বাঁ পায়ের এবং বাঁ পথের ম্যারাডোনা
এ পৃথিবী ছেড়ে চলে তিনি গেছেন প্রায় চার বছর আগে, ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বরে। বেঁচে থাকলে আজ ডিয়েগো ম্যারাডোনার বয়স হতো ৬৪। এ গ্রহের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে এই লেখাটা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
ফুটবলার না হলে এই লোক নিঃসন্দেহে বিপ্লবী হতেন!
ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে পরিচয়ের মিনিট পাঁচেক পরেই নাকি এই কথা মনে হয়েছিল এমির কুস্তুরিকার।
সার্বিয়ান বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক কুস্তুরিকা ম্যারাডোনা নামে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন, ২০০৮ সালে যেটা প্রথম দেখানো হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। খুব আহামরি কোনো সিনেমা নয়। অন্তত হোয়েন ফাদার ওয়াজ অ্যাওয়ে ফর বিজনেস বা টাইমস অব দ্য জিপসিজ–এর মতো সিনেমার পরিচালকের কাছে যে প্রত্যাশা থাকে, সেটার ধারেকাছেও যেতে পারেননি কুস্তুরিকা। অথচ ম্যারাডোনাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি বানাতে দুই বছরের মতো সময় নিয়েছেন পরিচালক, বেশ কয়েকবার ম্যারাডোনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
এসবের কোনো ছাপ সিনেমায় পড়েনি। শুধু তাঁর বলা কথাটাই দর্শকের মনে দাগ কাটে বেশ—ফুটবলার না হলে এই লোক নিঃসন্দেহে বিপ্লবী হতেন!
আচ্ছা, এটাও কি খুব নতুন উপলব্ধি? চে গুয়েভারার দর্শন ধারণ করেছিলেন, ফিদেল কাস্ত্রোকে যিনি বলতেন ‘দ্বিতীয় বাবা’, ডান হাতে চে আর বাঁ পায়ে কাস্ত্রোর উল্কি এঁকে ঘুরতেন, তিনি বিপ্লবী হবেন না তো আর কে হবে!
বিখ্যাত উরুগুইয়ান ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালানো, যিনি নিজেও সারা জীবন দক্ষিণ আমেরিকানদের ওপর হওয়া অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে লিখে গেছেন, তিনি একবার বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনার কণ্ঠই অনুরণিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাবান ও শোষকদের দিকে অপ্রিয় সব প্রশ্ন ছুড়ে দিতে সাহস জুগিয়েছে অনেককে।’
আসলেই তো। পুরোদস্তুর রাজনীতির মানুষ না হয়েও আপাদমস্তক এক রাজনৈতিক সত্তা ছিল ম্যারাডোনার। তাঁর মতো করে আর কে জাগাতে পেরেছে আর্জেন্টিনা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত মানুষকে! নিজের শৈশব ও কৈশোর নিদারুণ দারিদ্র্য ও কষ্টে কেটেছে বলে সব সময় তিনি এই সব মানুষের পক্ষে থেকেছেন, এটা অনেকে বলে।
কিন্তু কৈশোরের পরে তো অবিশ্বাস্য রকম বিলাসবহুল জীবন কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন, আর্থিক বিচারে চলে গেছেন সমাজের উঁচু শ্রেণিতে। কিন্তু সেই ম্যারাডোনাও কি কখনো ভুলে থেকেছেন বঞ্চিতদের কথা?
এই তো কিছুদিন আগে ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে দেওয়া জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারেও উঠে এসেছে করোনা মহামারিতে আর্জেন্টিনার দরিদ্র মানুষদের নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা।
তিনি বলেছেন, ‘রাস্তায় যখন অনাহারী কোনো শিশুকে দেখি, আমার মন কাঁদে। আমি জানি না খেয়ে দিনের পর দিন কাটানোর কষ্ট কী! আমি আর্জেন্টিনার মানুষকে সুখী দেখতে চাই, চাই তাদের যেন কখনো কাজের আর খাবারের অভাব না হয়।'
জাদুকরি বাঁ পায়ের মতো রাজনৈতিক দর্শনেও তিনি ছিলেন বাঁ পথের পথিক। আর পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, বাঁয়ের পথে যাঁরা হাঁটেন, তাঁরা সাধারণত বিপ্লবীই হন।
সে জন্যই লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের বামপন্থী নেতা ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ম্যারাডোনার বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগত না মোটেও। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ কিংবা বলিভিয়ার ইভো মোরালেসের পক্ষে সারা জীবন কথা বলেছেন সংশয় ছাড়া, তাঁদের হয়ে রাজনৈতিক প্রচারেও নেমেছেন। এই রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এটা কখনো ভাবেননি।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করে এক র্যালিতে অংশ নিয়েছিলেন ‘ঠেকাও বুশ’ লেখা টি-শার্ট পরে। ওই র্যালিতেই বক্তব্য দিতে গিয়ে আমেরিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে বলেছিলেন ‘মানব আবর্জনা’।
ফুটবলের দ্বৈরথে লাতিন প্রতিবেশী ব্রাজিলের সঙ্গে চিরশত্রুতা আর্জেন্টিনার। কিন্তু সে জন্য ব্রাজিলিয়ানদের হয়ে কথা বলতেও কখনো পিছপা হননি।
ব্রাজিলিয়ান এক ক্রীড়া সাংবাদিক ২০১৪ বিশ্বকাপের একটা ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছেন ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর। সাও পাওলো স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে, ভিআইপি বক্সে ম্যারাডোনা বসে সেটা দেখছেন, সঙ্গে তাঁর চেনাজানা কয়েকজন সাংবাদিক।
ব্রাজিলের তখনকার প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফ কথা বলতে উঠেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের ভিআইপি বক্স থেকেই দুয়োর সুর উঠল। কেন তারা এমন করছে, বুঝতে না পেরে ম্যারাডোনা এক সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করলেন।
উত্তর পেলেন, ব্রাজিলের ধনিক শ্রেণির মানুষেরা রোসেফকে পছন্দ করে না, তাই তারা তাঁকে দুয়ো দিচ্ছে, এমনকি নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ায় গালাগালও দিচ্ছে অনেকে। রেগে গিয়ে ম্যারাডোনা নাকি বলেছিলেন, ‘সব কটাকে চাবকানো উচিত। অসভ্যের দল!’
