বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ফরমেশনের যত সুবিধা-অসুবিধা
যখন দায়িত্ব নেন তখন বিশ্বকাপ খেলার শঙ্কায় ছিল আর্জেন্টিনা। দলকে অকূলপাথারে রেখে যান এদগার্দো বাউজা। বাছাইপর্বে মাত্র চার ম্যাচ বাকি, এমন অবস্থায় তাঁর ওপর পড়ে গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গেই পালন করেছেন। হ্যাঁ পাঠক, বলা হচ্ছে আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলির কথা। চিলিকে নিয়ে ২০১৫ কোপা আমেরিকা জিতেছেন, ফাইনালে নিজের দেশ আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই!
এরপর স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ার হয়েও ছিল দারুণ পারফরম্যান্স। তবে আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার স্বপ্নের কথা সব সময়ই বলেছেন সাম্পাওলি। সুযোগটা তিনি পেয়েও যান বাউজার ব্যর্থতার ফলে।
এখন সাম্পাওলিকে ঘিরেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্জেন্টিনা। বলা হচ্ছে, ২০০৮ সালে কোকো ব্যাসিলের বিদায়ের পর এই প্রথম কোনো মানসম্পন্ন কোচ পেয়েছে আর্জেন্টিনা। বেশি সময় পাননি, তবে নিজের মতো করে সাম্পাওলি একটি দল দাঁড় করিয়েছেন। বিশ্বকাপে ঠিক কোন ফরমেশনে তিনি দলকে খেলাবেন, খেলার ধরন কোন ঘরানার হবে এ নিয়ে একটি ধারণা আর্জেন্টিনার গত কয়েকটি ম্যাচে পাওয়া গেছে।
সাম্পাওলির জায়গায় অন্য যে কেউ থাকলে হয়তো ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলার ঘরানার ফুটবলেই আস্থা রাখতেন। সাবেলার পদ্ধতি ছিল আগে রক্ষণ, পরে আক্রমণ। এবং অপেক্ষায় থাকা, আক্রমণে লিওনেল মেসি যদি কিছু করতে পারেন কিন্তু সাম্পাওলি নিজের দর্শনের ওপরই আস্থা রেখেছেন।
সাম্পাওলি মূলত ‘বিয়েলসিস্তা’ ঘরানার কোচ। বিয়েলসিস্তা কী? আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ মার্সেলো বিয়েলসার ফুটবল দর্শনকেই বলা হয় বিয়েলসিস্তা। যার মূলমন্ত্র একটাই—আগে আক্রমণ পরে রক্ষণ। সাম্পাওলি বিয়েলসারই উত্তরসূরি। সাম্পাওলির প্রিয় ফরমেশন ২-৩-৩-২। এই ফরমেশন বেছে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে সাম্পাওলির যুক্তি, ‘আমাদের একটা নির্দিষ্ট ধরন থাকা প্রয়োজন। আমার পছন্দ ২-৩-৩-২। এই ফরমেশনের ফলে মাঠের প্রত্যেক জায়গাতেই আমাদের খেলোয়াড়রা বিচরণ করতে পারবে। বল আমাদের দখলে বেশি থাকার কারণে আক্রমণ থামানো প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন হবে।’
সাম্পাওলির এই পদ্ধতির চাবিকাঠি অবশ্যই লিওনেল মেসি। মেসির সেরাটা বের করে আনতে যে পদ্ধতিতে খেলা দরকার সেটিই বের করার চেষ্টা করেছেন সাম্পাওলি।
২-৩-৩-২ ফরমেশনে দুজন স্থায়ী সেন্টারব্যাক থাকেন, যারা প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় নিজেদের ডি-বক্স পাহারা দিতেই ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের সামনে থাকেন একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, যাঁর কাজ অ্যাটাকিং থার্ডে প্রতিপক্ষের পাসিং লেন বন্ধ করে দেওয়া। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের দুই পাশে থাকেন দুজন উইংব্যাক। আক্রমণের সময় ওপরে উঠে ক্রস করা, ডিফেন্সের সময় নিজেদের ডিফেন্সের দুই লাইন পাহারা দেওয়া তাঁদের কাজ।
