বার্সার ঘর যেভাবে জার্মানদের দখলে
শুরুতেই একটা গুণ অঙ্ক করা যাক।
৯০x২৫০০০= ২২,৫০,০০০ ইউরো।
আরেকটা অঙ্কও করে ফেলা যাক।
১৬০x২৫০০০= ৪০,০০,০০০ ইউরো।
এ দুটি ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রাঙ্কফুর্টের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ থেকে বার্সেলোনার বাড়তি আয়ের হিসাব। ক্যাম্প ন্যুতে ম্যাচ দেখতে আগ্রহী দর্শকের কাছে টিকিট বিক্রি করে ক্লাব যে অর্থ আয় করেছে, তার একটা অংশ এ দুটি অঙ্ক।
তবে এর অন্য একটি মানেও আছে বার্সেলোনার সমর্থকদের কাছে। ঘরের মাঠে বার্সেলোনার ৩-২ গোলে হার আর সে সুবাদে ইউরোপা লিগ থেকেও বাদ পড়াতেও নাকি ভূমিকা এই দুটি সংখ্যার।
এমনিতেই চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে না পারার দগদগে ক্ষত। আর সে ক্ষতে রীতিমতো লবণ ডলে দিয়েছে ফ্রাঙ্কফুর্ট। ইউরোপা লিগের মতো দ্বিতীয় সারির মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি বার্সেলোনা। এর মধ্যেই কাতালানদের লজ্জা বাড়িয়েছে ঘরের মাঠ। কাল রাতে ক্যাম্প ন্যু চলে গিয়েছিল জার্মান ক্লাবের সমর্থকদের দখলে। প্রতিপক্ষ সমর্থকদের দাপটে নতজানু বার্সেলোনা সমর্থকদের। ঘরের মাঠে এমন বৈরী আবহাওয়ায় কাবু বার্সেলোনার পেদ্রি-আলবা-বুসকেতসরাও। হারের পর কারণ খুঁজতে গিয়ে কোচ জাভি তাই প্রতিপক্ষের এত দর্শকের দায়ও দেখেছেন।
বার্সা এখন তদন্তে নেমেছে। কীভাবে এত ফ্রাঙ্কফুর্ট-সমর্থক স্টেডিয়ামে ঢুকলেন, সেটি খুঁজে বের করার কথা বলেছেন বার্সা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা। কিন্তু লাপোর্তা নিজে কি সেটা জানেন না?
গত সপ্তাহে স্প্যানিশ ফুটবলের পরিচিত মুখ রিক শর্মা একটি টুইট করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বার্সেলোনাভিত্তিক অন্য বেশ কিছু টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও এর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছিল। শর্মা টুইটে বলেছিলেন, ‘মৌসুমি টিকিটধারী কিন্তু এই মৌসুমে আর কোনো ম্যাচে যাবেন না, এমন সমর্থকদের টিকিটগুলো মুফতে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে বার্সেলোনা। যাতে বার্সেলোনা সে টিকিটগুলো আবার বিক্রি করতে পারে এবং স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ হয়। এতে ক্লাবকে “আর্থিকভাবে সাহায্য করার তৃপ্তি” পাবেন সমর্থকেরা এবং স্টেডিয়ামে সম্ভাব্য সেরা পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।’
ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো ঘরের মাঠের ম্যাচের টিকিট দুভাবে বিক্রি করে। ক্লাবের সদস্য ও পাঁড় সমর্থকেরা মৌসুমের সব ম্যাচের টিকিট আগেই কিনে ফেলেন একবারে। অর্থাৎ ম্যাচে যান বা না যান, টিকিট আগেই কেনা থাকে। আর বাকি টিকিটগুলো প্রতি ম্যাচ ধরে ধরে বিক্রি হয়। অর্থাৎ ম্যাচে যাবেন নিশ্চিত হয়েই মানুষ টিকিট কেনেন। বার্সেলোনা চাইছিল, স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেন খালি না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে মৌসুমি টিকিটের একটা অংশও নতুন করে বিক্রি করতে।
