স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন—বহুল চর্চিত এই বাংলা প্রবাদের মতো শিরোপা জয়ের চেয়ে শিরোপা ধরে রাখাও কঠিন। এই কথাটা এবার ইউরোয় টের পেতে পারে পর্তুগাল। গতবারের ইউরোজয়ীরা এবার গ্রুপ পর্বে পেয়েছে বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স ও তিনবারের ইউরোজয়ী জার্মানিকে। শিরোপা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের জন্য কতটা কঠিন, তা এই এক তথ্যেই স্পষ্ট।
দল: পর্তুগাল
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৫
দলে আছেন যাঁরা
গোলরক্ষক
রুই পাত্রিসিও (উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স), অ্যান্থনি লোপেস (অলিম্পিক লিওঁ), রুই সিলভা (গ্রানাদা)
সেন্টারব্যাক
রুবেন দিয়াস (ম্যানচেস্টার সিটি), হোসে ফন্ত (লিল), পেপে (এফসি পোর্তো)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
জোয়াও ক্যানসেলো (ম্যানচেস্টার সিটি), নেলসন সেমেদো (উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক
রাফায়েল গেরেইরো (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড), নুনো মেন্দেস (স্পোর্তিং লিসবন)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
উইলিয়াম কারভালহো (রিয়াল বেতিস), দানিলো পেরেইরা (পিএসজি), জোয়াও পালহিনিয়া (স্পোর্তিং লিসবন), রেনাতো সানচেস (লিল)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
ব্রুনো ফার্নান্দেস (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), পেদ্রো গনকালভেস (স্পোর্তিং লিসবন)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার
গনকালো গেদেস (ভ্যালেন্সিয়া), বের্নার্দো সিলভা (ম্যানচেস্টার সিটি), জোয়াও ফেলিক্স (আতলেতিকো মাদ্রিদ), দিওগো জোতা (লিভারপুল)
স্ট্রাইকার
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (জুভেন্টাস), আন্দ্রে সিলভা (আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট), রাফা সিলভা (বেনফিকা)
কোচ
ফার্নান্দো সান্তোস
অধিনায়ক
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ইউরোতে সেরা সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন (২০১৬)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
হাঙ্গেরি (১৫ জুন)
জার্মানি (১৯ জুন)
ফ্রান্স (২৩ জুন)
শক্তি
পর্তুগালের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তাঁদের স্কোয়াড। আন্তর্জাতিক ময়দানে জাতীয় দলের হয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এত ভালো সতীর্থদের সম্ভবত কখনো পাননি। এমনকি পাঁচ বছর আগে যে দলটি ইউরো জিতেছিল, এই দলটা তার চেয়ে কাগজে-কলমে শক্তিশালী।
রোনালদোর সঙ্গে খেলার জন্য দলে আছেন লিভারপুল ও জাতীয় দলের হয়ে গোলের পর গোল করে যাওয়া দিওগো জোতা, আছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই ম্যানচেস্টার সিটি স্কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বের্নার্দো সিলভা। আরও আছেন আতলেতিকোর হয়ে লিগজয়ী ‘নতুন রোনালদো’খ্যাত জোয়াও ফেলিক্স ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একাদশের সবচেয়ে বড় ভরসা ব্রুনো ফার্নান্দেস। ওদিকে গোলের ধারায় আছেন আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের স্ট্রাইকার আন্দ্রে সিলভাও।
স্পোর্তিংয়ের পেদ্রো গনকালভেস ও রাফা সিলভার মতো তারকারাও দুর্দান্ত ক্লাব মৌসুম কাটিয়ে জানান দিয়েছেন, কোচ ডাকলে পারফর্ম করতে তাঁরাও প্রস্তুত। আগে যেমন বেঞ্চ থেকে প্রয়োজন হলে সোয়ানসি সিটির ফরোয়ার্ড (এদের) কিংবা বেসিকতাসের উইঙ্গারের (রিকার্দো কারেজমা) ওপর ভরসা করতে হতো, এখন অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো।
মাঝমাঠে জোয়াও মুতিনিওর হাত থেকে ব্যাটন নিতে দলে এসেছেন রুবেন নেভেস, জোয়াও পালহিনিয়ার মতো তারকারা। তাঁদের সঙ্গে লিলের হয়ে লিগজয়ী রেনাতো সানচেস, পিএসজির দানিলো কিংবা নির্ভরতার প্রতীক উইলিয়াম কারভালিওরা তো আছেনই। এসব খেলোয়াড়ের উত্থানে জায়গা হারিয়েছেন আন্দ্রে গোমেস, জোয়াও মারিও ও আদ্রিয়েন সিলভার মতো মিডফিল্ডাররা—গত ইউরোতেও মূল একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তাঁরা।
১০ বছর ধরে পর্তুগালের সেন্ট্রাল ডিফেন্সে পেপে, ব্রুনো আলভেস, রিকার্দো কারভালিও, হোসে ফন্তরা খেলে গেলেও এবার দলে এসেছেন রুবেন দিয়াসের মতো তারকা। তিনি এতই ভালো যে একাই পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির রক্ষণভাগ বদলে দিয়েছেন—বানিয়েছেন ইউরোপের অন্যতম সেরা। আগে পর্তুগালের রক্ষণে পেপের সঙ্গে কে খেলবেন, এটাই ছিল জানার বিষয়। এখন প্রশ্নটা ঘুরে হয়ে গিয়েছে—রুবেন দিয়াসের সঙ্গে কে খেলবেন?
