কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় ১০০ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
ফ্রান্সের বর্তমান দলটির সামনে ইউরো জয়ের সুযোগ এসেছিল পাঁচ বছর আগেই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দুর্দান্ত পর্তুগালের কাছে বশ না মানলে হয়তো ইউরোপের সেরা তখনই হয়ে যেত ফরাসিরা। সেই জ্বালা তারা দুই বছর পর মিটিয়েছে বিশ্বকাপ জিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দিদিয়ের দেশমের কোনো আক্ষেপ থেকে থাকলে, সেটা ইউরো জিততে না পারা। দেশম তা জিততে কতটা মরিয়া, বোঝা গেছে তাঁর কিছু কাজের মাধ্যমে।
করিম বেনজেমা, আদ্রিয়াঁ রাবিওদের দলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিতেন না দেশম। রাগ ভুলে সেই দেশমই এখন তাঁদের দলে ডেকেছেন। কারণ একটাই, দেশের স্বার্থে ইউরো জিততে যোগ্য সবাইকে দলের ছায়াতলে আনতে হবে। সে লক্ষ্যে ফ্রান্সের দলটা কেমন হলো? আসুন দেখে নেওয়া যাক একনজরে—
দল: ফ্রান্স
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২
দলে আছেন যাঁরা
গোলরক্ষক
হুগো লরিস (টটেনহাম হটস্পার), মাইক মাইনিয়ান (এসি মিলান), স্তেভ মাঁদাঁদা (অলিম্পিক মার্শেই)
সেন্টারব্যাক
রাফায়েল ভারান (রিয়াল মাদ্রিদ), প্রেসনেল কিমপেম্বে (পিএসজি), কুর্ত জুমা (চেলসি), ক্লেমঁ লংলে (বার্সেলোনা), জুলস কুন্দে (সেভিয়া)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
লিও দুবোয়া (অলিম্পিক লিওঁ), বেঞ্জামিন পাভার (বায়ার্ন মিউনিখ)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক
লুকাস দিনিয়ে (এভারটন), লুকাস হার্নান্দেজ (বায়ার্ন মিউনিখ)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
এনগোলো কান্তে (চেলসি), পল পগবা (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), আদ্রিয়াঁ রাবিও (জুভেন্টাস), মুসা সিসোকো (টটেনহাম হটস্পার), করেনতাঁ তোলিসো (বায়ার্ন মিউনিখ)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
টমাস লেমার (আতলেতিকো মাদ্রিদ)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার
কিলিয়ান এমবাপ্পে (পিএসজি), কিংসলে কোমান (বায়ার্ন মিউনিখ), মার্কাস থুরাম (বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখ) ওসমান দেম্বেলে (বার্সেলোনা), আঁতোয়ান গ্রিজমান (বার্সেলোনা)
স্ট্রাইকার
করিম বেনজেমা (রিয়াল মাদ্রিদ), উইসাম বেন ইয়েদের (মোনাকো), অলিভিয়ের জিরু (চেলসি)
কোচ
দিদিয়ের দেশম
অধিনায়ক
হুগো লরিস
ইউরোয় সেরা সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৪, ২০০০)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
জার্মানি (১৫ জুন)
হাঙ্গেরি (১৯ জুন)
পর্তুগাল (২৩ জুন)
শক্তি
ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তাদের সমন্বয় ও জেতার মানসিকতা। যে দলীয় সমন্বয় বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে, তা ইউরোতেও সফল হবে না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। দলটির প্রত্যেকে খুব ভালোভাবেই তাঁদের সামর্থ্য, দায়িত্ব, ক্ষমতা বোঝেন। কাকে কী করতে হবে, কী করলে শিরোপা জেতা যাবে, সবকিছু জানা। দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বন্ধুত্বও আছে বেশ, রেষারেষি নেই বললেই চলে।
গতকাল ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওই এর প্রমাণ। গ্রিজমান ফুটবল কোচের খেলা খেলতে গিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, নিউক্যাসল ইউনাইটেডের কোচ হয়ে আকাশচুম্বী দাম দিয়ে সতীর্থ এমবাপ্পেকে কিনেছেন! এমবাপ্পে তা দেখে জানালেন, মেঘে ঢাকা বৃষ্টিময় ইংল্যান্ডে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই তাঁর! তাঁদের কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হলেন মাঝে থাকা দেম্বেলে।
দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির কৃতিত্ব দেশমের। তিনি কোচ হয়ে আসার আগে ফ্রান্স দলে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত, কখনো বেনজেমা-ভালবুয়েনার কারণে, কখনো এভরা-গোভু কিংবা আনেলকার জন্য।
মূল স্ট্রাইকার জিরুর বিকল্প হিসেবে কে খেলবেন, সেটা একটু চিন্তার বিষয় ছিল এত দিন। ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝেড়ে সে জায়গাতেও এখন দেশম ডেকেছেন বেনজেমাকে। বেনজেমা, গ্রিজমান, এমবাপ্পের আক্রমণভাগ নিঃসন্দেহে এবারের ইউরোয় সবচেয়ে শক্তিশালী। বেঞ্চ থেকে দেম্বেলে কিংবা কোমানের মতো খেলোয়াড় এসেও দলকে প্রয়োজনীয় গোল এনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন।
দুর্বলতা
