খেলাটা স্প্যানিশ সুপার কাপের। সেটির শত বছর ধরে চলে আসা ছক বদলে টুর্নামেন্টটিকে স্পেনের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে যে অর্থই একমাত্র প্রেরণা ছিল স্প্যানিশ ফেডারেশনের, তা কে না জানে। এ নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অবৈধ কিছু করেনি স্প্যানিশ ফেডারেশন, কিন্তু খেলার চেতনার দিক থেকে কাজটা ঠিক হলো কি না, সেটিই ছিল প্রশ্ন।
তাহলে পিকের ক্ষেত্রে কী বলা যায়! নতুন ছকের স্প্যানিশ সুপার কাপ এমনভাবে সাজানো, সেখানে পিকের দল বার্সেলোনা আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ যে নিয়মিত খেলবে, সেটি নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায়। সেই টুর্নামেন্ট সৌদি আরবে নেওয়ার বিনিময়ে কমিশন নিয়েছেন পিকে। গতকাল স্প্যানিশ পত্রিকা এল কনফিদেনসিয়ালের প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন ফাঁস করেছে এটি।
কিন্তু এরপরও পিকের গলায় জোর একই আছে। বার্সা ডিফেন্ডার সদম্ভে জানিয়ে দিলেন, তিনি অবৈধ কিছু করেননি।
২০২০ সাল থেকে সুপার কাপ স্পেনের বদলে হচ্ছে সৌদি আরবে। মাঝে অবশ্য ২০২১ সুপার কাপ স্পেনেই হয়েছে, কিন্তু সেটি হয়েছে করোনার সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে। তা সৌদি আরবে টুর্নামেন্টটা নেওয়ার জন্য ছক বদলে টুর্নামেন্টটাকে দুই দল থেকে চার দলের করা হয়েছে।
আগে শুধু স্প্যানিশ লিগ ও কাপজয়ী খেলত টুর্নামেন্টে—দুটি শিরোপা একই দল জিতলে সুযোগ পেত কাপে রানার্সআপ দল। সেখানে ছক এমনভাবে বদলানো হলো, যাতে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার সব সময়ই খেলা নিশ্চিত করা যায়। হিসাব সোজা, বার্সা-রিয়াল না থাকলে তো আর সৌদি আরব টাকা ঢালতে আগ্রহী হবে না! নতুন ছকে কাপের দুই ফাইনালিস্টের পাশাপাশি সুযোগ পাবে দুই কাপ ফাইনালিস্টের বাইরে লিগের শীর্ষ দুই দল। আর বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদ যে ১০০ বারের মধ্যে অন্তত ৯৮-৯৯ বারই লিগে সেরা দুইয়ে বা কাপের ফাইনালে থাকবে, তা বোধ হয় ধরেই নেওয়া যায়!
এই ছক বদলে, দেশ বদলে সুপার কাপের ভাগ্য বদলে ফেলার কারণ? ছয় বছরের চুক্তিতে প্রতি মৌসুমে সুপার কাপ সৌদি আরবে হলেই দেশটির কাছ থেকে ৪ কোটি ইউরো পাবে স্প্যানিশ ফেডারেশন, ৬ বছরে ২৪ কোটি! কিন্তু এর ১০ শতাংশ কমিশন পিকের, অর্থাৎ এত আয়োজন করে স্প্যানিশ সুপার সৌদি আরবে নেওয়ায় পিকের আয় হবে ২ কোটি ৪০ লাখ! সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে চুক্তিটা যে পিকেই এনে দিয়েছেন।
কিন্তু টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া একটা ক্লাবের খেলোয়াড় হয়ে এমন চুক্তিতে তাঁর অংশ নেওয়া, সেটি থেকে অর্থ নেওয়া স্বার্থের সংঘাত কি না, সে আলোচনা তো আছেই। পাশাপাশি আলোচনা চলছে, পিকে অবৈধ কোনো কাজ করেছেন কি না, সেটি নিয়েও। গতকাল এল কনফিদেনসিয়াল এসব ফাঁস করার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে জানিয়েছে, তাদের কাছে নথির প্রমাণ আছে, পাশাপাশি পিকে আর স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের (আরএফইএফ) সভাপতি লুইস রুবিয়ালেসের কথোপকথনের অডিও-ও তাদের কাছে আছে।
খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা ফাঁস করা হয়েছে। দুই বছর আগে যেটা খবরের শিরোনামে আসেনি, সেটা নিয়ে এখন খবর বানানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এটা।
মজার ব্যাপার, এই প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার দিন তিনেক আগে স্প্যানিশ ফেডারেশন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, তাদের অফিসের কম্পিউটার হ্যাক করে কেউ গোপনীয় নথি ও সভাপতির (রুবিয়ালেস) কিছু অডিও ক্লিপ চুরি করেছে!
