তিন প্রজন্মের ফুটবল পরিবার
বাবার পর ছেলে নয়, শ্বশুরের পর জামাতা
বাবার পথ ধরে ছেলেও ফুটবলার হয়েছেন—এমনটা হরহামেশাই দেখা যায়। দেখা গেছে একই পরিবারের একাধিক ভাইকেও ফুটবল খেলে বিখ্যাত হতে। কিন্তু দাদা-বাবা-নাতি—তিন প্রজন্মই ফুটবলার এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন, এমন ঘটনা একটু বিরলই।
এ বছরের শুরুর দিকে দাদা সিজার মালদিনি ও বাবা পাওলো মালদিনির পথ ধরে এসি মিলানের মূল দলে অভিষেক হয়েছে ড্যানিয়েল মালদিনির। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফুটবলার হওয়ার ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত পরিবার মালদিনিরাই। তবে তাঁরাই একমাত্র নন। তিন প্রজন্মের এমন কিছু ফুটবল পরিবার নিয়েই এবারের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব—
হার্নান্দেজ পরিবার
প্রথম প্রজন্ম: টমাস বালকাসার
দ্বিতীয় প্রজন্ম: হাভিয়ের হার্নান্দেজ গুতিয়েরেজ
তৃতীয় প্রজন্ম: হাভিয়ের হার্নান্দেজ বালকাসার
১৯ জুন, ১৯৫৪। জেনেভায় বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি ফ্রান্স-মেক্সিকো। শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো ৩-২ গোলে ম্যাচটা হারলেও ফ্রান্সের জালে একটা গোল দিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী মেক্সিকান স্ট্রাইকার টমাস বালকাসার।
এবার ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে ৫৬ বছর সামনে চলে আসুন। ১৭ জুন, ২০১০। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে আরও একবার মুখোমুখি ফ্রান্স-মেক্সিকো। এবার আর হারতে হয়নি মেক্সিকোকে, জয় এল ২-০ গোলে। সেই দুই গোলের একটা করলেন হাভিয়ের হার্নান্দেজ, যাঁর পদবি বালকাসার এবং বয়স ২২ বছর।
কাকতালীয় না তো কি! বিশ্বকাপে একই দলের বিপক্ষে ৫৬ বছর আগে-পরে নানা-নাতি দুজনেই ২২ বছর বয়সে গোল করেছেন, এমন ঘটনা ইতিহাসে আর আছে বলে জানা যায়নি।
সাধারণত বাবার দেখানো পথে ছেলে হাঁটেন। কিন্তু বালকাসারের পর সেই পতাকা বয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর জামাতা, তারপর দৌহিত্র। হাভিয়ের হার্নান্দেজ বালকাসারের বাবা এবং টমাস বালকাসারের জামাতা হাভিয়ের হার্নান্দেজ গুতিয়েরেজও মেক্সিকোর বিখ্যাত ফুটবলার। মেক্সিকান ফুটবলে হার্নান্দেজ পরিবারটাই কিংবদন্তির মতো। টমাস বালকাসার প্রায় এক দশকের মতো খেলেন মেক্সিকোর শীর্ষ ক্লাব গুয়াদালাহারাতে। এই ১০ বছরে ৮টি শিরোপা জিতেছে গুয়াদালাহারা। ওই সময় ক্লাবের নামই হয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পেওনিসিমো বা ‘চ্যাম্পিয়ন’।
বিশ্বকাপে একই দলের বিপক্ষে ৫৬ বছর আগে-পরে নানা-নাতি দুজনেই ২২ বছর বয়সে গোল করেছেন, এমন ঘটনা ইতিহাসে আর আছে বলে জানা যায়নি।
মেক্সিকোর ইতিহাসে মাত্র দুটি ক্লাব কখনো শীর্ষ লিগ থেকে অবনমিত হয়, গুয়াদালাহারা তার একটি। ওরা একমাত্র মেক্সিকান ক্লাব যারা কোনো বিদেশি খেলোয়াড় নেয় না কখনো। টমাস বালকাসার সেই ক্লাবের রূপকথার অংশ।
