বিতর্কের কালো ছায়া যখন বিশ্বকাপে!
>বিশ্বকাপে মাঠের বাইরেও অনেক খেলা হয়। বিতর্কের ঝড় ওঠে নানা কিছু নিয়েই। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেই বড় বিতর্কগুলো নিয়েই এই আয়োজন!
লিভারপুলের কিংবদন্তি ম্যানেজার বিল শ্যাঙ্কলি একবার একটা কথা বলেছিলেন, ‘ফুটবল অনেকের কাছে জীবন-মরণের ব্যাপার। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এর গুরুত্ব তার চেয়েও আরও অনেক বেশি।’ আর এটি যদি বিশ্বকাপের আসরে হয় তাহলে এর গুরুত্ব নিয়ে আর কোনো সংশয়ই থাকে না। যেকোনো ফুটবলারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন নিজের দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয় করা। বিশ্বজয়ীর এই তকমা পেতে বিশ্বের সেরা দলগুলো তাঁদের সামর্থ্যের শেষবিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করে যায়। গৌরবের জন্য এই মরিয়া চেষ্টাই অনেক সময় জন্ম দেয় অসদাচরণের। তৈরি হয় বিতর্ক। তোলপাড় ওঠে চারদিকে। বিশ্বকাপে মাঠের বাইরের ‘খেলা’ নিয়ে কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো...
মুসোলিনি যখন বিশ্বকাপের আসল তারকা
১৯৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল ইতালি। কিন্তু ইতালির প্রথম বিশ্বকাপ-গৌরব অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাদের রাষ্ট্রপ্রধান বেনিতো মুসোলিনির নানা হস্তক্ষেপে। ইতালির এই স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদি নেতা ইতালির প্রতিটি ম্যাচের রেফারি নিজে নির্বাচন করতেন। ব্যাপারটা সবার চোখে দৃষ্টিকটু হলেও সেই স্বৈরাচারী শাসকের ভয়ে অনেকেই মুখ খোলেননি। তবে ব্যাপারটা বিশ্বকাপ ফুটবলের চিরকালীন বিতর্ক হয়েই আছে।
ফ্যাসিবাদের দম্ভ
ফ্রান্সে ১৯৩৮ বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে। বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েও হিটলারের দখলদারত্বের কারণে সেবার বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি অস্ট্রিয়া। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে কালো জার্সি পড়ে মাঠে নামে ইতালি। কালো ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী মিলিশিয়া বাহিনীর পোশাকের রং। ম্যাচ শুরুর আগে দেয় ফ্যাসিবাদি স্যালুট। তীব্র বিতর্ক আর সমালোচনা ইতালীয় দলকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলেও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। ইতালি তখন ফ্যাসিবাদের দম্ভে অন্ধ। বলা বাহুল্য সেবারও বিশ্বকাপ জয় করে ইতালি।
বিশ্বকাপ নাকি সিনেমা !
১৮৫৮ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে একটা কিন্তুর জন্ম হয়েছিল সুইডেনের সাংবাদিক সমাজে। বিশ্বকাপ ফুটবল নাকি পুরোপুরি একটা মঞ্চস্থ নাটক, যার চিত্রনাট্য রচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সদর দপ্তরে। সুইডেনের সাংবাদিকেরা অনেকেই বিশ্বাস করতেন, টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পরীক্ষা করতেই নাকি সিআইএ বিশ্বকাপ নামের প্রহসন সাজিয়েছিল। অনেক পরে ২০০২ সালে সুইডেনের পাবলিক টেলিভিশন চ্যানেল সভেরিজেস টেলিভিশনে প্রচারিত ইয়োহান লফস্টেট আর জ্যাক ডে ওয়ার্ন এর বানানো একটা ‘প্রামাণ্যচিত্রে’ দেখানো হয় যে ১৯৫৮ বিশ্বকাপটা আসলে ছিল একটা সিনেমা। সে সময় নাকি সুইডেনের আর্থিক সামর্থ্য বিশ্বকাপ আয়োজনের উপযোগী ছিল না। গোটা ‘বিশ্বকাপ’ই সিনেমার রিলে ধারণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস। সেই বিশ্বকাপের বিভিন্ন ফুটেজের মধ্যে বেশ কিছু দালান আর মাঠে খেলোয়াড়দের অস্বাভাবিক ছায়ার দৈর্ঘ্যের মাধ্যমে লফস্টেট আর ডে ওয়ার্ন প্রমাণ করার চেষ্টা করেন সেসব দালানকোঠা সুইডেনে ছিলনা, বরং লস আঞ্জেলসেই সে ধরণের দালান দেখা যেত। যদিও পরবর্তীতে তারা নিজেরাই বলেছেন এটা আসলে তাঁরা মানুষদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বানিয়েছিলেন!