কোনো দুর্বলতা থেকে থাকলে সেটা লেফট উইং পজিশন। এই পজিশনে খেলার জন্য দেশমের নির্ভরযোগ্য মাতুইদি নেই এবার, সে জায়গায় রাবিও বা বায়ার্নের করেনতাঁ তোলিসো কেমন খেলতে পারেন, সেটার ওপর নির্ভর করতে পারে ফ্রান্সের ভাগ্য। রক্ষণভাগের মূল খেলোয়াড়দের কেউ চোটে পড়লে দলটায় যোগ্য বিকল্প আছে কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-২-৩-১)
বিশ্বজয়ের ফর্মুলা থেকে দেশম সরে আসবেন, এমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি। তাই যথারীতি ৪-২-৩-১ ছকেই ইউরোতেও দেখা যাবে ফরাসিদের, যা দুই উইঙ্গারের মুভমেন্টের ওপর নির্ভর করে ৪-৩-১-২ হয়ে যায়। ইউরোতেও ফ্রান্সের মূল একাদশ অনেকটা বিশ্বকাপের মূল একাদশের মতোই হবে।
গোলকিপার হিসেবে দলের অধিনায়ক হুগো লরিসের ক্লাব ফর্ম পড়তির দিকে হলেও জাতীয় দলে তিনি এখনো কোচের প্রধান পছন্দ। রাইটব্যাক ও লেফটব্যাক হিসেবে খেলবেন, ফ্রান্সকে যাঁরা বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন—বায়ার্ন মিউনিখের জোড়া ফুলব্যাক যথাক্রমে পাভার ও হার্নান্দেজ। সেন্টারব্যাক ভারান, দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কান্তে ও পগবা, রাইট উইঙ্গার এমবাপ্পে ও আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার গ্রিজমানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সামুয়েল উমতিতির বাজে ফর্ম, চোট সমস্যা ও ব্লেইজ মাতুইদির বয়স বেড়ে যাওয়ায় এ দুই জায়গায় নতুন খেলোয়াড় খেলাতে পারে ফ্রান্স।
সে ক্ষেত্রে সুযোগ পাবেন পিএসজির সেন্টারব্যাক প্রেসনেল কিমপেম্বে ও জুভেন্টাসের মিডফিল্ডার। বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স কিংবা গত ইউরোর ফাইনাল খেলা দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল লেফট উইং। যেখানে প্রথাগত কোনো লেফট উইঙ্গার খেলাতেন না দেশম। সে জায়গায় পরিশ্রমী একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার খেলাতে পছন্দ করতেন, যিনি বিপরীত উইংয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে ওপরে ওঠার ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি মাঝমাঠে কান্তে ও পগবাকে বাড়তি সাহায্য করতে পারেন। এ ভূমিকায় গত ইউরোতে খেলেছিলেন মুসা সিসোকো আর গত বিশ্বকাপে মাতুইদি।
মাতুইদির বয়স হয়ে গেছে, ইউরোপ ছেড়ে এখন খেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামিতে। সিসোকো দলে থাকলেও নির্ভরযোগ্য নন এখন আর। তাই এ জায়গায় খেলাতে রাগ ভুলে জুভেন্টাসের রাবিওকে ডেকেছেন দেশম। ২০১৮ বিশ্বকাপ স্কোয়াডের স্ট্যান্ডবাই তালিকায় থাকার কারণে রেগেমেগে বিকল্প দল থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন রাবিও।
দেশম তখন পাল্টা রেগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আর কখনো এই মিডফিল্ডারকে দলে ডাকবেন না। কিন্তু সেসব এখন অতীত। রাবিও নিয়মিত লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলবেন, ধরে নেওয়া যায়। মাতুইদির চেয়ে কৌশলগতভাবে বেশি দক্ষ জুভেন্টাসের এই মিডফিল্ডার, পরিশ্রমও করতে পারেন ভালোই।
মূল স্ট্রাইকার হিসেবে দেশমের পছন্দের তারকা অলিভিয়ের জিরু ক্লাব ফুটবলে নিয়মিত না খেললেও জাতীয় দলের মূল একাদশে জায়গা নিয়ে কখনো সংশয়ে পড়েননি। তবে এবার হতে পারে। সদ্যই ফ্রান্সের হয়ে ১০০ ম্যাচ খেলা জিরুর বিকল্প হিসেবে প্রায় ছয় বছর পর ডাক পেয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের করিম বেনজেমা। এই বয়সেও বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার এই বেনজেমা। মূল স্ট্রাইকার হিসেবে জায়গা পেতে জিরু আর বেনজেমার মধ্যে জোর লড়াই হবে।
এমবাপ্পে ও গ্রিজমানের অবশ্য সে চিন্তা নেই। চোট সমস্যায় না পড়লে তাঁরা ফ্রান্সের মূল একাদশে থাকবেন, এটা নিশ্চিত।
‘এই ইউরো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, বিশ্বকাপ জেতার কারণে সবাই আমাদের ফেবারিট বলছে, আমরা সেটা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য এখন যে ম্যাচ যখন সামনে আসে, সেটা জেতা’
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
ইউরোয় যেসব দল খেলবে, তাদের মধ্যে খুব কম দলেরই প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে মেলবন্ধন রয়েছে। ফ্রান্স তাদের মধ্যে একটা দল। গতবার একটুর জন্য ইউরো হারানো দলটা এবার অন্যতম ফেবারিট। বাস্তবতাও তাদের শিরোপা জয়ের পক্ষেই কথা বলছে। আর সেটা যদি হয়েই যায়, ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে দুবার পরপর বিশ্বকাপ ও ইউরো জেতার কৃতিত্ব গড়বে ফরাসিরা।