পানেনকা পেনাল্টিতে চেক হাসি, জার্মান স্বপ্নভঙ্গ

বিখ্যাত সেই পেনাল্টির পর আন্তোনিন পানেনকাউয়েফা
যে সময়ে হওয়ার কথা, করোনা সেই সময়ে ইউরো হতে দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে, করোনা তখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। তাতে কী! করোনার ভয়ে তো সব বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। ১১ জুন থেকে তাই মাঠে গড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতীয় দলগুলোর সবচেয়ে মর্যাদার আসর। তবে আনুষ্ঠানিক নামটা থাকছে আগের মতোই—ইউরো ২০২০। আরও একবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে ওঠার আগে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে ফিরে দেখা যাক আগের আসরগুলো।

পানেনকা পেনাল্টির জন্ম

বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক ফুটবলটা ঠিক আর খেলোয়াড়দের রুটি-রুজি নয়। তবে ফুটবলে স্মরণীয় মুহূর্ত বা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় যোগ করতে পিছিয়ে নেই আন্তর্জাতিক আসরগুলো। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে পেলের আবির্ভাব, ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ঈশ্বরের হাতে গোল—এসব ঘটনা ফুটবলের ইতিহাসই তো পাল্টে দিয়েছে। জিনেদিন জিদানের সেই ঢুস কিংবা রজার মিলারের বিখ্যাত নাচ কি কেউ কখনো ভুলতে পারবে!

পানেনকা পেনাল্টির জনক আন্তোনিন পানেনকা
উয়েফা


এ রকমই এক মুহূর্তের জন্ম হয়েছিল ১৯৭৬ ইউরোতেও। বেলগ্রেডের রেড স্টার স্টেডিয়ামে ফাইনালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার মুখোমুখি সেই সময়ের বিশ্বকাপ ও ইউরো চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে চেকোস্লোভাকিয়া আন্ডারডগই ছিল। কিন্তু সেমিফাইনালে ইয়োহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসকে হারানোর পর চেকদের আর দুর্বল ভাবতে সাহস করেনি জার্মানি। নেদারল্যান্ডস তখন বিশ্বকাপের রানার্সআপ দল।

জার্মানরা ফাইনালে উঠেছিল যুগোস্লাভিয়াকে সেমিফাইনালে হারিয়ে। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে দলটাও দুর্দান্ত ফর্মে তখন। কিন্তু কোচ ভেকলাভ জেজেকের চেক দলটা ছিল মানসিকভাবে দারুণ শক্তিশালী। জার্মানদের চমকে দিয়ে ফাইনালের ২৫ মিনিটের মধ্যে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় চেকোস্লোভাকিয়া। জার্মানরা ম্যাচেও ফেরে ডিয়েটার মুলার ও বার্নড হোলজেনবেইনের গোলে।
নির্ধারিত সময়ে ২-২ সমতার পর অতিরিক্ত সময়েও গোল হলো না কোনো। ইউরোর ফাইনাল তাই প্রথমবারের মতো গড়াল টাইব্রেকারে। সেখানেই মনে রাখার মতো সেই মুহূর্তটার জন্ম।
প্রথম তিনটি করে শটে দুই দলই গোল পেল। চেকের হয়ে চতুর্থ শটটা নিলেন লাদিস্লাভ ইয়ুরকেমিক। এবারও গোল। কিন্তু জার্মানির চতুর্থটা শটটা মিস করলেন উলি হোয়েনেস। চেক পঞ্চম শটে গোল করলেই চ্যাম্পিয়ন!
স্পট কিক নিতে গেলেন বোহেমিয়ানস প্রাহা ক্লাবের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আন্তোনিন পানেনকা। এর আগে দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেললেও কখনোই ফুটবলে বড় কোনো শিরোপা জেতেনি চেকোস্লোভাকিয়া। সামনে গোলপোস্টের নিচে জার্মানির সেপ মায়ার, সে সময়ের অন্যতম সেরা। পানেনকার কাঁধে বিশাল চাপ। কী করা যায়!


