‘ফিনল্যান্ড এখন আমার কাছে অতীত, বর্তমান শুধুই বাংলাদেশ’

কাল জাতীয় দলের অনুশীলনে তারিক কাজী।ছবি: বাফুফে

গত ৬ অক্টোবর ২০ বছরে পা দিয়েছেন। টগবগে তারুণ্যের ঝলক তাঁর শরীরে। লাল-সবুজের টানে ফিনল্যান্ড থেকে ঢাকায় এসেছেন গত ২৭ অক্টোবর। স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে খেলার। আগামী ১৩ ও ১৭ নভেম্বর ঢাকায় নেপালের বিপক্ষে দুটি ফিফা প্রীতি ম্যাচে সেই সুযোগ নিতে চান তারিক রায়হান কাজী। গতকাল বৃহস্পতিবার অনুশীলন শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ৩৪ জনের প্রাথমিক দল থেকে চূড়ান্ত দলে জায়গা পাওয়াই এখন তাঁর লক্ষ্য।

ফিনল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৬ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত চারটি বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতা তাঁর বড় শক্তি। সঙ্গে শারীরিক সামর্থ্য। ৫ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সুঠাম শরীর। কোচ জেমি ডে-কে সন্তুষ্ট করে বাংলাদেশ দলে জায়গা নিতে পারবেন তারিক? ২০১৩ সালে যেমনটা লোডভিক ডি ক্রুইফের নজরে পড়ে জাতীয় দলে আসেন ডেনমার্কে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জামাল ভূঁইয়া। সেই জামাল আজ জাতীয় দলের অধিনায়ক, বাংলাদেশের ফুটবলের পোস্টারবয়। তারিকও সে পথে হাঁটতে চান। পারবেন বলেই তাঁর বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে এসব নিয়েই কথা বললেন তরুণ ডিফেন্ডার।

বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামার স্বপ্ন তাঁর।
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: বাংলা বলতে পারেন?

তারিক কাজী: একটু একটু বলতে পারি। প্রতিদিন শিখছি ( হাসি)।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেন আপনি। সেই স্বপ্ন পূরণে প্রথমবার বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে যোগ দিলেন। কেমন লাগছে?

তারিক : অসাধারণ। এই অনূভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি ইতিবাচক আছি। কীভাবে আরও ভালো করব সেই চিন্তা করছি। অনুশীলনে এসে সবকিছু দেখলাম। এটা নতুন এক অভিজ্ঞতা।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের কোন ম্যাচ দেখেছেন?

তারিক: দেখেছি। গত জানুয়ারিতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে বুরুন্ডির সঙ্গে বাংলাদেশের সেমিফাইনালটা গ্যালারিতে বসে দেখা হয়েছে। আমার কাছে সরাসরি ম্যাচটা দেখতে অনেক ভালো লেগেছে।

প্রশ্ন: জামাল ভূঁইয়া সহজে ৭ বছর আগে বাংলাদেশ দলে জায়গা পেলেও আপনার জন্য কাজটা কঠিন। কারণ, আপনি ফুলব্যাক হিসেবে খেলেন, এবং সেখানে এখন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একটু আগে কথাটা বলেছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম। আপনাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এমন কথাও বলেছেন বাংলাদেশ দলের এই মিডফিল্ডার...

তারিক: আমি জানি দলে জায়গা পাওয়া সহজ নয়। তবে আমি শুধু চেষ্টা করতে পারি। বাকিটা কোচ দেখবেন। কোচকে সন্তুষ্ট করে চূড়ান্ত দলে আসতে চাই। তারপর যা হওয়ার হবে। আর মামুন ভাই যা বললেন, অবশ্যই আমি ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। কষ্ট করতে কোনো সমস্যা নেই আমার।

প্রশ্ন: ফিনল্যান্ড একটি ফুটবলে উন্নত দেশ। ফিফা র‍্যাঙ্কি ৫৫। দেশটির জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ আপনার রয়েছে। সেই সুযোগ আসবে বলে আপনার সম্পর্কে জানেন এমন সবাই বলছেন। তারপরও ১৮৭ ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ের ফুটবল-অনুন্নত বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চান কেন?

তারিক: বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। এটা আমার বাবার দেশ। এ দেশের হয়ে খেললে আমি আরও ভালো করব এই বিশ্বাস আছে। যদিও আমি ফিনল্যান্ড অনূর্ধ্ব১৬ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে খেলছি। রাশিয়া, বেলজিয়াম ইত্যাদি দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয়েছে বয়সভিত্তিক স্তরে। তবে ফিনল্যান্ড জাতীয় দলে খেলিনি। আমি চাই বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে। ফিনল্যান্ড এখন আমার কাছে অতীত। বর্তমান হচ্ছে শুধুই বাংলাদেশ।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ দলে খেলার স্বপ্নটা কখন দেখতে শুরু করেন?

