বদলে যাওয়া এই নেইমারের আরও সম্মান পাওনা

নেইমার এখন দল অন্ত প্রাণ।ছবি: রয়টার্স

আতালান্তার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে পিএসজির ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুটা হয়েছিল মূলত ৯০ মিনিটের দিকে। ম্যাচটির আগে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে হইচই কম হয়নি। এটি যে ছিল করোনাভাইরাসে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বেরগামো অঞ্চলের দল আতালান্তার সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাবের খেলা। এর সঙ্গে ম্যাচের আগে ছিল পিএসজির সবচেয়ে বড় তারকা নেইমারকে নিয়ে নানা ধরনের খবর।

চোখ ধাঁধানো বেতন আর রক তারকার মতো জীবনাচারণ—নেইমারের খেলার চেয়ে সব সময় এসবই খবর হয়েছে বেশি। গত বুধবার ম্যাচের শেষ মুহূর্তেও আতালান্তা যখন ১-০ গোলে এগিয়ে, ফুটবল বিশ্বের অনেকেই নেইমার ও তাঁর পিএসজির হারই দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর নাম যে নেইমার, তিনি কি এত সহজে হার মানতে পারেন! ম্যাচজুড়েই অসাধারণ খেলে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের পাস থেকে ৮৯ মিনিটে পিএসজিকে সমতায় আনেন মারকিনিওস।

এর ঠিক ১৪৯ সেকেন্ড পর, ম্যাচের যোগ করা সময়ে আবার নেইমার-জাদু। বক্সের ভেতরে ঢুকে পড়া কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দিলেন রক্ষণচেরা এক পাস। এমবাপ্পের কাট-ব্যাক খুঁজে নেয় এরিক ম্যাক্সিম চুপো-মোতিংকে। ২-১ গোলের জয় নিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে পিএসজি। ম্যাচ শেষে নেইমার বলেছিলেন, ‘হেরে বাড়ি ফিরে যাব—এমন কথা আমি কখনো ভাবিইনি। আমরা কখনোই হাল ছেড়ে দিইনি। আমার ফাইনালে ওঠার ইচ্ছাটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’

চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে দুর্দান্ত এই পারফরম্যান্স, ম্যাচের শেষাবধি এমন মানসিক দৃঢ়তা দেখানোর জন্য নেইমারের প্রশংসা কম হয়নি। কিন্তু সমালোচনাও কি কম হয়েছে? ম্যাচে বল পায়ে দারুণ সব ঝলক দেখালেও, পিএসজির সব আক্রমণের প্রাণ হয়ে থাকলেও, নেইমারের বেশ কয়েকটি মিস যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিতই নাড়িয়ে দিয়েছে। নেইমার এমন মিস করতে পারেন!

নেইমার অবশ্য সমালোচনায় এতদিনে হয়তো অভ্যস্তই হয়ে গেছেন। প্রশংসার চেয়ে ক্যারিয়ার জুড়ে তাঁর সমালোচনাই যে হয়েছে বেশি! কখনো হয়তো সেই সমালোচনা যুক্তিযুক্তই ছিল, কখনো তা আবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফুটবলের বাইরে তাঁর সমালোচনা মূলত তাঁর উদ্ধত আচরণ আর খেয়ালি জীবনাচরণের জন্যই হয়। ফুটবলীয় একটা কারণও অবশ্য আছে। সাধারণ ফুটবল অনুসারী থেকে ফুটবল পণ্ডিত—অনেকেই মনে করেন, যে প্রতিভা নিয়ে নেইমার ফুটবলে এসেছিলেন সেটার পূর্ণ বিকাশ তিনি ঘটাতে পারেননি। সেরা হওয়ার সুযোগ ব্রাজিলিয়ান ‘ফুটবল শিল্পী’ হেলায় হারিয়েছেন বলেই মনে করেন অনেকে।

আতালান্তার বিপক্ষে অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন নেইমার।
ছবি: রয়টার্স

নিজের সৃজনশীলতা আরও বাড়ানোর চেয়ে উদ্দাম পার্টি করাতেই বেশি মনযোগ নেইমারের—এমন কথা বলার লোকের সংখ্যাও কম নয়। ফুটবল বিশ্বে নেইমার অনেকের কাছে ‘জোকার।’ তাঁকে যাঁরা খুব ভালোবাসেন, তাঁদের কাছেও যে খুব শ্রদ্ধার পাত্র নেইমার, ব্যাপারটা তেমন নয়। নেইমারের সমালোচনা তাঁরা একটু অন্যভাবে করেন, একটু নরম গলায়। বাড়ির আহ্লাদি ছেলেটাকে যেভাবে সবাই বকা দেয় আর কী! ‘বয়স বাড়লেও ছেলেটা আর বড় হলো না’—নেইমারকে ভালোবাসার লোকেরা এভাবেই আফসোস করেন!