ভিদেলার হাত ধরে আর্জেন্টিনার প্রথম শিরোপা?
১৯৭৬ সালেই সামরিক অভ্যুত্থান হয় আর্জেন্টিনায়। দেশটির সামরিক জান্তা মাত্র দুই বছরের মধ্যেই বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিল বিশ্বকাপকে। এ উপলক্ষে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষকে শহর থেকে বিতাড়িত করে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামাঞ্চলে, যেখানে বিশ্বকাপের ডামাডোল নেই। স্বৈরশাসক হোর্হে ভিদেলা আরও একটি স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। তাঁর শাসনামলেই যেন আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিততে পারে—এমন লক্ষ্য স্থির করলেন তিনি। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে হলে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে পেরুকে কমপক্ষে ৪ গোলের ব্যবধানে হারাতে হতো আর্জেন্টিনাকে। আর্জেন্টিনা ম্যাচটি জেতে ৬-০ গোলে। ব্যাপারটা বিতর্ক ছড়ায় ব্যাপক। কারণ বিশ্বকাপের প্রথম ৫ ম্যাচে পেরে মাত্র ৬ গোল হজম করেছিল। কানাঘুষা উঠল ভিলা নাকি বিপুল অর্থের বিনিময়ে পেরে কিনে ফেলেছেন। ব্যাপারটা আরও ডালপালা মেলে বিশ্বকাপের পরপরই দারিদ্র্যপীড়িত পেরুতে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন গম পাঠানো হলে। পাশাপাশি আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জব্দ হয়ে থাকা পেরুর ৫০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিয়ে দেওয়ার পর নিন্দুকেরা ব্যাপারটি বিশ্বাসই করা শুরু করে দেন।
ক্রুইফকে হুমকি
১৯৭৮ বিশ্বকাপের আগেই হল্যান্ডের কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফের বার্সেলোনার বাড়িয়ে দুর্বৃত্তরা হামলা করেছিল। ক্রুইফ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে ক্রুইফকে বলা হয়েছিল বিশ্বকাপে না খেলার জন্য। এই ঘটনার পরে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরই নিয়ে নেন ডাচ তারকা। ১৯৭৮ সালের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পরাজিত হওয়া সেই হল্যান্ড দলে ক্রুইফ থাকলে ফলাফলটা হয়তো ভিন্নও হতে পারত!
ফ্রান্স-ব্রাজিলের যৌথ কারসাজি?
১৯৯৮ বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফ্রান্স, জিতেও নেয় তারা। কিন্তু কিছুদিন আগেই সাবেক উয়েফা সভাপতি ও ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা মিশেল প্লাতিনি স্বীকার করেছেন ফ্রান্সের বিশ্বকাপ আয়োজনের পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। এমনকি তখন গ্রুপিংটা এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে ফাইনালের আগে ফ্রান্সকে তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের মুখোমুখি না হতে হয়। পরে বিশ্বকাপ অর্জন করার জন্যেও ফ্রান্স বেশ ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। প্লাতিনির স্বীকারোক্তিতে পরে শোনা গেছে ১৯৯৮ বিশ্বকাপটা মূলত ফিফার অনুরোধে ফ্রান্সকে ছেড়ে দেয় ব্রাজিল। ফিফা নাকি ব্রাজিলকে কথা দেয় যেভাবেই হোক পরবর্তী বিশ্বকাপ জেতানো হবে তাদের। বলা বাহুল্য, ২০০২ বিশ্বকাপ এই রোনালদোর নৈপূণ্যেই ঘরে তোলে ব্রাজিল, আর প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ যায় ফ্রান্স!