তা এল কনফিদেনসিয়ালের প্রতিবেদনের পর থেকেই চাপের মুখে থাকা পিকে কাল লিগে বার্সেলোনা-কাদিজের ম্যাচের আগেই টুইটারে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ম্যাচের পর ভিডিও সম্প্রচারমাধ্যম টুইচে তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন। চোটের কারণে পিকে ম্যাচে খেলেননি।
ম্যাচের পর টুইচে ভিডিওতে এসে বলেছেন, ‘আমার কোনো কিছু লুকানোর নেই। আমরা যা করেছি, এখানে অবৈধ কিছু তো করিনি। স্বার্থের সংঘাতের ব্যাপারে আমার দিকটা আমি পরে ব্যাখ্যা করব। কিন্তু আমি এখানে লুকোছাপার কিছু দেখি না। বরং গর্ব করি। কারণ, আমরা দারুণ একটা কাজ করেছি।’
পিকে অবশ্য সরাসরি অর্থটা নেননি বলে এল কনফিদেনসিয়ালের প্রতিবেদনে জানানো হয়। সেখানে লেখা ছিল, পিকের প্রতিষ্ঠান কসমস গ্রুপের অ্যাকাউন্টে টাকাটা ঢুকেছে, তবে বিতর্ক এড়াতে সেটাও স্প্যানিশ ফেডারেশন বা সৌদি আয়োজকদের কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া হয়নি। কিন্তু কাল পিকে টুইচে বললেন, তিনি সরাসরি সৌদি আয়োজকদের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন, এবং তিনি যে কমিশন পাচ্ছেন সেটা ২০১৯ সালে চুক্তি হওয়ার সময় থেকেই সবাই জানত।
এই অডিও ক্লিপ ফাঁস যাঁরা করেছেন, তাঁরাই অবৈধ কাজটা করেছেন বলে উল্টো অভিযোগ বার্সা ডিফেন্ডারের, ‘খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এটা ফাঁস করা হয়েছে। দুই বছর আগে যেটা খবরের শিরোনামে আসেনি, সেটা নিয়ে এখন খবর বানানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এটা। এখানে একমাত্র অবৈধ কাজ হচ্ছে অডিও ক্লিপগুলো ফাঁস করে দেওয়া।’
ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে অবশ্য কোন ক্লাব কত পাবে, পিকে আর স্প্যানিশ ফেডারেশন কত পাবে...সবই রুবিয়ালেসকে ব্যাখ্যা করেছেন পিকে। যদিও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে এ চুক্তির ঘোষণার সময়ে রুবিয়ালেস জানিয়েছিলেন, তাঁরা পিকেকে কোনো ধরনের কমিশন দিচ্ছেন না।
কিন্তু এখন যখন প্রমাণিত হলো পিকের প্রতিষ্ঠান কমিশন পেয়েছে, সেটি নিয়ে বরং জোর গলায়ই কথা বলছেন পিকে, ‘শুধু সৌদি আরব নয়, আমাদের (কসমস) মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক। তারা চেয়েছে ফুটবল টুর্নামেন্টটাকে তাদের দেশে নিয়ে যেতে, বৃহৎ পরিসরে সবকিছু দেখার পর আমরা রুবিয়ালেসের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখতে চেয়েছি, তিনি সুপারকোপা সেখানে নিয়ে যেতে আগ্রহী হবেন কি না। প্রস্তাবটা তাঁর পছন্দ হয়েছে। এখন মানুষ তো নতুন এ ছকেই মজেছে! সৌদি আরব শুধু নয়, মায়ামির সঙ্গেও কথা বলেছি আমরা। কাতার থেকেও একটা প্রস্তাব ছিল।’
অডিওতে ফেডারেশনের সভাপতি রুবিয়ালেস আতলেতিকো মাদ্রিদকে নিয়ে অপমানসূচক অনেক কথা বলেছেন। সেটিরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন পিকে, ‘আতলেতিকোকে নিয়ে কথাগুলো আসলে... রাস্তা-ঘাটে মানুষ যে রকম মজা করে, সে রকম কিছু কৌতুককে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। আমরা সেভাবে কথা বলছিলাম। কারণ, আমার কাছে মনে হয়েছে, রুবিয়ালেস একজন রিয়াল মাদ্রিদ–সমর্থক।’
এরপর আবার কথা ঘুরিয়ে পাল্টা অভিযোগ, ‘তবে যা-ই বলুন না কেন, অডিও ফাঁস করাটা অবৈধ। অন্য যে কারও এমন অডিও ফাঁস হোক, তাঁর মনে হবে, তাঁর অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’