বালকাসারের কন্যাকে বিয়ে করার আগেই হাভিয়ের হার্নান্দেজ গুতিয়েরেজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। কে জানে, হয়তো ভালো ফুটবলার বলেই তাঁর হাতে কন্যাকে সঁপে দিয়েছিলেন টমাস বালকাসার। শ্বশুরের মতো গুতিয়েরেজ অবশ্য গুয়াদালাহারাতে খেলেননি, ক্যারিয়ারের বড় সময়টা কাটিয়েছেন তেকোস ও আতলেতিকো মোরেলিয়ায়। শ্বশুর স্ট্রাইকার হলেও জামাতা ছিলেন মিডফিল্ডার। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের আগে–পরে মিলিয়ে মেক্সিকোর হয়ে বছর দুয়েক খেলেছেন বালকাসার। তবে তাঁর জামাতার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বেশ দীর্ঘ, খেলেছেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে মেক্সিকোর যে দলটা, সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন গুতিয়েরেজ। খেলতে পারতেন চার বছর পর ১৯৯০ বিশ্বকাপেও। কিন্তু এর আগে ফিফার একটি বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে মেক্সিকো বেশি বয়সী খেলোয়াড় নামানোয় ১৯৯০ বিশ্বকাপ থেকে মেক্সিকোকে নিষিদ্ধই করে দেয় ফিফা। সবুজ চোখের কারণে ক্লাব ও জাতীয় দলের সতীর্থতা তাঁকে ডাকতেন ‘চিচারো’ (মটরদানা) নামে।
বংশগতিবিজ্ঞানের সূত্র মেনে বাবার কাছ থেকেই সবুজ চোখ পেয়েছেন ১৯৮৮ সালে জন্মানো হাভিয়ের হার্নান্দেজ বালকাসারও। তাঁর নাম তাই ছোটবেলা থেকে হয়ে যায় ‘চিচারিতো’ (ছোট মটরদানা)। নানার মতো চিচারিতোর ক্যারিয়ার শুরু গুয়াদালাহারায়, মাত্র ৯ বছর বয়সে। ১৫ বছর বয়সে ক্লাবের সঙ্গে প্রথম পেশাদার চুক্তি সই করেন। ডাক পান মেক্সিকোর বয়সভিত্তিক দলে। তত দিনে মেক্সিকোর আগামীর প্রতিভা হিসেবে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর। তবে বেড়ে ওঠার সময়ে তাঁর ‘আইডল’ কিন্তু বাবা বা নানা ছিলেন না। মেক্সিকান দুই বিখ্যাত ফুটবলার হুগো সানচেজ ও রাফায়েল মার্কেজকে আদর্শ মানতেন চিচারিতো।
নানা-বাবা-নাতি—এই পরিবারের তিনজন বিশ্বকাপে খেলেছেন, এমন ঘটনা ফুটবলেই বিরল।
নানা-বাবা দুজনের চেয়ে চিচারিতোর ক্যারিয়ার আরও বর্ণাঢ্য। গুয়াদালাহারার পর খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ইউরোপের অন্যতম সেরা দুই ক্লাবে। ইউনাইটেডের হয়ে দুবার প্রিমিয়ার লিগ, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ক্লাব বিশ্বকাপ জেতার পর সেভিয়ার হয়ে ছুঁয়েছেন ইউরোপা লিগের শিরোপা। ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৮—তিনটি বিশ্বকাপেই খেলেন মেক্সিকান এই ফরোয়ার্ড, গোল করেছেন। মেক্সিকোর হয়ে জিতেছেন ২০১৫ কনক্যাকাফ গোল্ড কাপও। নানা-বাবা-নাতি—এই পরিবারের তিনজন বিশ্বকাপে খেলেছেন, এমন ঘটনা ফুটবলেই বিরল।
৩২ বছর বয়সী চিচারিতো এখন খেলছেন এলএ গ্যালাক্সিতে। ২০২২ বিশ্বকাপেও তাঁকে মেক্সিকোর জার্সিতে দেখা গেলে অবাক হবেন না কিন্তু!