এর ওপরে থাকেন একজন ডিপ লাইং প্লে-মেকার। যিনি নিজেদের অর্ধ থেকে মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং প্রয়োজনে ওপরে উঠে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকাও পালন করেন। ডিপ লাইং মিডফিল্ডারের দুই পাশে থাকেন দুজন ওয়াইড মিডফিল্ডার, যারা প্রচণ্ড গতিতে ঢুকে যান প্রতিপক্ষের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে। প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় রক্ষণের প্রথম বাধাও আসে দুজন ওয়াইড মিডফিল্ডার থেকে।
সবার সামনে থাকে দুজন ফরোয়ার্ড। যাদের একজন আরেকজনের সামান্য নিচে থেকে খেলেন। একজন নাম্বার নাইন, অপরজন সেকেন্ড স্ট্রাইকার। ঠিক এখানেই আসে লিওনেল মেসির কারিশমা, সেকেন্ড স্ট্রাইকারের রোল প্লে করেন মেসি। অ্যাটাকিং থার্ডে যখন তাঁকে মার্কিং করা হয়, বল পায়ে থাকা অবস্থায় ড্রিবল করে, বল পায়ে না থাকা অবস্থায় তাঁর পেছনে ডিফেন্ডারদারদের ব্যস্ত থাকা সামনে থাকা নম্বর নাইনকে প্রচুর জায়গা করে দেয়। মেসির করে দেওয়া জায়গা কাজে লাগিয়ে ডিপ লাইং মিডফিল্ডার নিজের জায়গা পরিবর্তন করে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে আবির্ভূত হন, এবং সরাসরি প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে বিপজ্জনক বল পাঠাতে পারেন যার ফলে গোলের সুযোগ এসে যায় দলের সামনে।
এই পদ্ধতিতে খেলার ফলে আর্জেন্টিনার বল দখলের হার থাকে বেশি। মাঝমাঠে ৬ জন খেলোয়াড়ের উপস্থিতি প্রতিপক্ষের মাঝমাঠকে অচল করে রাখে। মাঝমাঠ থেকে ফরোয়ার্ড লাইনে বল পাঠানোও কঠিন হয়ে যায় তাঁদের জন্য। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে খুব দ্রুত প্রতি আক্রমণে ওঠার জন্য এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী।
সাম্পাওলির এই পদ্ধতিতে ফাঁকফোকরও রয়েছে অনেক। স্বয়ং ডিয়েগো ম্যারাডোনাই তাঁর সমালোচনা করেছেন। সাম্পাওলির দর্শন অনুযায়ী পুরো দল প্রতিপক্ষকে তাদেরই অর্ধে প্রেসিং করবে, যার ফলে সাম্পাওলির দলের ডিফেন্ডারদের হতে হবে প্রচণ্ড গতিশীল, কারণ প্রেসিং করতে গেলে ডিফেন্সে প্রচুর জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ যদি প্রেসিং ভেঙে ফেলে তাহলে গোল খাওয়া অনুমিতই। ঠিক এখানেই পিছিয়ে আর্জেন্টিনা। মার্কোস রোহো, ওটামেন্ডি কিংবা ফ্যাজিওদের কেউই ভরসা করার মতো গতিশীল নন, এমনকি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে যার ওপর ভরসা রাখতে হবে সেই হাভিয়ের মাচেরানোর বয়সও ৩৪।
রাশিয়া এবং ইতালির মতো ধীর ফুটবল খেলা দলের সঙ্গে আর্জেন্টিনা জিতেছে ঠিকই। কিন্তু নাইজেরিয়া এবং স্পেনের গতিশীল ফুটবলের বিপক্ষে হার এটিও বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্পাওলির দর্শন প্রয়োগ করার জন্য যে ধরনের ডিফেন্ডার প্রয়োজন সেটির অভাব আর্জেন্টিনার বেশ ভালোভাবেই আছে। যার কারণে গতিশীল দলগুলোর বিপক্ষে ভুগতে হতে পারে তাঁদের।
তবে সাম্পাওলি যে দর্শনই প্রয়োগ করুন না কেন, তিনি এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন সবকিছু একজন লিওনেল মেসিকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটির ওপর নির্ভর করছে। তাঁর দর্শন কাজ করুক কিংবা না করুক, সমর্থকেরা বিশ্বকাপে নতুন ধরনের এক আর্জেন্টিনাকে দেখতে পাবেন এটি এক প্রকার নিশ্চিত।