হঠাৎ বার্সেলোনা এই প্রস্তাব কেন দিয়েছে, এর ব্যাখ্যায় শর্মা টুইটে লিখেছেন, ‘এর পেছনে বার্সেলোনা সেভিয়া ম্যাচের উদাহরণ দিয়েছে। সে ম্যাচে কাগজে-কলমে সব টিকিট বিক্রি হলেও মাঠে ৭৬ হাজার দর্শক ছিলেন। অর্থাৎ প্রায় ২০ হাজারের মতো মৌসুম টিকিটধারী সেদিন যাননি। অথচ এই ম্যাচ দেখার আগ্রহী অনেকেই আছেন, চাইলেই এই টিকিট ক্লাব বিক্রি করতে পারত।’
এমন কিছু যে নতুন কিছু নয়, সেটা আরেক টুইটে জানিয়েছেন শর্মা, ‘আগের মৌসুমগুলোতে বার্সা এ কাজটা নিজেরাই করত, তখন নতুন করে বিক্রি হওয়া টিকিটের লাভের অংশ মৌসুম টিকিটধারী সমর্থকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিত ক্লাব। এই মৌসুমে এটা করা হয়নি।’
আর্থিকভাবে ভোগা বার্সেলোনা এই মৌসুমে আর আয়ের অর্থ ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দেয়নি। সরাসরিই বলে দিয়েছে, টিকিটটা ফেরত দিতে, আর সেটা বিক্রি করে ক্লাব যে অর্থ পাবে, সেটা এই আর্থিক দুর্দশায় ক্লাবকে সহযোগিতা করবে।
বার্সেলোনার এক সূত্র জানিয়েছে মৌসুম টিকিটধারী ২৬ হাজার সমর্থক এতে সায় দিয়েছেন। অর্থাৎ ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো ক্লাবের (বুন্দেসলিগায় নয়ে আছে তারা) সঙ্গে বার্সেলোনার খেলা দেখার আগ্রহ হয়নি তাদের। সে টিকিটগুলো নতুন করে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে বার্সেলোনা।
বাড়তি লাভের আশায় বার্সেলোনা আরেকটি কাজ করেছে। এই নতুন করে পাওয়া টিকিটগুলোর গায়ে চড়া মূল্য বেঁধে দিয়েছে। বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, একেকটি টিকিট ১৬০ ইউরো মূল্যে বিক্রি করেছে বার্সেলোনা। অথচ তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বার্সার ম্যাচ টিকিট ৬০ থেকে ৭০ ইউরোর মধ্যেই পাওয়া যায়। বার্সেলোনা ফ্রাঙ্কফুর্ট ম্যাচের জন্য টিকিটের মূল্য যা ধরেছে, সেটা আগের মৌসুমগুলো শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল পর্যায়েই ধরা হতো।
ফলটা মিলেছে মাঠেই, প্রায় এক লাখ ধারণ ক্ষমতার ক্যাম্প ন্যুতে কাল দর্শক ছিলেন মাত্র ৭৯ হাজার ৪৬৮ জন। বার্সেলোনার লজ্জা পুরো করতে এর ৩০ হাজারই ছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্টের। ঘরের মাঠে প্রতিপক্ষের দর্শকই ৪০ ভাগের বেশি—এমন অভাবনীয় কিছু তাই কাল দেখা গেছে ক্যাম্প ন্যুতে।
অথচ নিয়ম অনুযায়ী একটি ক্লাবকে ন্যূনতম ৫ শতাংশ টিকিট প্রতিপক্ষের জন্য রাখতে হয়। বার্সেলোনাও সে নিয়ম মেনে ফ্রাঙ্কফুর্টের দর্শকদের জন্য ৫ হাজার টিকিট রেখেছিল। তাহলে বাকি ২৫ হাজার দর্শক এসেছে কোথা থেকে?