ফোরলান পরিবার
প্রথম প্রজন্ম: হুয়ান কার্লোস কোরাজ্জো
দ্বিতীয় প্রজন্ম: পাবলো ফোরলান
তৃতীয় প্রজন্ম: ডিয়েগো ফোরলান
হুয়ান কার্লোস কোরাজ্জো ফুটবলটা খারাপ খেলতেন না। আর্জেন্টাইন ক্লাব ইন্দিপেন্দিয়েন্তের হয়ে তো গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে দাপটের সঙ্গেই খেলেছেন। তবে দেশের হয়ে খুব বেশি খেলা হয়নি তাঁর। ১৯২৮ সালে দুটি ম্যাচের পরে জাতীয় দলে আর ডাক পাননি এই মিডফিল্ডার।
আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ তখন এত বেশি হতো না, আর বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে মাত্র। খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে না খেলতে পারার এই আক্ষেপ কোরাজ্জো ঘুচিয়েছেন কোচ হিসেবে। তাঁর অধীনেই ১৯৬২ বিশ্বকাপে খেলে উরুগুয়ে। তত দিনে দুবার বিশ্বসেরা হয়ে গেছে উরুগুয়ে। তবে ওই বিশ্বকাপ থেকে উরুগুয়ে বিদায় নিয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকেই।
১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে কোরাজ্জোর অধীনে টানা ১৪ ম্যাচ অপরাজিত থেকে নতুন রেকর্ড গড়েছিল তাঁর দল। যে রেকর্ড ২০১২ সালে এসে অস্কার তাবারেজের উরুগুয়ে দল ভেঙেছে টানা ১৮ ম্যাচ অপরাজিত থেকে।
কোরাজ্জোকে অবশ্য তার পরেই বিদায় করে দেয়নি উরুগুয়ের ফুটবল প্রশাসন। ১৯৯৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন, পরে আরেক দফায় হাল ধরেছেন ১৯৬৭ সালে এসে। তাঁকে কোচ হিসেবে রেখে দেওয়ার সুফল তারা পর পেয়েছেও। উরুগুয়েকে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছেন, ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে কোরাজ্জোর অধীনে টানা ১৪ ম্যাচ অপরাজিত থেকে নতুন রেকর্ড গড়েছিল তাঁর দল। যে রেকর্ড ২০১২ সালে এসে অস্কার তাবারেজের উরুগুয়ে দল ভেঙেছে টানা ১৮ ম্যাচ অপরাজিত থেকে।
কোরাজ্জোর গল্পটাও বালকাসারের মতো। ছেলে নয়, তাঁর পরিবারের ফুটবল ঐহিত্যের হাল ধরেন জামাতা পাবলো ফোরলান। বেশ কয়েক দফা উরুগুয়েকে কোচিং করালেও ইংল্যান্ডে হওয়া ১৯৬৬ বিশ্বকাপে কোরাজ্জো দায়িত্বে ছিলেন না। নইলে শ্বশুরের অধীনে খেলতেন জামাতা পাবলো ফোরলান। শুধু ১৯৬৬ বিশ্বকাপই নয়, পাবলো খেলেছেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপেও। পেনারল, সাও পাওলো, ক্রুজেইরো ও ন্যাসিওনালের হয়ে খেলা এই ডিফেন্ডার শিরোপা জিতেছেন উরুগুয়ে ও ব্রাজিল এই দুই দেশেই।
পাবলো যে বছর ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া ফুটবলে নিজের শেষ ট্রফিটা জিতলেন, তার বছর দুয়েক আগেই জন্ম নেয় ছেলে ডিয়েগো ফোরলান। কোনো সন্দেহ ছাড়াই যিনি এই পরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবলার।
শুরু উরুগুয়ের ফুটবলেই নয়, ডিয়েগো ফোরলান আসলে বিশ্ব ফুটবলেরই কিংবদন্তিদের একজন। পেনারলের একাডেমিতে ক্যারিয়ার শুরুর পর ইন্দিপেন্দিয়েন্তে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ভিয়ারিয়াল, আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইন্টার মিলানে ঝলমলে ক্যারিয়ার। লা লিগায় মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের পুরস্কার পিচিচি ট্রফি জিতেছেন দুবার, একবার ভিয়ারিয়াল ও অন্যবার আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে। ওই দুই মৌসুমেই পেয়েছেন ইউরোপে মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের জন্য ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু–ও।
২০১০ বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জিতেছেন ফোরলান, ছিলেন টুর্নামেন্টের যুগ্ম সর্বোচ্চ গোলদাতাও।
উরুগুয়ের হয়ে ২০১০ বিশ্বকাপটা তো স্বপ্নের মতোই কেটেছে ফোরলানের। দল শেষ পর্যন্ত তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে বিদায় নিলেও ওই বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জিতেছেন ফোরলান, ছিলেন টুর্নামেন্টের যুগ্ম সর্বোচ্চ গোলদাতাও। এমনকি জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে দুর্দান্ত এক ভলি থেকে করা তাঁর গোলটা পেয়েছে টুর্নামেন্টের সেরা গোলের পুরস্কারও। এর আগে–পরে মিলিয়ে মোট ৩টি বিশ্বকাপ খেলেছেন ফোরলান, দেশের হয়ে ১১২ ম্যাচে ৩৬ গোল এই ফরোয়ার্ডের। ২০১১ সাল থেকে উরুগুয়ের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটাও তাঁর নামের পাশেই ছিল, পরে অবশ্য সেই রেকর্ড নিজের করে নেন লুইস সুয়ারেজ।
স্ত্রী পাজ কারদোসোর গর্ভে এরই মধ্যে দুই পুত্র ও এক কন্যার বাবা হয়েছেন ফোরলান। এই পরিবারের ফুটবল–ঐতিহ্য চতুর্থ প্রজন্ম ধরে রাখবে কি না, সেটা সময়ই বলবে।