ইউনাইটেড নাকি পেনাল্টি বেশি পায়?
মঙ্গলবার সাউদাম্পটনের মাঠে হারের পর ইয়ুর্গেন ক্লপের কথাটা যে বিতর্ক উসকে দেবে, তা তখনই অনুমান করা যাচ্ছিল। এমনিতেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিজেদের পক্ষে বেশি পায় বলে ইংল্যান্ডে-ইউরোপে একটা ফিসফিসানি চালু আছে, ক্লপের কথা যেন সলতেতে আগুন ধরিয়ে দিল!
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ উলে গুনার সুলশার কি আর এসব শুনে বসে থাকেন? তিনিও ক্লপকে পাল্টা জবাব দিলেন। বলে দিলেন, ক্লপের ইচ্ছে হলে ইউনাইটেড কত পেনাল্টি পেয়েছে সেটা বসে বসে গুনতে পারেন, তাঁর অত সময় নেই!
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সাউদাম্পটনের বিপক্ষে লিগে ১-০ গোলে হেরে যায় লিভারপুল। ম্যাচে সালাহ-মানে-ফিরমিনোরা লিভারপুলের অনেক সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি, লিভারপুল রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছে। লিভারপুলের সাদিও মানেকে সাউদাম্পটন বক্সে ফেলে দিলেও লিভারপুল পেনাল্টি পায়নি, পেনাল্টি পায়নি নিজেদের বক্সে সাউদাম্পটনের এক ডিফেন্ডারের হাতে বল লাগার পরও।
এ নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ক্লপ সেদিন বলেছিলেন, ‘শুনতে পেয়েছি, আমি (লিভারপুলে) সাড়ে পাঁচ বছরে যত পেনাল্টি পেয়েছি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গত দুই বছরেই তার চেয়ে বেশি পেনাল্টি পেয়েছে। জানি না এখানে আমার কোনো দোষ আছে কি না বা এমনটা কীভাবে হচ্ছে!’
গত মৌসুমে এফএ কাপের সেমিফাইনালে ম্যান ইউনাইটেডের মুখোমুখি হওয়ার আগে চেলসি কোচ ল্যাম্পার্ডও প্রায় একই সুরে বলেছিলেন, ম্যান ইউনাইটেড বেশি পেনাল্টি পায়! সেই কথাটা সেদিন ম্যাচে ইউনাইটেডের হারে বড় অবদান রেখেছে বলে হচ্ছে ইউনাইটেড কোচ সুলশারের। সেদিন চেলসি বক্সে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আন্থনি মার্শিয়ালের ওপর চেলসি ডিফেন্ডার কার্ট জুমার ফাউলে ইউনাইটেডের পেনাল্টি পাওয়া উচিত ছিল বলে মনে হচ্ছে সুলশারের।
‘অন্য কোচেরা এমন কিছু বললে তাঁদের এমনটা বলার কারণ তো আমি তাঁদের হয়ে বলতে পারি না। হ্যাঁ, গত বছর এফএ কাপে এমন কথা প্রভাব ফেলেছিল কারণ, ফ্র্যাঙ্ক (ল্যাম্পার্ড) এটা নিয়ে কথা বলেছিল এবং পরে আমাদের প্রাপ্য একটা পেনাল্টি আমরা পাইনি। তাই ব্যাপারটা হয়তো রেফারিদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলার একটা চেষ্টা। আমি নিশ্চিত জানি না, এটা নিয়ে আমি ভাবিও না। প্রতিপক্ষ (পেনাল্টি বক্সে) আমাদের খেলোয়াড়কে ফাউল করলে সেটা পেনাল্টি হবেই।’
অবশ্য পেনাল্টি নিয়ে কথাগুলো ১৭ জানুয়ারি কতটা প্রভাব ফেলে, তা দেখার বিষয় হবে। সেদিন যে লিভারপুলের মাঠে যাবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যান ইউনাইটেড!
তার আগে এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান, তা অবশ্য ক্লপের দাবিকেই প্রমাণ করে। দলগুলোর পেনাল্টি পাওয়ার তথ্য বলে, এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত লিগে ম্যান ইউনাইটেড পেনাল্টি পেয়েছে ৬টি, লিভারপুল পেয়েছে ৫টি। এখানে ব্যবধানটা কম মনে হবে, তবে বিবেচনা যদি করা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সুলশার ইউনাইটেডের দায়িত্ব নেওয়ার পরের সময়টা, তাহলে ক্লপের দাবির যথার্থতার প্রমাণ মেলে। সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৪২টি পেনাল্টি পেয়েছে ইউনাইটেড, এ সময়ে লিভারপুল পেয়েছে ১৯টি!
আর ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর ক্লপ লিভারপুলের দায়িত্ব নেওয়ার পরের সময়ের হিসাব করলে? এ সময়ে লিগে লিভারপুল পেনাল্টি পেয়েছে ৩০টি। আর এই সাড়ে পাঁচ বছরে লিগে সবচেয়ে বেশি ৪৫টি পেনাল্টি পেয়েছে লেস্টার সিটি, ম্যান সিটি পেয়েছে ৪৩টি, আর এই তালিকায় তিনে থাকা ম্যান ইউনাইটেড পেয়েছে ৪১টি। মজার ব্যাপার, ম্যান ইউনাইটেডের এই ৪১টি পেনাল্টির মধ্যে ৩২টিই এসেছে ২০১৮-১৯ মৌসুমের শুরু থেকে। অর্থাৎ ক্লপের কথাই ঠিক! এই সময়ে (২০১৮-১৯ মৌসুমের শুরু থেকে) লিভারপুল পেনাল্টি পেয়েছে ১৭টি।
শুধু ইংল্যান্ডই নয়, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের (ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সের লিগ) দলগুলোর মধ্যেই সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে পেনাল্টি পাওয়ায় সবার ওপরে ইউনাইটেড। এ সময়ে ইউনাইটেড পেনাল্টি পেয়েছে ৪৮টি, দ্বিতীয় জুভেন্টাস (৩৭টি)। লিভারপুল? তালিকায় ২৪তম, পেনাল্টি পেয়েছে ২৪টি!