এ ব্যাপারে বার্সেলোনার প্রাতিষ্ঠানিক সহসভাপতি এলেনা ফোর্ত বলেছেন, ‘স্টেডিয়ামে আসা সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। গতকাল যা ঘটেছে, তা লজ্জার ও অগ্রহণযোগ্য। যা হয়েছে, এর জন্য গভীরভাবে অনুতপ্ত। জার্মানদের টিকিট কেনার সীমা আগেই নির্ধারিত ছিল। এ জন্য বার্সেলোনা বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে, তা যথেষ্ট ছিল না।’
এই ব্যবস্থার একটি ছিল, জার্মান ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেউ টিকিট কাটতে পারবেন না। তবু নিজেদের দর্শকদের টিকিট কীভাবে প্রতিপক্ষ দর্শকের কাছে গেছে এর ব্যাখ্যায় ফোর্ত বলেছেন, ‘বার্সেলোনা সরাসরি জার্মানদের কাছে টিকিট বিক্রি করেনি। একটা উপায়ে জার্মান সমর্থকেরা টিকিট পেয়েছেন, আর তা হলো টিকিট পুনরায় বিক্রির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যাঁদের স্প্যানিশ ক্রেডিট কার্ড আছে। নিশ্চিতভাবে এই উপায়ে তাঁরা টিকিট কিনেছেন, কিন্তু এটাই একমাত্র নয়। এ নিয়ে ক্লাবকে ভাবতে হবে এবং বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা উপায় হলো টিকিটে নাম দিয়ে দেওয়া। হয়তো আমাদের সংস্কৃতিতেই বদল আনতে হবে এবং স্টেডিয়ামে ঢোকার ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা নেওয়া হয়নি।’
ফোর্ত যে দিকটা তুলে ধরেননি, সেটি হচ্ছে, টিকিটের মূল্য। বার্সেলোনা চাইলেই এই ২৬ হাজার টিকিটের মূল্য নিজের সমর্থকদের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে পারত। অর্থাৎ ৬০ থেকে ৭০ ইউরোর মধ্যে। তাতেও কিন্তু ক্লাবের লাভ হতো। কারণ, এই ৬০–৭০ ইউরো কিন্তু এবার আর সমর্থকদের সঙ্গে আয়ের অর্থ ভাগ করতে হতো না বার্সেলোনাকে। কিন্তু কাতালান ক্লাব টিকিটের মূল্য আকাশচুম্বী করে রেখেছে।
নিজেদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও জুভেন্টাসের মতো ক্লাবগুলোকে নিয়মিত খেলতে দেখা সমর্থকদের এ নিয়ে আগ্রহ জাগেনি।
ফ্রাঙ্কফুর্টের সমর্থকদের বিষয়টা তো আর এমন নয়। বার্সেলোনার মাঠে খেলা দেখার সুযোগ তো সব সময় আসে না। তাই নির্ধারিত ৫ হাজার টিকিটের জন্য ৩৫ হাজার সমর্থক আবেদন করেছিলেন। এই পাগল সমর্থকেরাই তাই অনলাইনে এ ম্যাচের টিকিট পেয়ে আর দাম নিয়ে ভাবেননি। সদলবল হাজির হয়েছেন সবাই। ম্যাচের আগেই বার্সেলোনার রাস্তায় নিজেদের জাহির করেছেন। গ্যালারি দখল করে গর্জন তুলেছেন। নিজের মাঠেই তাই দুয়ো শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছে বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের।
টিকিটপ্রতি ৯০ ইউরো বেশি লাভ করতে চেয়েছে বার্সেলোনা। ২৫ হাজার টিকিটে ২২ লাখ ৫০ হাজার ইউরো আয়ও করেছে ক্লাব।
২২ লাখ ৫০ হাজার ইউরোর মূল্যটা একটু বেশিই দিয়ে ফেলল বার্সেলোনা?