি নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। রিয়ালে রোনালদোর শেষ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার সঙ্গে ২–২ গোলে ড্র ম্যাচে একটি–দুটি নয়, ছয়টি গোলের সুযোগ নষ্ট করেছিলেন বেনজেমা। রিয়াল সমর্থকদের দুয়ো শুনতে হয়।
সেই মৌসুমজুড়েই এমন চলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭–১৮ মৌসুমে লিগে বেনজেমা গোলের যত সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তা থেকে নিশ্চিতভাবে যত গোল করা উচিত ছিল, তার চেয়ে ৯ গোল কম করেছেন। কিন্তু এ মৌসুমের চিত্রটা উল্টো। সুযোগের চেয়ে গোলসংখ্যা বেশি—লিগে সম্ভাব্য ১৯.৮৫টি গোল করা উচিত ছিল, তাঁর গোলসংখ্যা ২৪।
অথচ দু–তিন মৌসুম আগেও বেনজেমার কাজ ছিল বক্সের এক প্রান্তে ডিফেন্ডারদের টেনে নিয়ে রোনালদোর জন্য জায়গা করে দেওয়া, বক্সের বাইরে থেকে গোল হওয়ার মতো পাস বানানো, বুদ্ধিদীপ্ত টোকা কিংবা তাতে অরুচি ধরলে বাঁকানো শট নেওয়া।
কিন্তু এখন এসব দক্ষতাই তিনি বক্সের ভেতরে ব্যবহার করছেন। ২০১৭–১৮ মৌসুমে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে ৯৩টি ‘টাচ’ ছিল বেনজেমার—এ মৌসুমে এখনই সেই সংখ্যাটা ৮৬, মৌসুম শেষ হতে এখনো এক মাসের বেশি বাকি।
বেনজেমা নিজের ভেতর থেকে এসব সংখ্যা বের করতে পজিশনও একটু বদল করেছেন। আগে তিনি বক্সের বাইরে খেলা তৈরি করে বাকিদেরও আক্রমণে টেনে নিতেন। এখন গোল করার জন্য পাস পান বেশি। রোনালদো যাওয়ার পর এই চার বছরে নিজের পুরোনো স্ট্রাইকার সত্তাকে খুঁজে পেয়েছেন বেনজেমা। তবে বাঁ প্রান্তে একটু ভেতর থেকে যখন ‘মুভ’ করেন, তখনই সম্ভবত খেলায় সবচেয়ে বেশি মাথা খোলে তাঁর।
গত অক্টোবরে নেশনস লিগের ফাইনালেই তা বুঝিয়েছেন বেনজেমা, যখন স্পেনের বিপক্ষে এক গোল ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল ফ্রান্স। ওই পজিশন থেকে বল পেয়ে যখন দেখলেন গোল করার মতো সুবিধাজনক অবস্থায় নেই তাঁর কোনো সতীর্থ, তখন নিজেই বাঁকানো এক শটে স্পেন গোলকিপার উনাই সিমোনের মাথার ওপর দিয়ে বল জালে চালান করেন।
পরের গোলেও ঠিক একই পজিশন থেকে যখন দেখেছেন ডান প্রান্ত কিলিয়ান এমবাপ্পে সুবিধাজনক অবস্থায়, তখন তাঁকে গিয়ে গোল করিয়েছেন।
এই জায়গায় বেনজেমা কতটা কার্যকর, তা লা লিগার চলতি মৌসুমের পরিসংখ্যানেও বোঝা যায়। বক্সের বাইরে তাঁর ৪৮ শতাংশ স্পর্শই বক্সের বাঁ দিকে। তাতে ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে জুটিটাও বেশ জমেছে তাঁর।
একে–অপরকে পাস দিয়ে গোল করিয়েছেন, এ মৌসুমে দুজনের এমন সম্মিলিত গোলসংখ্যা ১৮। প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাককে বেনজেমা ব্যস্ত রাখায় দৌড়ানোর জায়গা ও সময় দুটিই পান ভিনিসিয়ুস। তাতেই সুবিধাটা হয়েছে।
বেনজেমা কোন ধাঁচের খেলোয়াড়, ২০১৭ সালের এক মন্তব্যেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এমন স্ট্রাইকাররা আছেন যাঁরা ম্যাচে বল বানাবেন না, কিন্তু ৮৭ মিনিটে গিয়ে গোল করে খুব খুশি হবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার বল পায়ে অবদান না রেখে ৯০ মিনিটে গোল করলেও বিরক্ত লাগে।’ পাঁচ বছর আগের এই বেনজেমার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এলেও এ কথাটাই মূলত তাঁর খেলার সারসত্তা। রিয়ালের অনেক আক্রমণে মাঝের যোগসূত্র এখনো বেনজেমাই। গত সপ্তাহে চেলসির বিপক্ষে প্রথম লেগেও তা দেখিয়েছেন।
লা লিগার এই মৌসুমে বেনজেমা শুধু সর্বোচ্চ গোলস্কোরারই নন, গোল বানিয়ে দেওয়াতেও তাঁর ওপরে কেউ নেই। অর্থাৎ পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেও নিজের প্লে–মেকার সত্তা ধরে রেখেছেন। এই দুইয়ের সম্মিলনে ব্যালন ডি’অর এবার জিততেই পারেন বেনজেমা!