কিন্তু কেন এত পেনাল্টি পায় ম্যান ইউনাইটেড? সেটির ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছে ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট গোলডটকম। সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, যে দলের প্রতিপক্ষ বক্স ও এর আশপাশে বলের দখল বেশি থাকবে, প্রতিপক্ষ বক্সের আশপাশে বল কেড়ে নেওয়ার জন্য যে দল বেশি চাপ প্রয়োগ করবে, প্রতিপক্ষ বক্সে বলে স্পর্শ বেশি থাকবে...তাদেরই পেনাল্টি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু গোলডটকম বলছে, গত আড়াই মৌসুমে ইউনাইটেডের পেনাল্টি পাওয়ার হার এই তত্ত্বে চপেটাঘাতই করে!
প্রতিপক্ষের বক্সে একটা দল কতবার বল স্পর্শ—২০১৮ সালের আগস্ট থেকে প্রিমিয়ার লিগে সেই হিসাব কষে গোলডটকম দেখাচ্ছে, সবার ওপরে এই তালিকায় ম্যান সিটি (বলে স্পর্শ ৩৬৮১ বার), দুইয়ে লিভারপুল (৩০৯৫ বার), আর ম্যান ইউনাইটেড পাঁচে (২৩২৯ বার)।
ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের দলগুলোর মধ্যে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে এই হিসাবটা করলেও ম্যান সিটিই সেখানে সবার ওপরে থাকছে (বলে স্পর্শ ৫৭৭২ বার)। বায়ার্ন মিউনিখ (৪৬৯৫) দুইয়ে, লিভারপুল তিনে (৪৪০৪)। ম্যান ইউনাইটেড এই তালিকায় দশম (৩৫৫৩)।
এবার আসা যাক প্রতিপক্ষের বক্স ও এর আশপাশে (ফাইনাল থার্ড—ফুটবল মাঠকে রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণ এই তিন ভাগে ভাগ করে নিলে একটা দলের আক্রমণের ভাগ) একটা দল কতবার ফাউলের শিকার হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানে। সেখানে অবশ্য ম্যান ইউনাইটেড বেশ ‘ভালো’ অবস্থানে। ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের দলগুলোর মধ্যে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে এই তালিকায় বার্সেলোনা (৪৫৮ বার ফাউলের শিকার) সবার ওপরে, দুইয়ে জুভেন্টাস (৩৯০), ম্যান ইউনাইটেড এই তালিকায় পাঁচে (৩৮১)। ম্যান সিটি অষ্টম (৩৬৮), লিভারপুল আছে ১৬ নম্বরে (৩২৪)।
ম্যান ইউনাইটেড পাল্টা আক্রমণে ভয়ংকর, দ্রুত প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে ঢুকে যায়, তখন প্রতিপক্ষ তাদের ফাউল করা ছাড়া উপায় থাকে না—এমন একটা ব্যাখ্যাও অনেকের মুখে শোনা যায়। কিন্তু পাল্টা আক্রমণ থেকে গোলের হিসাব বলছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমের শুরু থেকে ইউরোপে এই তালিকায় সবার ওপরে নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পের পিএসজি (৩৮)। অথচ পেনাল্টি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ম্যান ইউনাইটেডের চেয়ে পেনাল্টি পেয়েছে ১৫টি কম! ‘দ্রুত পাল্টা আক্রমণের’ তালিকায় ইউরোপে পিএসজি, সিটি, লিভারপুল এমনকি উলভারহ্যাম্পটনেরও পেছনে ইউনাইটেড!
গোলডটকমের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হওয়া খেলোয়াড়ের তালিকার সেরা বিশেও ম্যান ইউনাইটেডের কোনো খেলোয়াড় নেই।
অথচ এত সবকিছুর পরও ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে গড়ে কত ম্যাচ পর একটা দল পেনাল্টি পায়—সে হিসাবে ইউরোপে সবার ওপরে ম্যান ইউনাইটেড, গড়ে ২.৯ ম্যাচ পর পর একটি করে পেনাল্টি পায় তারা। জুভেন্টাস এই তালিকায় দুই নম্বরে—৩.৩ ম্যাচ পরপর পায় পেনাল্টি। লিভারপুল-সিটি সেরা পাঁচে নেই।
তবে মার্কাস রাশফোর্ড ও আন্থনি মার্শিয়াল এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারেন। গত আড়াই মৌসুমে দুজন মিলে ১৮টি পেনাল্টি জিতেছেন, ইউরোপে কোনো নির্দিষ্ট আক্রমণ জুটি আর এত পেনাল্টি জেতেননি। না পিএসজির নেইমার-এমবাপ্পে (১৫টি), না লিভারপুলের সালাহ-মানে (১৪টি)।
তবে অন্য সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও শুধু দুজন খেলোয়াড়ের কারণেই ম্যান ইউনাইটেড এত পেনাল্টি জিতছে, এটা ব্যাখ্যা হতে পারে না বলেই জানাচ্ছে গোলডটকম। তাদের চোখে এটা পরিসংখ্যানিক একটা ব্যতিক্রম।