তারিক: যখন মনে করেছি আমার পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভালো করা সম্ভব। ফিনল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে খেলে আমি নিজেকে তৈরি করেছি। চেষ্টা করলে ফিনল্যান্ড জাতীয় দলেও হয়তো সুযোগ পেতে পারি। কিন্তু আমার কাছে ফিনল্যান্ডের চেয়ে বাংলাদেশের হয়ে খেলাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এ দেশে অনেক আত্মীয় স্বজন আছে আমার। সব মিলিয়ে লাল-সবুজ পতাকা আমাকে টানে। সেই টানেই স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি চলে এসেছি।

প্রশ্ন: করোনার আগে আপনি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেলেছেন রক্ষণভাগে। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?

তারিক: খুবই ভালো। বসুন্ধরা বড় দল। এই দলে জায়গা পাওয়া সহজ নয়। তারপরও বাতিল হয়ে যাওয়া গত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরার ৬ ম্যাচের ২টিতে খেলেছি আমি।

প্রশ্ন: আপনার ফিটনেস ভালোই মনে হচ্ছে। করোনাকালে নিজেকে কীভাবে ফিট রাখলেন?

তারিক: গত ছয় মাস আমি ফিনল্যান্ডে আমার সাবেক দলের সঙ্গে অনুশীলন করেছি।

প্রশ্ন: কোন দল?

তারিক: ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ পেশাদার লিগের খেলা এফসি ইলভেস। এটি আমার শহর টেমপেরের ক্লাব। তবে আমি ফিনল্যান্ডে প্রথমে খেলেছি ফিনল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই ইউরোপা লিগের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার (ইউরোপা লিগের ফার্স্ট কোয়ালিফাইং রাউন্ডের দ্বিতীয় লেগে বুলগেরিয়ার স্লাভিয়া সোফিয়ার বিপক্ষে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত প্রথম ফুটবলার তারিক যিনি ইউরোপা লিগের ম্যাচ খেলার স্বাদ পেয়েছেন)।

প্রশ্ন: ফিনল্যান্ডে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কেমন?

তারিক: কোভিড আছে সেখানে। তবে সরকার সব নিয়ন্ত্রণেই রেখেছে।

প্রশ্ন: আপনার বাবা-মা কি এখন ফিনল্যান্ডে? পরিবারে আর কে কে আছেন? ফিনল্যান্ডের কোথায় থাকেন?

তারিক: এক বড় ভাই আর দুই ছোট বোন আছে। ভাই শেফ। বোনদের বয়স ৮ আর ১০ বছর। বাবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। আমরা টেমপেরে শহরে থাকি। হেলসিংকি থেকে সড়কে ২ ঘন্টার পথ।

প্রশ্ন: আপনার বাবার বাড়ি নওগাঁ। কিন্তু আপনার জন্ম-বেড়ে ওঠা সব ফিনল্যান্ডে। বাংলাদেশের পরিবেশ-আবহাওয়া সবই আপনার জন্য ভিন্ন। মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে?

তারিক: বড় পার্থক্যটা অবশ্যই আবহাওয়া। ফিনল্যান্ডে যখন বরফ পড়ে ঢাকায় তখন ৩০-৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ২৭ অক্টোবর আমি এসেছিলাম মাইনাস ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে। এখানে তাপমাত্রা প্রায় ৩৫। কাজেই বরফ থেকে এসে গরমে মানিয়ে নিতে সমস্যা হতেই পারে। তবে এসব কোনো সমস্যা নয় আমার কাছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু দারুণ কেটেছে। সবাই আমাকে এখানে স্বাগত জানিয়েছে।

প্রশ্ন: এখানে আসার আগে বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারকে চিনতেন? 

তারিক: জামাল ভূঁইয়ার নাম শুনেছি। তিনি এখন এ দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা। ডেনমার্ক থেকে এসে জায়গা করে নেন বাংলাদেশে দলে। দারুণভাবে এগিয়ে চলেছেন। ইমন মাহমুদের কথা শুনেছি। যদিও তিনি জাতীয় দলের এই ক্যাম্পে নেই। আর মামুনুল ইসলামকে এখানে সবাই চেনে। আমিও তাঁর কথা শুনেছি।

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় ফুটবলার কে?

তারিক: ছোট বেলায় থিয়েরি অঁরি ছিলেন। তাই আর্সেনালের ম্যাচ বেশি দেখতাম। এখন ভালো লাগে আর্সেনালের আক্রমণাত্মক রাইটব্যাক এক্তর বেয়েরিনকে।

প্রশ্ন: ছোটবেলাটা কেমন কেটেছে?

তারিক: খুবই ভালো। পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। ফুটবল খেলতাম। খেলার প্রতি নেশা আসলে সব সময়ই ছিল। বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা পেয়েছি। তাঁরা আমাকে যত্ন করে বড় করেন। তাই আমি আজ এখানে। আমার স্বপ্ন যাতে পূরণ হয় সেই দোয়া চাই সবার কাছে।