নিউক্যাসলের নতুন মালিক ঠিক কতটা ধনী?
ইউরোপিয়ান ফুটবলে এসেছেন এক নতুন ধনী। তাঁর স্নেহধন্য একটি কনসোর্টিয়াম কিনে নিয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে।
এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাবে পরিণত হয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাব। যাঁর মালিকানা নেওয়ার মধ্য দিয়ে নিউক্যাসলে এই পালাবদল, তাঁর নাম ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন—সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
নিউক্যাসল কিনে নেওয়া সৌদি মালিকানাধীন কনসোর্টিয়াম সৌদি পাবলিক ইনভেস্ট ফান্ডের (পিআইএফ) প্রধান তিনি।
৩০ কোটি পাউন্ডে নিউক্যাসলের শতভাগ মালিকানা হাতবদল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে। ম্যানচেস্টার সিটি মালিক শেখ মনসুর এবং মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশাপাশি একটি ছবি।
সালমানের ছবির নিচে লেখা—৩২ হাজার কোটি পাউন্ড, শেখ মনসুরের ছবির নিচের লেখা—২৩০০ কোটি পাউন্ড। নিউক্যাসল সৌদি কনসোর্টিয়ামের মালিকানায় যাওয়ার আগে ইংলিশ লিগে শেখ মনসুরের কল্যাণে সিটিই ছিল সবচেয়ে ধনী ক্লাব। মোহাম্মদ বিন সালমান এই হিসাব লিখিয়েছেন নতুন করে—সিটি মালিকের চেয়ে ১১ গুণ বেশি সম্পদের মালিক তিনি।
হিসাবটি আরও খোলাসা করা যায়। সৌদি যুবরাজ সালমানের প্রতিষ্ঠান পিআইএফের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন পাউন্ড (৩২ হাজার কোটি পাউন্ড)। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন পাউন্ড (১৩০০ কোটি পাউন্ড)। সিটি মালিক শেখ মনসুর আবার ব্যক্তিগত সম্পদে এগিয়ে।
তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের মোট আর্থিক মূল্য ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড (১৭০০ কোটি পাউন্ড)। কিন্তু সৌদি রাজপরিবার থেকে উঠে আসায় খুব স্বাভাবিকভাবেই নিউক্যাসলের পেছনে এই পরিবারের প্রভাব থাকবে বলে সবার ধারণা।
সে ক্ষেত্রে আর্থিক হিসাবে সৌদি রাজপরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণও জেনে রাখা ভালো—১.৩ ট্রিলিয়ন পাউন্ড কিংবা ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি পাউন্ড। অন্যদিকে, শেখ মনসুর উঠে এসেছেন আবুধাবির রাজপরিবার থেকে। এ পরিবারের মোট আর্থিক সম্পদের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন পাউন্ড কিংবা ৫০ হাজার কোটি পাউন্ড।
এ তো পারিবারিক সম্পদের হিসাব। মোহাম্মদ বিন সালমান মানুষটা কেমন, ধনকুবের হিসেবে জীবনযাপন কেমন—সেসব একটু জেনে নেওয়া যাক। সালমানকে সবাই সংক্ষেপে ‘এমবিএস’ নামে জানেন। মাথায় কিছু ঢুকলে সে জন্য দেদার টাকা খরচ করতে তিনি কুণ্ঠা করেন না।
প্যারিসের অদূরে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্মরণে বানানো একটি বিলাসবহুল বাড়ি ২০১৫ সালে কিনেছিলেন সালমান। ইতিহাসে এটাই নাকি সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি। ৩০ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করে বাড়িটি কেনেন তিনি। এই বাড়িতে রয়েছে ৩টি সুইমিং পুল, ৩০টি কামরা, ব্যক্তিগত স্পা, সিনেমা হল, একটি ডিসকো সেন্টার, দুটি আঙুরবাগান এবং ইউরোপের একমাত্র বাড়ি হিসেবে অ্যাকুয়ারিয়াম বানানো হয়েছে মাটির নিচে।