তবে ২০১৭ সালে ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়ে (২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো) বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে নাম লেখানোর পর এই তিন বছরে অনেক পরিণত হয়েছেন নেইমার। পিএসজি আসলে তাঁকে একটি চ্যাম্পিয়নস লিগের আশায় দলে এনেছিল। এটা ঠিক যে প্যারিসের ক্লাবটির সেই আশা এখনও পূরণ করতে পারেননি নেইমার। সেটির পেছনে অবশ্য তাঁর চেয়েও দায় বেশি চোটের। পিএসজিতে নাম লেখানোর পর টানা দুই মৌসুমে পায়ের একই মেটাটারসালের চোটে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। দুই মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোতে চার ম্যাচের মাত্র একটিতে খেলতে পেরেছেন নেইমার, দুই মৌসুমেই শেষ ষোলোতে বিদায় নেয় পিএসজি।

হারিয়ে যাওয়া সেই সময়টা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এখন অবশ্য করছেন নেইমার। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে উদ্দাম রাতে ভাটা পড়েছে তাঁর। খেলা ছিল না, কিন্তু পার্টিও তো ছিল না। পার্টিতে সময় ব্যয় করতে হয়নি। সেই সময়টা নেইমার করোনার সময়ে দিয়েছেন নিজেকে ফিট রাখার জন্য। জিমে প্রায় প্রতিদিনই কঠিন পরিশ্রম করেছেন। এর ছাপও দেখা গেছে করোনার ফুটবলে ফেরার পর তাঁর খেলায়। চিরায়ত ব্রাজিলিয়ান সেই ঝলক যে নেইমারের মধ্যে এখনও আছে, সেটা তো আতালান্তা ম্যাচেই দেখা গেছে। ড্রিবলিং, নাটমেগ (কোনো খেলোয়াড়ের দুই পায়ের মাঝ দিয়ে বল নিয়ে যাওয়া)—সেদিন কী ছিল না নেইমারের খেলায়! নিজের সেরা দিনে নেইমার যে বিশ্বের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতিতে মেসি-রোনালদোর চেয়ে কোনো অংশে কম নন, সে দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ হয়ে ওঠার মতো ঝলক ছিল তাঁর ফুটবলে।

তবে এ তো মাত্র শুরু! অনেকের চোখেই, তাঁকে আরও প্রমাণ দিতে হবে। কাল রাত বাংলাদেশ সময় চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লাইপজিগের বিপক্ষে নামবে পিএসজি, সেখানে আরেকবার নেইমার ঝলকের আশায় পিএসজি সমর্থকেরা। সেমিফাইনাল পেরোতে পারলে ফাইনালেও একই প্রত্যাশাই আরও জাঁকিয়ে বসবে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের কাঁধে। পিএসজিকে একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ না জেতালে যে চলছে না নেইমারের!

পিএসজিতে বেশ জমে উঠেছে নেইমার-এমবাপ্পে জুটি।
ছবি: রয়টার্স

এমন এক সময়ে তিনি এসেছেন, যে সময়ে ফুটবল বিশ্ব দেখেছে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। নেইমারের কথা এলেই তাই আসবে কে কয়টা শিরোপা জিতেছেন সে হিসাব। আসবে কে কয়টা ব্যালন ডি’অর জিতেছেন সেই প্রসঙ্গ। দুটি দিক থেকেই যে নেইমার এখনও মেসি-রোনালদোর চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে।

ব্রাজিলকে কনফেডারেশনস কাপ আর অলিম্পিক সোনা এনে দিয়েছেন, পিএসজির হয়ে ফ্রান্সের ঘরোয়া সব ট্রফি জিতেছেন। বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন বটে, কিন্তু সে তো মেসির অর্জন বলেই বেশি স্বীকৃত। এর আগে সান্তোসকে দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি কোপা লিবার্তাদোরেস জিতিয়েছেন, কিন্তু সেটিও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর মতো মর্যাদা পায় না। পিএসজিকে একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতালেই হয়তো এই চাপ থেকে মুক্তি মিলবে নেইমারের। আর ব্যালন ডি’অর? সেই ১৮-১৯ বছর বয়স থেকে ‘সম্ভাব্য ব্যালন ডি’অরজয়ী’ নেইমারের এখনও সত্যিকারের ব্যালন ডি’অরজয়ী হওয়া হয়নি।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে কিন্তু তাঁর রেকর্ড দুর্দান্ত। পিএসজির হয়ে সব ধরনের প্রতিযোগিতায় ৮৩টি ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৭০ টি। ৪০টি গোল করিয়েছেন সতীর্থদের দিয়ে। যে কারও জন্যই পরিসংখ্যানটি দুর্দান্ত।

এ তো গেল মাঠের পারফরম্যান্সে নেইমারের পরিণত হয়ে ওঠার গল্প। পিএসজির ভেতরকার খবর, নেইমার এখন ড্রেসিংরুমেও নেতা হয়ে উঠেছেন। কেইলর নাভাস ও মারকিনিওসের সঙ্গে তিনিও নাকি তরুণ খেলোয়াড়দের পরামর্শ দেন, উদ্বুদ্ধ করেন। সব মিলিয়ে প্রশংসা এখন ‘নতুন’ নেইমারের প্রাপ্যই।

প্রাপ্য প্রশংসাটা পেতে আর শুধু দুটি ম্যাচে আলো ছড়াতে হবে নেইমারকে। আর দুটি ম্যাচে জেতাতে হবে পিএসজিকে—চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। তবেই হয়তো ফুটবল বিশ্ব নেইমারের সত্যিকারের মূল্য বুঝতে পারবে। সমালোচনা এক পাশে রেখে করবে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের সত্যিকারের প্রশংসা।