নীরব, লাজুক মেসির এ কোন রূপ

আর্জেন্টিনার হয়ে তেমন কিছুই জিততে পারেননি লিওনেল মেসি। ফাইল ছবি এএফপি
আর্জেন্টিনার হয়ে তেমন কিছুই জিততে পারেননি লিওনেল মেসি। ফাইল ছবি এএফপি

সেই ছবিটা মনে আছে? সেই যে ছবিটা—কিছু না পাওয়ার হতাশায় ক্লান্ত নুয়ে পড়া একটা মুখ। ব্রাজিল ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে জার্মানির কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর ক্লান্ত পায়ে একা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন মেসি। সেই ছবিটি যেন জাতীয় দলের জার্সিতে মেসির হতাশার প্রতীক হয়ে গিয়েছিল!

ও হ্যাঁ, আরেকটি ছবি। যেটি সবাই দেখেছিল ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসরের ফাইনালের পর। চিলির কাছে সেবারের ফাইনালে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেছিলেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। চারদিক থেকে সতীর্থরা ছুটে এসেছিলেন ভেঙে পড়া মেসিকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জল ছলছল চোখটা কিছুতেই আর ওপরে উঠছিল না। মুষড়ে পড়া মেসির সেই মুখটা কেমন যেন ‘নিথর’ লাগছিল!

মেসির ওই কষ্ট দেখতে বয়েই গিয়েছিল আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীদের! বেশির ভাগ সমর্থক এ দুবারই বরং ফুটবলের বরপুত্রকে শাপ-শাপান্ত করছে। ‘মেসি কী আর আর্জেন্টিনার নাকি, সে তো বার্সার ফুটবলার’, ‘আর্জেন্টিনার হয়ে কখনোই মেসি শতভাগ দিতে পারে না’—এ ধরনের কথা বলেছে আর্জেন্টাইনরা। সেসব কথা মেসি মুখ বুজে সয়ে গেছেন, টুঁ শব্দটিও করেননি। যেটা মেসি তাঁর ক্যারিয়ারে সব সময়ই করে এসেছেন—কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে নীরবে খেলে যাও।

>

চিরকালীন বিনয়ী লিওনেল মেসি হঠাৎ করেই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে উঠছেন। মাঠে বাজে ট্যাকল করছেন। এমনকি মেজাজ হারিয়ে ঝগড়ায়ও জড়িয়ে পড়ছেন

হয়তো তখন মনে মনে সংকল্প করেছেন, কোনো দিন সুযোগ আসলে সবকিছুর জবাব তাঁর বাঁ পায়ের জাদুতেই দেবেন। কিন্তু সমালোচনা এতটা কঠিন রূপ নিতে থাকে, মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেন। ২০১৬ কোপা আমেরিকার পর সবাইকে বিস্ময় উপহার দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায়ের ঘোষণা দেন। পরে ডিয়েগো ম্যারাডোনাসহ অনেকের অনুরোধে আবার ফেরেন জাতীয় দলে। ফিরেই পতিত আর্জেন্টিনাকে পাইয়ে দেন ২০১৮ বিশ্বকাপের টিকিট।

রাশিয়া বিশ্বকাপে আবার নিষ্প্রভ আর্জেন্টিনার ফুটবল রাজকুমার। ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে আর্জেন্টিনাও ছিটকে পড়েছে শেষ ষোলো থেকে। আবার মেসির যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ! আর এবারও মেসি বরাবরের মতো নীরব। সব সমালোচনা হজম করতে অথবা এসবের প্রতিবাদ করতে কিছুদিনের জন্য জাতীয় দল থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন।

মেসি আবার ফিরেছেন কোপা আমেরিকার ঠিক আগে। কিন্তু এবার যে আর্জেন্টিনা দলে ভিন্ন এক মেসিই ফিরেছেন সেটা জানান দিয়ে গেছেন কোপা আমেরিকা। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরে যাওয়ার পর সমালোচনা করেছিলেন রেফারিং আর কনমেবলের অসততা নিয়ে। যেটি আসলে মেসির ধাতে কখনোই ছিল না। এরপর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে চিলির গ্যারি মেদেলকে ফাউল করে দেখেছেন ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় লাল কার্ড। প্রথম লাল কার্ডটি তিনি দেখেছিলেন আর্জেন্টিনা দলে অভিষেক ম্যাচে, ২০০৪ সালে।

চিলির বিপক্ষে ওই লাল কার্ড দেখার পর আরেকবার কনমেবলের সমালোচনা করে তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মেসি। ফিরেছেন সৌদি আরবে এ মাসেই ব্রাজিলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। ফেরার ম্যাচটি তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন দলকে জেতানো একমাত্র গোল করে। সে ম্যাচে ব্রাজিল কোচ তিতের সঙ্গে অহেতুক ঝগড়ায় জড়িয়েছেন। উরুগুয়ের সঙ্গে পরের ম্যাচে দলের শেষ গোলটি করে আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছেন ২-২ গোলের ড্র। কিন্তু ওই ম্যাচেও একটি মুহূর্তে ‘মিস্টার মেসির’ ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ‘মিস্টার হাইড’! উরুগুয়ের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। যেটা রূপ নিতে চলেছিল মারামারিতে!

তা চির বিনয়ী মেসি হঠাৎ এমন কেন হয়ে গেলেন? ক্যারিয়ারের সূর্যটা তাঁর অস্তাচলে যেতে বসেছে। খেলোয়াড়ি জীবনের ওপারে ডুব দিতে আর বেশি সময় নেই। ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসে হয়তো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের খাতা খুলে বসেছেন মেসি। দশটি লা লিগা, চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, পাঁচটি ব্যালন ডি’অর...বার্সার হয়ে তো বটেই, মেসির ব্যক্তিগত অর্জনের ডালিটা কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু খেরোখাতায় আর্জেন্টিনার হয়ে শুধুই শূন্য। একটি অলিম্পিক পদক ছাড়া আর কিছুই যে নেই সেখানে।

এই হতাশা থেকেই কি মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে মেসির?