এই গ্রহের চতুর্থ ব্যয়বহুল ইয়টের মালিকও সৌদি যুবরাজ। ‘সিরিন’ নামে ১৩৩ মিটার লম্বা এই সুপার ইয়টের দাম ৪৮ কোটি ৫০ লাখ ইউরো। ২০১৪ সালে সপ্তাহপ্রতি ৫০ লাখ ডলার ভাড়ায় এই সুপার ইয়ট ভাড়া করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের বিল গেটস। পরের বছর সুপার ইয়টটি কিনে নেন সালমান।
এই সুপার ইয়টে রয়েছে থিয়েটার, সুইমিং পুল, হেলিপ্যাড, গ্যারেজ সুবিধা। অনেকের মতে, সাবমেরিনের চেয়ে মোটেও কম যায় না এই সুপার ইয়ট। গুজব আছে, লেওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘সালভাতর মুন্ডি’ এই সুপার ইয়টেই রেখেছেন সালমান।
‘সালভাতর মুন্ডি’র কথা যেহেতু উঠল, সেহেতু জানিয়ে রাখা ভালো, ইতিহাসের সবচেয়ে দামি এই চিত্রকর্মের মালিক সৌদি যুবরাজ। ২০১৭ সালে ৩৮ কোটি ৯০ লাখ ইউরোয় চিত্রকর্মটি কিনে নেন তিনি।
সালমানকে শুধু চিত্ররসিক ভাবলে ভুল হবে; আমোদ-প্রমোদেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ২০১৫ সালে মালদ্বীপে ব্যক্তিগত এক দ্বীপে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন সালমান। ‘সীমা লঙ্ঘন’ করাই ছিল এই পার্টির মূল কথা। রাশিয়া ও ব্রাজিল থেকে ১৫০ জন নারীকে তিনি উড়িয়ে এনেছিলেন সে পার্টিতে। তাঁদের মধ্যে কেউ যৌন রোগবাহী কি না, তা নিশ্চিত হতে সেসব নারীকে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আগেই করিয়ে নিয়েছিলেন সালমান। পিটবুল, ডিজে আফ্রোজ্যাকো থেকে সাইয়ের মতো সংগীতশিল্পীরা সে পার্টিতে সালমানকে বিনোদিত করতে গিয়েছিলেন।
এই পার্টি নিয়ে যেন জানতে না পারে, সে জন্য ‘ভেলা’ নামে সেই ব্যক্তিগত দ্বীপের ৩০০ কর্মীকে অতিরিক্ত ৫০০০ ডলার দিয়েছিলেন সালমান; যদিও তাতে কাজ হয়নি।
তবে সালমানকে নিয়ে বিতর্কও আছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার সঙ্গে জড়িত সৌদি যুবরাজ।
এই গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করে জো বাইডেন প্রশাসন। সেখানে বলা হয়, ‘খাসোগিকে হত্যা কিংবা আটকের নির্দেশ দিয়েছিলেন সৌদি যুবরাজ।’ সালমান যদিও বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নিজের বিয়ে–সম্পর্কিত কিছু কাগজের জন্য সৌদি দূতাবাসে ঢুকেছিলেন খাসোগি। এরপর তাঁকে আর কেউ দেখেনি।
গত বছর এপ্রিলে নিউক্যাসলকে সৌদি যুবরাজের কনসোর্টিয়াম কিনে নেওয়ার দেনদরবার যখন শুরু হলো, তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন খাসোগি যাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন—হাতিচ চেনগিজ।
ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণাপ্রার্থী ছিলেন তিনি। নিজের আইনজীবীর দ্বারা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষকে পাঠানো সে চিঠিতে হাতিচ লিখেছিলেন, ‘এতে প্রিমিয়ার লিগের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারবে সৌদি কর্তৃপক্ষ।’