যা করলেন, সেটা ফুটবল ইতিহাসে আগে কেউ কখনো করেনি। দৌড়ে এসেছিলেন স্বাভাবিক গতিতেই। কিন্তু জোরে শট নিলেন না, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকেই মারলেন না, শুধু আলতো টোকায় ভাসিয়ে পানেনকা বল মেরে দিলেন সোজা। মায়ার ডান দিকে ঝাঁপিয়েছিলেন, বল মাঝখান দিয়ে ঢুকে গেল জালে। চেক ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন!

১৯৭৬ ইউরো চ্যাম্পিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া
উয়েফা


পরে জার্মান অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার বলেছিলেন, ‘শুধু একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নই এ রকম কিছু করার কথা ভাবতে পারে।’ আলতো টোকায় বল ভাসিয়ে মাঝ বরাবর মারার এই টেকনিকের নামই পরে হয়ে যায় ‘পানেনকা’ পেনাল্টি। মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেন স্বয়ং পেলে, ফরাসি ফুটবল ফেডারেশন আন্তোনিন পানেনকাকে  ‘ফুটবলের কবি’ উপাধিও দেয়।

একনজরে ইউরো ১৯৭৬

স্বাগতিক: যুগোস্লাভিয়া
ফাইনালের ভেন্যু: রেড স্টার স্টেডিয়াম, বেলগ্রেড
চ্যাম্পিয়ন: চেকোস্লোভাকিয়া
রানার্সআপ: জার্মানি
তৃতীয়: নেদারল্যান্ডস
চতুর্থ: যুগোস্লাভিয়া

ফাইনালের একটি মুহূর্ত
উয়েফা


ইউরোপের ফুটবলে তখন আয়াক্স আর বায়ার্ন মিউনিখের দাপট। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল আয়াক্স। তারপরের তিন বছর আবার জেতে বায়ার্ন মিউনিখ। এই দুই ক্লাবের ফুটবলারদেরই দাপট ছিল নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির জাতীয় দলে। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল। যেখানে ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। ধারণা করা হচ্ছিল, ১৯৭৬ ইউরোতেও এ দুই দল ফাইনাল খেলবে। জার্মানির ওপর প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে ছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু জাগ্রেবে বৃষ্টিবিঘ্নিত এক বিতর্কিত সেমিফাইনালে ৩-১ গোলে চেকরা হারিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডসকে।

আরও যত গল্প

আন্তোনিন পানেনকা
উয়েফা

পানেনকার কৃতিস্বত্ব
জার্মানির বিপক্ষে পেনাল্টিতে আন্তোনিন পানেনকার ওই বিখ্যাত গোল নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। পরে এক সাক্ষাৎকারে পানেনকা নিজেও বলেছিলেন, ‘যদি এই পেনাল্টিটার কৃতিস্বত্ব অনুমোদন নেওয়া যেত, আমি তখন নিয়ে রাখতাম।’ চেকোস্লোভাকিয়ার ওই দলের গোলরক্ষক ইভো ভিক্টোরের সঙ্গে অনুশীলনে নাকি দিনের পর দিন এই রকম পেনাল্টি শট অনুশীলন করতেন পানেনকা। একপর্যায়ে গিয়ে দুজন চকলেট–বিয়ার বাজি ধরতে শুরু করেন। যে হারবে, সে অন্যজনকে খাওয়াবে। পানেনকা পরে বলেছেন, ‘আমি বাজিতে এত জিততাম যে খেয়ে খেয়ে আমার ওজন বাড়তে শুরু করেছিল।’


শেষ হার
ফাইনালে নিজের ১০০তম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন জার্মানির অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। সেদিন টাইব্রেকারে দলের পঞ্চম শটটি নেওয়ার কথা ছিল বেকেনবাওয়ারের। কিন্তু এর আগেই উলি হোয়েনেসের মিস ও পানেনকার গোলে ফল নির্ধারিত হয়ে যায়। তবে ১৯৭৬ ইউরোর ফাইনালের পর আর কোনো বড় টুর্নামেন্টে কখনো টাইব্রেকারে হারেনি জার্মানি।

আরও পড়ুন