কয়েক মাস পর যখন ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে অভিশংসিত হলেন, সবার আগে ম্যারাডোনাই নাকি ফোন করেছিলেন তাঁকে। বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ শুনে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে দিলমা বলেছেন, ‘ও আমাকে ফোন করে বলেছিল, সবটুকু হৃদয় দিয়ে সে আমার পাশে আছে।’
হুগো চাভেজের মৃত্যুর পর ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মানুষটা আমাদের আমেরিকার দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।
লাতিন আমেরিকাকে মাথা উঁচু করে চলতে শিখিয়েছে।’ ফিলিস্তিনির ওপর ইসরায়েলের রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছেন সব সময়। ২০১৮ বিশ্বকাপের সময় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
নিজের একটা ১০ নম্বর জার্সি উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যান, আমি আছি পাশে।’ তাঁর মৃত্যুর পর রামাল্লায় এক তরুণ আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি বুকে নিয়ে কাঁদছেন, অন্তর্জালে যদি এমন কোনো ছবি দেখে থাকেন, বুঝবেন সেটা অকারণ নয়।
বুয়েনস এইরেস থেকে হাভানা, সাও পাওলো থেকে সান্তিয়াগো, ম্যারাডোনার মৃত্যুসংবাদটা পড়তে গিয়ে হু হু করে কেঁদেছেন টেলিভিশনের কত সংবাদ উপস্থাপক, ইউটিউবের অলিগলিতে তার প্রমাণ।
এটা কি শুধু তিনি খুব ভালো ফুটবলার ছিলেন, এই কারণেই? নাকি ম্যারাডোনা জড়িয়ে ছিলেন তাঁদের জীবনের সঙ্গেও!
ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা রাজনীতি থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে চেয়েছে সব সময়। খেলার মাঠেও রাজনৈতিক আচরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ম্যারাডোনা সেসব আর কবে পাত্তা দিয়েছেন! ইংল্যান্ডের কাছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল যাঁর কাছে ফকল্যান্ড যুদ্ধের বদলা, তাঁকে কি এসব নিয়মকানুন দেখিয়ে আটকানো যায়!
খোদ ফিফার মধ্যেই যে অন্যায়-দুর্নীতি চলছে, সেটার বিরুদ্ধেও তো ম্যারাডোনাই সবার আগে মুখ খুলেছিলেন। ভাবা যায়, একজন ফুটবলার তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে ফিফাকে ‘মাফিয়া’ বলে দিচ্ছেন পুরো বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের সামনে!
পেলে-জিকোরা প্রায় পুরো জীবন ফিফার দূত হয়েই কাটিয়ে দিলেন, ম্যারাডোনা সেখানে ব্রাত্য ছিলেন প্রায় সব সময়। সেটা কি শুধু তিনি মাদক ও উদ্দাম জীবনে আসক্ত ছিলেন বলেই, নাকি তাঁকে ধারণ করতে কিছুটা ভয় পেত ফিফাও?
আর্জেন্টিনায় তিনি ফুটবল ঈশ্বর। মাঠের বাইরে তাঁর হাজারো কেলেঙ্কারি সেই ঐশ্বরিক ম্যারাডোনাকে বরং কিছুটা মানবীয় রূপ দিয়েছে। এই উপলব্ধি সম্ভবত ম্যারাডোনারও ছিল।
নইলে কি আর বলেন, ‘আমি ম্যারাডোনা, যে গোল করে, আবার ভুলও করে। কিন্তু সব ভুলের দায় নেওয়ার এবং সবার সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট চওড়া কাঁধ আমার আছে।’
বুক চিতিয়ে এমন কথা ম্যারাডোনা ছাড়া আর কে বলতে পারেন!