দেশের ফুটবলে ছেলে-মেয়ে 'বৈষম্য'?

ছেলেদের ফুটবল প্রতিভার পরিপূর্ণ পরিচর্যা নেই বাংলাদেশে। সে কারণেই হারিয়ে যায় কাতারকে হারানো অনূর্ধ–১৬ দলের প্রতিভাবান ফুটবলাররা। ফাইল ছবি
ছেলেদের ফুটবল প্রতিভার পরিপূর্ণ পরিচর্যা নেই বাংলাদেশে। সে কারণেই হারিয়ে যায় কাতারকে হারানো অনূর্ধ–১৬ দলের প্রতিভাবান ফুটবলাররা। ফাইল ছবি
>মেয়েদের ফুটবলে সাফল্য পাওয়ার জন্য কোনো গোপন সূত্র নেই। বাছাইকৃত প্রতিভাবান মেয়েদের নিয়ে সারা বছর অনুশীলনের ব্যবস্থা, দেশের বাইরে গিয়ে অনুশীলন ম্যাচের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট খেলেই সাফল্য পাচ্ছে তারা। ঠিক এগুলোর অভাবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ছেলেদের ফুটবল।

ক্রীড়াপ্রেমী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক কথাটিই বলেছেন, মেয়েরা পারলে ছেলেরা পারবে না কেন? শুক্রবার বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ফাইনালের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁর আশাবাদ, ‘মেয়েদের ফুটবল দল অনূর্ধ্ব-১৬ আর ১৮ টুর্নামেন্টে ইতিমধ্যেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি আশা করি ছেলেরাও পিছিয়ে থাকবে না। ছেলেরাও ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাবে, ভালো করবে।

প্রধানমন্ত্রী একজন ক্রীড়াপ্রেমীর দৃষ্টিকোণ থেকেই নিজের আশাবাদ শুনিয়েছেন। খেলা ভালোবাসেন বলেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মনে প্রশ্ন, মেয়েরা যখন ভালো করছে, তখন ছেলেরা ভালো করবে না কেন?

সরকার প্রধান যেকোনো সেক্টরেই দেশের সর্বোচ্চ কল্যাণই প্রত্যাশা করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়েদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছেলেদের ভালো করার ক্ষেত্রে কি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) প্রস্তুত করতে পেরেছে? মেয়েদের মতো ছেলেদের নিয়ে তাদের কী কোনো পরিকল্পনা আছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে এটা বলে দেওয়াই যায়, মেয়েদের মতো এতটা পদ্ধতিগত কোনো পরিকল্পনা ছেলেদের নিয়ে বাফুফের নেই। মেয়েদের যেভাবে তৃণমূল পর্যায় থেকে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে, নিয়ম মেনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভালো খাওয়া-দাওয়া ও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বেশি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলানো হচ্ছে। আশ্চর্য হলেও সত্য ছেলেদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোনো পরিকল্পনাই নেই।

২০১৪ সাল থেকে আমাদের মেয়েরা বয়সভিত্তিক পর্যায়ে দারুণ করছে। তারা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ প্রতিযোগিতার চূড়ান্তপর্বে যোগ্যতা অর্জন করেছে, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও ১৮ ফুটবল জিতেছে। এশীয় পর্যায়েও অস্ট্রেলিয়াসহ বড় বড় দলের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে শিখেছে। মোটকথা মেয়েদের ফুটবলের সাফল্য ঐশী কোনো শক্তির মাধ্যমে পরিচালিত নয়, হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সৌভাগ্যও নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা কিছু প্রতিভাবান নারী ফুটবলারের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা মিশেলেই আসছে এই সাফল্য।

ছেলেদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটাই নেই। তাদের জন্য নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পদ্ধতিগত প্রয়াস। দেশে ও দেশের বাইরে ম্যাচ খেলার সুযোগ। ঠিক এসবের অভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ছেলেদের ফুটবল। সে কারণেই গত মাসে বাফুফের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন জাতীয় যুব দলের প্রধান কোচ মাহবুব হোসেন রক্সি। তিনি আবারও জাতীয় ফুটবল দলেরও সহকারী কোচ ছিলেন। সাবেক এই জাতীয় ফুটবলার বসে থেকে থেকে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই পদত্যাগ করেছেন। একই সঙ্গে পদত্যাগ করেছেন বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ও কোচেস এডুকেশন সমন্বয়কারী হিসেবে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করা জোবায়ের নিপু। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘ফুটবল উন্নয়নে ছেলে-মেয়ের বৈষম্য প্রকট।’

ছেলেদের বেলায় মূল অভিযোগ, প্রতিভাগুলোকে ঠিকমতো পরিচর্যা করা হয় না। অকালেই ঝরে পড়ে সব প্রতিভা। একটু খেয়াল করে দেখলে দেখা যায়, ছেলেদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে আমাদের পারফরম্যান্স কিন্তু মোটেও খারাপ নয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৮ দল সাফে আর তাজিকিস্তানের দুর্দান্ত খেলেছে। অনূর্ধ-১৬ দল কাতারের মাটিতে এএফসি প্রতিযোগিতায় কাতারের মতো দলকে ২-০ গোলে হারিয়েছে। প্রতিভা না থাকলে তো এমন ফল সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যা এক জায়গাতেই, এই দলগুলোতে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সংখ্যা কম না হলেও তাদের ধরে রাখা বা উন্নত প্রশিক্ষণ বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কিছুই করা হয়নি। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ২০১৫ সালে সাফ জেতা অনূর্ধ্ব-১৫ দলকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন ২০১৭ সালে কাতারকে হারিয়ে আসা অনূর্ধ্ব-১৬ দল নিয়েও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে এই নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ কোচেস এডুকেশন সমন্বয়কারী জোবায়ের নিপু, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ছেলেদের নিয়ে কাজ করার। তাদের জন্য টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করারও চেষ্টা চালিয়েছি। ভবিষ্যতের শক্তিশালী জাতীয় দল গঠনের জন্য আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু একটাও বাস্তবায়ন হয়নি। সব শেষে এই ব্যর্থতার দায় আমার ওপরেই আসে। কিন্তু ছেলেদের জন্য মেয়েদের মতো ব্যবস্থা থাকলে ছেলেরাও দেশকে সম্মান এনে দিতে পারত।’

একসময় জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল হতো ছেলেদের নিয়ে। কিন্তু এখন সেটা হয়ে গিয়েছে মেয়েদের টুর্নামেন্ট। মেয়েদের নিয়ে টুর্নামেন্ট করা হয়েছে খুবই ভালো। কিন্তু ছেলেদেরটা বন্ধ করে কেন! মেয়েরা ভালো করছে। আরও ভালো করার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু এই জায়গায় ‘বৈষম্য’ কেন?

মেয়েদের ফুটবল ভালো করায় দেশের মানুষ গর্বিত, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা দেশের ফুটবলের মান বিচার হয় কিন্তু ছেলেদের ফুটবল দিয়েই। সে জায়গায় বাফুফে নজর দেবে কবে?