রোনালদোদের কোচও দলের অন্যতম শক্তির জায়গা। ফার্নান্দো সান্তোস সম্প্রতি দলের সঙ্গে নতুন করে চার বছরের চুক্তি করেছেন। এই চার বছর পুরো থাকতে পারলে রোনালদোদের কোচ হিসেবে এক দশক থাকা হয়ে যাবে তাঁর। অবশ্য পর্তুগালের হয়ে যিনি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে মাত্র চারবার হেরেছেন, তাঁর ওপর ফেডারেশনের কর্তারা তো আস্থা রাখবেনই। কখনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় না নেওয়া সান্তোস এবারও চাইবেন ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে যেকোনো এক দলকে টপকে পরের রাউন্ডে উঠতে। তারপর শিরোপার চিন্তা।
দুর্বলতা
রুবেন দিয়াস, রাফায়েল গেরেইরো কিংবা জোয়াও ক্যানসেলোর মতো দুর্দান্ত কিছু ডিফেন্ডার মূল একাদশের অংশ হওয়া সত্ত্বেও পর্তুগালের রক্ষণভাগ নিয়ে চিন্তা করার বেশ কিছু জায়গা আছে। এমনিতে ৪-৪-২ ছকে সাবধানী কৌশলে খেলতে পছন্দ করেন কোচ ফের্নান্দো সান্তোস। কিন্তু এবার দুদিকেই অসাধারণ দুজন আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক এবং ওপরে রোনালদো, ফেলিক্স, জোতা, সিলভা, ফার্নান্দেসের মতো আক্রমণাত্মক ফুটবলার থাকার কারণে কয়েক মাস ধরে দলকে ৪-৩-৩ ছকে খেলাচ্ছেন—যেখানে ফুলব্যাক দুজন রক্ষণ সামলানোর চেয়ে আক্রমণ বেশি করেন। ফলে পর্তুগালকে প্রায়ই ‘হাই লাইন ডিফেন্স’-এ খেলতে হয়। অর্থাৎ রক্ষণভাগ ওপরে উঠে খেলে।
এখন পেপে ও ফন্তের মতো বয়সী সেন্টারব্যাক ওপরে খেলার জন্য কতটুকু উপযোগী, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ওদিকে মূল গোলরক্ষক রুই পাত্রিসিও শট আটকানো ও রিফ্লেক্সের দিক দিয়ে দুর্দান্ত হলেও ম্যানুয়েল নয়্যার, আলিসন বেকার, মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন কিংবা এদেরসনের মতো ‘সুইপার কিপার’ নয়। বক্সের মধ্যে বল পায়ে স্বচ্ছন্দ হতে পারেননি। হাই লাইনে খেলানোর জন্য গোলকিপারের এই গুণটা থাকা বড্ড জরুরি।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-৪-২/৪-৩-৩)
এর আগে সব সময় ৪-৪-২ ছকে দলকে খেলালেও এই দলে আক্রমণাত্মক ফুটবলার বেশি থাকায় এবার হয়তো ৪-৩-৩ ছকে খেলবে পর্তুগাল। গোলপোস্টের নিচে পাত্রিসিও, দুই সেন্টারব্যাক হিসেবে দিয়াসের সঙ্গে ফন্ত ও পেপের মধ্যে যেকোনো একজন, দুই ফুলব্যাক হিসেবে ক্যানসেলো ও গেরেইরো। এই দুই ফুলব্যাক বল পায়ে এত দক্ষ, আক্রমণের সময় ওপরে উঠে ছদ্মবেশী মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
তিন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মধ্যে অন্তত দুজন রক্ষণাত্মক মানসিকতার মিডফিল্ডার নামাতে পছন্দ করেন সান্তোস—মূল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার দানিলো পেরেইরা ও উইলিয়াম কারভালিও। সময় সুযোগ মতো তাদের বিকল্প হিসেবে নামানো হয় উলভারহ্যাম্পটনের দুই মিডফিল্ডার রুবেন নেভেস ও জোয়াও মুতিনিওকে। পাশে আরেক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা ব্রুনো ফার্নান্দেসের কাজ হবে ওপরে উঠে ছদ্মবেশী প্লেমেকারের ভূমিকা নেওয়া।
আক্রমণভাগে রোনালদোর দুপাশে খেলার জন্য লড়বেন জোতা, বের্নার্দো সিলভা, জোয়াও ফেলিক্সের মধ্যে যেকোনো দুজন। প্রয়োজন অনুযায়ী ৪-৩-৩ ছক থেকে ৪-৪-২ তে পরিবর্তিত হতে এমন দুজন উইঙ্গার লাগবে যাঁরা প্রয়োজনমতো ওঠানামা করতে পারেন। সে হিসেবে সিলভা আর জোতার খেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
আমরা একই গ্রুপে ফ্রান্স ও জার্মানিকে চাইনি এটা সত্যি। তবে এটাও সত্যি, তারাও পর্তুগালকে তাদের গ্রুপে চায়নি। আমরা টুর্নামেন্টের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি, দেখা যাক কী হয়
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
সাবেক ক্লাব সতীর্থ ইকার ক্যাসিয়াসের পর দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে টানা দুবার ইউরো জেতার আশা নিয়ে মাঠে নামবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কিন্তু মূল একাদশের প্রায় প্রত্যেকেই যেহেতু বড় বড় ক্লাবে খেলেন, দীর্ঘ মৌসুম কাটিয়ে এসেছেন, তাই ইউরোতে তাঁদের ভালো খেলার দম কতটুকু থাকে, সেটাও দেখার বিষয়।